যে আলকরশ্মি অভিনেতা থেকে নিমাই ঘোষকে আলোকচিত্রী বানিয়ে দিয়েছিল তাঁর নাম ‘রে’, বাংলায় তিনি সত্যজিৎ রায় ওরফে মানিক নামেই পরিচিত। ‘মানিকদা’ নামাঙ্কিত নিমাই ঘোষের স্মৃতি কুড়ানো বইটি পাতায় পাতায় সাক্ষ্য দেয় মানিক ঠিকই মানিক চিনেছিলেন। নয়তো কেন তিনি নিমাইকে বলবেন, ‘তুমি তো আমার অ্যাঙ্গেল মেরে দিয়েছো, হে!’
উৎপল দত্তের লিটল থিয়েটার করতেন নিমাই। অভিনয়ের পাশাপাশি মঞ্চে আলোকসজ্জার কাজ শিখেছিলেন সেখানেই। ফটোগ্রাফি তো দূরের কথা, ক্যামেরায় ক্লিকও করতে জানতেন না তিনি। তবে চলচ্চিত্র দুনিয়ার মানুষ শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, ভানু ঘোষ, বংশী চন্দ্রগুপ্ত প্রমুখের সাথে ছিল ওঠাবসা। একদিন তাঁরা তাশের আড্ডায় বসেছেন, ’৬৭ কি ’৬৮ সাল হবে, নিমাই দূরে দাঁড়িয়ে মুড়ি চিবুচ্ছিলেন। এক বন্ধু হুট করেই এসে বলল, একটি ফিক্সড লেন্সের ক্যামেরা বিক্রি হবে, দাম উঠেছে ৬শ রুপি। নিমাইয়ের মাথায় চট করে কি হলো, উনি বন্ধুকে বললেন, তোমার কাছে তো আমি ২শ ৪০ রুপি পাই, ক্যামেরাটা আমাকে দিয়ে দাও, বাকিটা পরে হবে। সেদিনই ক্যামেরা হস্তগত হয় নিমাইয়ের।
হুটহাট করে বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চলে যাওয়ার অভ্যেস ছিল নিমাই ঘোষের। একদিন ক্যানন ক্যামেরাটি হাতে নিয়ে সবান্ধব রওনা দিলেন বর্ধমানের দিকে। সেখানে অপেক্ষা করছিল কল্পনাতীত চমক। রামপুরহাটের কাছে নিমাইয়ের মঞ্চনাটকের সহকর্মী রবি ঘোষ সেখানে অভিনয় করছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে। নিমাই ভেবেছিলেন এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে—রবি দা’র কাজ দেখা যাবে, আর পাশাপাশি ছবি তোলা যাবে। বেশ উত্তেজনা নিয়ে শুটিং স্পটে হাজির হয়ে তারা দেখলেন ওই দিনের শুটিং শেষ, সবাই অনুশীলনে ব্যস্ত। তখনই নিমাই ঘোষ আনাড়ি হাতে, সাথে করে নিয়ে যাওয়া দুই রিল ফিল্ম ছবি তুলে শেষ করে ফেলেন।
পরেরদিন কলকাতার বালিগঞ্জে রেনেসাঁ স্টুডিওতে ছবিগুলো প্রিন্ট করতে দেন। স্টুডিও মালিক ছিলেন সেসময় নামকরা ভূপেন্দ্র কুমার সান্যাল, তিনিও ছিলেন চলচ্চিত্রেরই মানুষ। সকলে তাঁকে ডাকতো মেজ-দা বলে। ছবি প্রিন্টের পর তিনি নিমাইকে বললেন, এগিয়ে যাও, ফটোগ্রাফিতে তুমি সাফল্য পাবে। ছবিগুলো সত্যজিৎকে দেখানোর পরামর্শ দেন শিল্প নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত, বলে রাখি তিনি জঁ রেনোয়ার ‘দ্য রিভার’ ছবিতেও শিল্প নির্দেশক হিসেবে কাজ করেছেন। তো চন্দ্রগুপ্তের পরামর্শে নিমাই গেলেন সত্যজিতের কাছে। ছবিগুলো ধরা সত্যজিতের হাতে, চন্দ্রগুপ্তের আড়ালে দুরুদুরু বুকে দাঁড়িয়ে ছিলেন নিমাই। ছবি দেখার পর সত্যজিৎ জিজ্ঞেস করেন, কে তুলেছে এসব ছবি? চন্দ্রগুপ্ত একপাশে সরে দেখিয়ে দেন নিমাইকে। সত্যজিৎ বলেন, আমি যা করতাম, তুমি ঠিক তাই করেছো। তুমি তো আমার অ্যাঙ্গেল মেরে দিয়েছো হে!
এরপর থেকে মানিকবাবুর বাড়ির দরজা খুলে যায় নিমাই ঘোষের জন্য। শুধু দরজা নয়, মনও জয় করে নেন তিনি। ‘গুগাবাবা’ থেকে সত্যজিতের শেষ ছবি ‘আগন্তুক’ পর্যন্ত নিমাই ঘোষ লেন্সের ভেতর দিয়ে এক নাগারে পাঠ করে গেছেন সত্যজিৎকে। শুটিংয়ের সময় দুপুরের খাবারের বিরতির সময় সেট ছেড়ে কোথাও যেতেন না সত্যজিৎ। তখন অন্যরা বাইরে চলে গেলেও, নিমাই ঘোষ থেকে যেতেন তাঁর মানিকদা’র সাথেই। একারণেই একা সত্যজিতের বহু চিন্তামগ্ন ছবি আমরা পেয়েছি। তাঁর ক্যামেরার কারণেই সত্যজিতের মতো শিল্পীর বাঙ্ময় নিরবতা আজো আমাদের সামনে ধরা আছে। নিমাই ঘোষ সত্যজিতের এতোটাই কাছাকাছি চলে যেতে পেরেছিলেন যে ভোর সাড়ে ৬টায় তাঁর বাসায় চলে যেতেন প্রায়ই। ঐ সময়টাতেই কিছুটা ফাঁকা পাওয়া যেত সত্যজিৎকে। অবশ্য দিনের সব প্রহরেই তাঁর রায় বাড়িতে যাতায়াত ছিল অবারিত।
বাধ্যগত ছাত্রের মতোই লেগে থেকে আলোকচিত্রের নান্দনিক দিক নিমাই ঘোষ শিখেছেন সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকে। যে কোন ফ্রেম সত্যজিৎ সহজ ভঙ্গিতেই বুঝিতে দিতেন কেন সেটি অতোটা ভালো হয়নি, বা কেমনটা হলে আরো ভালো হতো। সত্যজিতের আকর্ষণে কিংবা তাঁর কাছ থেকে শেখার লোভেই হয় তো নিমাই ঘোষ হয়ে পড়েন চলচ্চিত্র ইউনিটের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একসময় নিমাই যখন সত্যজিৎকে জানালেন, অভিনয় নয়, পাকাপাকিভাবে আলোকচিত্রকেই অবলম্বন করতে চান, তখন সত্যজিৎ তাঁর প্রতি আরো মনোযোগী হন এবং তাঁর কিছু ছবি পোস্টারে ব্যবহার করেন।
নিমাই ঘোষ অনেকটা বলা যায় ছায়াসঙ্গীতে পরিণত হয়েছিলেন সত্যজিতের। একজন আলোকচিত্রীর জন্য এটাই কাম্য, তিনি সাবজেক্ট বা বিষয়ের কাছে অদৃশ্য বা বড়জোর ছায়ার মতো হয়ে উঠবেন। যেন তার উপস্থিতি বিষয়ের কাছে গৌন বা অচেতনের মতো হয়ে দাঁড়ায়। তেমনটা হলেই ক্যামেরার চোখে বিষয় ধরা পড়বে স্বমহিমায়। নিমাই ঘোষ সেই মহিমা ধরতে পেরেছিলেন। এমনভাবে নিজেকে আড়াল করে ফেলা সহজ ব্যাপার নয়।
সত্যজিতের শেষ ছবি ‘আগন্তুকে’র শুটিং চলাকালে একটি ছবি তোলেন নিমাই ঘোষ। সেখানে দেখা যায় শুটিংয়ের ফাঁকে রোদে একটি খোলা জায়গায় মোড়ার উপর বসে আছেন সত্যজিৎ। বয়স হয়েছে, অসুস্থতার কারণে দীর্ঘ পাঁচ বছর ছবিও করতে পারেননি। সময়ের ভার যেন তাঁর কাধে ভর করেছে। সূর্যের উল্টো দিকে একটু ঝুকে নিজের হাতের তালুতে চোখ রেখে কি যেন ভাবছেন ‘মায়েস্ত্রো’। সামনে পড়েছে তাঁর ছায়া। ছবিটি নিমাই ঘোষ তুলেছেন ফ্রয়েডিয় কাউচের যেদিকে এনালিস্ট থাকে, সে কোন থেকে। যেন তিনি সত্যজিতের অচেতনকে ধরতে চাইছেন।
‘মানিকদা: মেমোয়ার্স অব সত্যজিৎ রে’ যে বইটি থেকে এই আলোচনা করা হলো, সেটি বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন এস.কে রায় চৌধুরি। এতে যুক্ত হয়েছে প্রখ্যাত অভিনেত্রী শর্মিলী ঠাকুরের একটি মুখবন্ধ। সত্যজিৎ রায়ের জন্মের একশ পূরণের ঠিক আগের বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে মারা যান নিমাই ঘোষ। যতদিন বেঁচে ছিলেন সত্যজিৎ রায়কে স্মরণ করেছেন। বইয়ের ভেতর স্মৃতিচারণ করেছেন অল্প পরিসরেই, তবে স্মৃতি ধরেছেন বিপুল। সত্যজিতের স্মৃতি। মানিকের মুহূর্তকে তিনি মূর্ত করে রেখে গেছেন চিরকালের জন্য।
বই: মানিকদা: মেমোয়ার্স অব সত্যজিৎ রে, লেখক: নিমাই ঘোষ, বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদ: এস কে রায় চৌধুরী, প্রকাশক: হার্পার কলিন্স ইন্ডিয়া, প্রকাশ: ২০১১।