ফয়েজ আলমের পরচিতি মূলত বাংলাদেশী উত্তর-উপনিবেশী তাত্ত্বিক ও অনুবাদক হিসাবে। বহু বাংলাদেশী তরুণের উত্তর-উপনিবেশবাদ সম্পর্কিত জানাশোনার ভিত্তিটা তৈরি হয়েছে তার লেখা ও অনুবাদ পাঠ করেই। আমার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। তবে ফয়েজ আলমের তাত্ত্বিক লেখালেখির সাথে বাংলাদেশের মানুষ যতটা পরিচিত তার কবিতার সাথে অতটা না। তার প্রথম কবিতার বই ‘ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ খাওয়া মানুষ’ বের হয়েছিলো দুই দশক আগে, ১৯৯৯ সালে, স্মৃতি যদি প্রতারিত করে না থাকে। এই বছর বের হল নতুন কবিতার বই ‘জলছাপে লেখা’।
আমার জন্য এটা বিশেষ ঘটনা বটে। কেননা এই বইয়ের বেশ কিছু কবিতা বিভিন্ন সময়ে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। কয়েকটা কবিতা পড়েছিলাম একদম গরম গরম, কবি লিখবার পরপরই। এবং এই কবিতাগুলো লেখা হয়েছে অনেক বছর ধরে। শূন্য দশকে বাংলাদেশী অনেক কবিই উত্তর-উপনিবেশী কবিতা লেখার চেষ্টা করেছেন। তবে ফয়েজ আলমের মত পাক্কা দশক ধরে উত্তর-উপনিবেশী প্রকল্প কবিতার চর্চা আর কেউ করেছেন কি না আমার সন্দেহ আছে। এই কবিতাগুলো তাই কবির বিউপনিবেশায়ন প্রকল্পের সাথে যুক্ত দীর্ঘ শ্রমের ফলাফল। বইটি যে অবশেষে বের হয়েছে সেটিও বড় একটা ঘটনা।
এই দীর্ঘ পথচলা যে কত কঠিন ছিলো তার ছাপ আছে কবিতাগুলোর মধ্যে। বিশেষ করে সবচাইতে স্বচ্ছভাবে তা ফুটে উঠেছে ‘উপনিবেশের দাগ’ নামক কবিতায়। কবি যখন লেখেন:
সে থাকে আমার সাথেই
আমার বুঝা বা না বুঝার আড়ালে
আমার জানার মধ্যে সে এক রংচোরা
ঘুরেঘারে, খায়দায় গোজামিলে ইতিহাস নাটক বানায় ।
তখন আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের কর্তসত্তার বিউপনিবেশায়ন কোন সহজ কাজ নয়। ব্যাপারটা লেখার ভাষার মধ্যে স্রেফ শব্দ, নন্দন আর স্টাইলের মধ্যে দেশি অরিজিনের খোঁজ করা না, তার চেয়ে জটিল ও বেশি কিছু। একজন সচেতন উত্তর-উপনিবেশী তাত্ত্বিক ও কবিও যে উপনিবেশী জ্ঞানকাণ্ডে গড়ে ওঠা আধুনিক কর্তা-সত্তার বিনির্মাণ করতে গেলে যে নিজেকেই হারিয়ে ফেলার মত পরিস্থিতিতে পড়তে হয় তা ফুটে উঠা এই কবিতার অন্য কিছু বাক্যে:
আমি আমারে লেখি
নিজের ছাপ চিন্ রাখি সামাজিক বয়ানে।
মাঝে মাঝে চমকে দেখি আনমনে তাহারেও লেইখা ফেলি
শেষে মুছি যেন জোর করে নিজেরেই মুছতেছি।
বহুজনমের দাগ তিরতির করে মোছার এই প্রক্রিয়া সহজ না।তাছাড়া এই দাগ আসলে কয় জনমের সে প্রশ্নও আমাদের মনে চলে আসে। কেবলই উপনিবেশী আমলের? নাকি আরো আগের যে দাগ আমরা বয়ে চলেছি কবি তার কথাও বলছেন? তাছাড়া কেবল উত্তর-উপনিবেশী প্রকল্পের মধ্যে এই কবিতাগুলোকে সঙ্কুচিত করার উপায় নেই।
ফয়েজ আলমের কবিতা যেসব কারণে আমার পছন্দ তার মধ্যে দার্শনিক ও রুহানি দিকগুলাও আছে। ‘উপনিবেশের দাগ’ কবিতায় আমরা যেমন দেখি তিনি পেছনে উপনিবেশী বড় কর্তার পায়ের আওয়াজ পান, তেমনি ‘মউত নিয়া গবেষণা’ কবিতায় আমরা দেখি তিনি পেছনে মওতের পাায়ের আওয়াজও পাচ্ছেন। এই মওত আবার বর্তমান বাংলাদেশের জনগণের জীবনকে মৃত্যুর সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া সার্বভৌম ক্ষমতার রূপেও হাজির হয়। এই বইয়ের বিভিন্ন কবিতায় তাই কবির বড় অপর কখনো উপনিবেশী কর্তা, কখনো মওত, কখনো রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম ক্ষমতা, আবার কখনো এখলাস ফকির বা নাম না-জানা মারফতি ফকিরের রূপে খোদ কবির মুর্শিদ। এই মুর্শিদই কবির দার্শনিক ও রুহানি বক্তব্যগুলো নিয়ে সবচেয়ে পরিষ্কার ভাষায় হাজির হন। ‘একদিনের সঙ্গী এক মারফতি ফকির’ কবিতায় ঘোষণা করেন:
এই যে দেখেন কত রংচঙা দুনিয়া
কে বুঝলো নাই কিবা আছে?
সে ত আমার রুহু আর আমার জবান।
…
আমার দেলের ভিতর আপনার জন্মমৃত্যু হাঁটা চলাফেরা
জাহের আমার মধ্যে, বাতেনও আমার।
ভাবচর্চা আর কবিতা একসাথে করা সহজ নয়। তত্ত্বেও প্রতিফলন কবিতায় ফেলতে গেলে নন্দন অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ফয়েজ আলমের কবিতার উপর এই দুর্বলতা আরোপের উপায় নাই। তার কবিতায় নান্দনিকতা আর উত্তর-উপনিবেশী তৎপরতা একদেহ ধারণ করেছে। এমন দাবী করাও ভুল হবে না যে তার নান্দনিকতাই তার উত্তর-উপনিবেশী তৎপরতাকে সফল করেছে।
আগেই বলেছি, সম্পুর্ণরূপে উপনিবেশী প্রভাবহীন কোন কাল্পনিক অরিজিন, ভাষা বা নান্দনিকতা তার কবিতাতে তিনি ধরার চেষ্টা করেন নাই। এ কারণেই তার কবিতা পড়ার সময় কখনো চর্যাপদের পদকর্তাদের, কখনো আমাদের গ্রামবাংলার বাউল ফকিরদের গানের সুর ও রূপকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, আবার কখনো বা একজন আধুনিক কবির কবিতা পাঠের অনুভূতি জাগতে পারে। সব মিলিয়ে ফয়েজ আলমের কবিতা একান্তই ফয়েজ আলমের। এর মধ্যে যে হাইব্রিডিটির দেখা আমরা পাই তাই কবির মৌলিকতা, হাইব্রিডিটিই তার শক্তি।
ফয়েজ আলমের কবিতা পাঠের আরেকটা বাস্তব লাভ আছে। এমন অনেক বাংলা শব্দ আছে যেগুলো আধুনিক সাহিত্যে ব্রাত্য ছিলো, এমনকি বর্তমান প্রমিত বাংলা বিরোধী ভাষা চর্চার সময়েও ব্রাত্য রয়ে গেছে। এসব শব্দকে আপনি দেশি শব্দ বা বিদেশী ভাষার বর্গে ফেলতে পারবেন না সহজে। কারণ কবি তেমন কোন বর্গকে তার শব্দের উৎস করেন নাই। কবি বরং উন্মুক্ত থেকেছেন মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি। নতুন কোন কাল্পনিক ও আদর্শ ভাষার বদলে একেবারেই মাটির কাছের যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন তার কবিতায়। বলা যায় এই কাব্যভাষা তিনি অর্জন করেছেন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা চাষ করে। বাংলা শব্দভান্ডারের ব্যাপারে যারা উন্মুক্ত থাকতে চান তাদের জন্য এই বইটি বিশেষভাবে উপকারী হবে।
‘জলছাপে লেখা’ বইটি নিঃসন্দেহে ফয়েজ আলমের এক দীর্ঘ সফরের ফসল। আমার বিশ্বাস পাঠকরাও বইয়ের কবিতাগুলো পড়ার সময় এই সফরের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাবেন। এই সফর নান্দনিক, রাজনৈতিক ও রুহানিয়াতের বিভিন্ন পর্দা অতিক্রমণের সফর। কখনো বা পাঠক নিজেকে আবিষ্কার করতে পারেন এমন এক গ্লোবাল ভিলেজের বাজারি হিসাবে যাকে ”ভব বাজার” নামে আমাদের গ্রামবাংলার কবিরা বোঝাপড়া ও মোকাবেলার চেষ্টা করছেন। সেই বাজারে ওয়াল্টার বেনিয়ামিন একজন ফ্লানিউরের মত বিপ্লবের কারবারি হিসাবে হাজির হওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। আর ফয়েজ আলম একুশ শতকের বিশ্ব বাজারে আমাদের হাজির করেছেন এমন এক সত্তা হিসাবে যার আর কোন নিশ্চিত পাড়ের কথা জানা নাই। মুর্শিদ তার একমাত্র ভরসা। আপাতত তার ’গ্লোবাল ভিলেজ’ কবিতার কয়টা চরণ দিয়ে লেখাটা শেষ করি:
এ হেন ভবের বাজারে মুর্শিদ তুমিই বুঝি একমাত্র ভরসা
এমন বেঘোর বিশ্ববাজারে ধরা পইড়া
এখন কোন পাড়ে ভিড়ার বাসনা আমি নিবেদন করি
তোমার চরণে ?
আমার তো নিশ্চিন্তা কোন পাড়ের কথাই জানা নাই।