এই পৃথিবীতে আমাদের যখন অস্তিত্ব রয়েছে, তার অর্থ আমাদের সবার একজন ‘মা’ আছেন। তবে মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার ক্ষেত্রে সবাই সৌভাগ্যবান নন। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায়, জন্মের সময় আমরা পিতা-মাতার কাছ থেকে সমান শতাংশ জিন পেয়ে থাকি। তারপরেও থাকে বংশের অন্য সদস্যদের অবদান। শিশু ‘ক্রিয়েটিভ ক্রোমোজোম’টি কোন আপনজনের কাছ থেকে বেশি শতাংশে পেয়ে থাকে, বলা কঠিন। যদিও শুধুমাত্র একজন মানুষের উপরে সব বিষয় নির্ভরশীল নয়, তারপরেও আমাদের জন্ম হয় মাতৃগর্ভে দীর্ঘ দশ মাস কাটানোর পর। সেক্ষেত্রে মায়ের সাথে আমাদের সম্পর্কের বন্ধন সব চাইতে মজবুত। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, শৈশবে শিক্ষার প্রথম দিনগুলোতে বিদ্যালয়ে শিক্ষা শুরুর আগে শিশুর জন্য মা তার প্রথম শিক্ষক। মা শিশুকে স্লেটে চকের প্রথম দাগটা দিতে শেখান বলে, শিশুর সৃজনশীলতায় মায়ের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই অবদানের সামগ্রিক চিত্রটি কেমন সেটা পরীক্ষণের দাবী রাখে। সবক্ষেত্রে সেটা কোনো ইতিবাচক উপসংহার নাও টানতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিল্পীদের জীবনে বিষয়টি সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে দেখা দেয় । মনোবিশ্লেষকদের মতে শিল্পী যখন শিশু তখন মায়ের অবহেলাই তাকে শিল্পকলায় আশ্রিত হতে বাধ্য করে। আবার বিরল কিছু ক্ষেত্রে শিল্পীরা শৈশব থেকেই মায়েদের অনুপ্রেরণা বা সহযোগিতা পান। আমাদের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন (১৯১৪-১৯৭৬) যেমন; তাঁর মা, তাঁর শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন পূরণের জন্য নিজের গহনা বিক্রি করেছিলেন। এই ধরনের অবদান আমাদের সমাজে যৎকিঞ্চিত বলেই জয়নুলরাও ক্ষণজন্মা।
শিল্পীদের আঁকা তাদের মায়েদের প্রতিকৃতি বা চিত্রকলার কথা বললে, প্রথমেই মনে আসে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পী হুইসলারের (১৮৩৪-১৯০৩) মায়ের চিত্রকর্মটির কথা। ‘অ্যারেঞ্জমেন্ট ইন গ্রে অ্যান্ড ব্লাক নং ১’ শিরোনামে ক্যানভাসে তৈলচিত্রে তিনি এটি নির্মাণ করলেও শিল্পপ্রেমিকদের কাছে শিল্পীর মায়ের প্রতিকৃতি হিসেবেই বেশী পরিচিত। চিত্রকর্মটি ভিঞ্চির ‘মোনা লিসা’ কিংবা ভারমিয়েরের ‘গার্ল ইন দ্য পার্ল ইয়ার রিং’র মতোই বিখ্যাত। চিত্রটিতে আমরা দেখি একজন বৃদ্ধা কালো লম্বা গাউন পরে চেয়ারে বসে আছেন। একপাশ থেকে তাকে দেখা যাচ্ছে, মাথায় পেঁচানো লেসের স্কার্ফ, হাতের মুঠোয় একটি সাদা রুমাল ধরা । দেয়ালে ঝুলছে একটি ছবির ফ্রেম, অপূর্ব কারুকার্য করা ঝুলন্ত পর্দা ঘরের মেঝে স্পর্শ করে আছে। লেসের কাজে সূক্ষ্ম নিপুনতা থাকা সত্ত্বেও একটি অদ্ভুত চাপা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে আছে যেনো। কালো এবং ছাই রঙে আঁকা বলে, চিত্রটি দেখলে বিষণ্ণ মনে হয়। হুইসলারের সীমিত রঙে আঁকার নিজস্ব ভঙ্গি, চিত্রটিকে দিয়েছে ভিন্ন একটি মাত্রা। অভিজ্ঞতা, ধৈর্য্য, প্রজ্ঞা, সমস্ত কিছুর সংমিশ্রণে মায়া ভরা এক আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে শিল্পীর মায়ের অবয়ব থেকে। আত্মীয়-স্বজনরা বলেছেন শিল্পীর মায়ের বসার ভঙ্গিটি বাস্তবসম্মত হয়েছে। অ্যানা স্বামী হারানোর পর শোকের চিহ্ন হিসেবে আজীবন কালো পোশাক পরতেন।
মায়ের সাথে হুইসলারের ছিলো খুব সহজ-সরল, মধুর সম্পর্ক। তিনি পুত্রকে শিল্পচর্চায় সহযোগিতা করতেন, স্টুডিওতে অতিথিদের আপ্যায়ন করতেন, সহকারী হিসেবে কাজ করতেন এবং কাজে উৎসাহ দিতেন। হুইসলারের আঁকা তাঁর চিত্রকর্মটি নিয়ে খুব গর্বিত ছিলেন এবং সেই সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় নিজের অবদানের জন্যও তিনি গর্বিত ছিলেন। শিল্পীদের মায়েদের আইকনিক চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে হুইসলারের এই চিত্রকর্মটি শিল্পরসিকদের কাছে অন্যতম। শিল্পী অনুযোগের সুরে একবার বলেছিলেন - ‘হ্যাঁ, একজন শিল্পী তাঁর মাকে যথাসম্ভব সুন্দর করে আঁকার চেষ্টা করবে’। চিত্রটির সমাপ্তিতে শিল্পী আত্মতৃপ্তিতে বলেছিলেন,- ‘মা গো! এটা সুন্দর’!
তবে সব শিল্পীদের জীবনে হুইসলারের মতো মা ছিলো না। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির (১৪৫২-১৫১৯) জন্ম হয়েছিলো কুমারী মায়ের গর্ভে। জন্মের পর ভিঞ্চির মাত্র পাঁচ বছর পর্যন্ত মায়ের স্নেহ তলে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিলো। ভিঞ্চি ছিলেন তাঁর বাবা-মায়ের গভীর ভালোবাসার ফসল। তারপরেও ভিঞ্চির বাবা, ভিঞ্চির মা ক্যাটেরিনার সামাজিক অবস্থানের কারণে, তাদের সম্পর্ককে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেননি। কিন্তু ভিঞ্চি ও ক্যাটেরিনাকে আজীবন সহযোগিতা করেছিলেন, পুত্রের সৃজনশীতার চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ক্যাটেরিনা ছাড়াও ভিঞ্চির লালন-পালনে সৎমা আলবিয়েরা এবং ভিঞ্চির দাদীর অবদান ছিলো।
ভিঞ্চি নোটবুকে ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু না লিখলেও, ইতিহাসবিদদের মতে ভিঞ্চির মায়েরা ছিলেন মমতাময়ী। হয়তো সামাজিক বাধা-বিপত্তির কারণে নিজের মনের কথা সরাসরি লিখতে পারেননি। ভিঞ্চির মা তাঁর জীবনের শেষ সময়টিতে প্রিয় সন্তানের কাছে এসেছিলেন এবং তিনি মায়ের শেষকৃত্যের ব্যবস্থাও করেছিলেন। বিভিন্ন ছবি বা গল্পের মাধ্যমে ভিঞ্চি মানবজীবন এবং প্রকৃতির রহস্যের প্রতি গভীর আগ্রহ প্রকাশ করে গেছেন, ভালোবাসা ও সৃষ্টিকে মূল্যায়ন করেছেন। তিনিই প্রথম মাতৃগর্ভে শিশুর অবস্থানের চিত্র অঙ্কণ করেছেন এবং মা ও শিশুর চিত্র নির্মাণ করেছেন বহুবার। মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের (১৮৫৬-১৯৩৯) ধারণা ভিঞ্চি তাঁর মায়ের কথা মনে রেখেই মোনা লিসার হাসিটা এঁকেছেন। তাই মোনা লিসার হাসিতে একই সাথে মমতা ঝরে পড়ে এবং অশুভ কোনো শাসনেরও ইঙ্গিত মেলে। তিনি এও ধারণা করেন; লিওনার্দো তাঁর মায়েদের কথা ভেবেই এঁকেছেন ‘ভার্জিন এবং এ্যন্ড চাইল্ড উইথ সেইন্ট অ্যান’- যে চিত্রে দুইজন নারীর সাথে একটি শিশু ও একটি মেষ শাবককে দেখা যায়।
আধুনিক কালের শিল্পী পাবলো পিকাসো (১৮৮১-১৯৭৩) মায়ের পদবি নিয়েছিলেন। পিকাসোর মায়ের সেই বিখ্যাত উক্তি আমরা জানতে পারি ইতিহাসবিদদের বই থেকে - ‘তুমি সৈনিক হলে, জেনারেল হবে আর তুমি যদি পাদ্রী হও তবে হবে পোপ’। কিন্তু পিকাসো হয়েছেন শিল্পী। কারণ সেই সময়, সমাজে শিল্পীদের বিশেষ কদর ছিলো। ঠিক মানুষদের মধ্যে, ঠিক সময়ে, ঠিক স্থানে জন্মগ্রহণ করলে যে জীবনে সফল হওয়া সম্ভব, তার উদাহরণ পিকাসো। শিল্পী তাঁর মায়ের প্রতিকৃতি এঁকেছেন, যদিও তাঁর মা সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে পিকাসোর বাবা ছিলেন চিত্রকলার শিক্ষক। ধারণা করা হয় পিকাসো বাবার নিকট থেকে শৈশবে শিল্পকলা শিক্ষায় হাতেখড়ি পান। পিকাসো জীবনে নারীদের কাছ থেকে অসীম সহযোগিতা পেয়েছেন। যদিও নারীদের প্রতি তাঁর আচরণ ছিলো অত্যন্ত নিষ্ঠুর। তাঁর চিত্রকলার প্রধান বিষয়বস্তু ‘নারী ’ হলেও ‘মা ও শিশু’ বিষয়েও তিনি শিল্পকলা নির্মাণ করেছেন।
অনেক নারী বা পুরুষ শিল্পী তাদের শিল্পচর্চার কোনো বিশেষ সময়ে ‘মা ও শিশু’ বিষয়বস্তুকে স্থান দিয়েছেন গুরুত্বের সাথে। শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গো’র (১৮৫৩-১৮৯০) চিত্রকলায় দেখা যায় ‘মা ও শিশু’ কিংবা ‘দম্পতি এবং শিশু’। যা ‘স্ত্রী-শিশু-সংসারের’ প্রতি তাঁর ভালোবাসা ইঙ্গিত করে। তিনি আলোকচিত্র দেখে মায়ের প্রতিকৃতিও এঁকেছেন। সাদাকালো অলোকচিত্রটিকে তাঁর খুব বিবর্ণ মনে হতো, নিজের মনের রঙে আঁকলেন মাকে, যেমনটি দেখতে চান, মাকে যেমন দেখতেন স্মৃতিতে। তবে ভ্যান গো’র সাথে তাঁর মায়ের সম্পর্ক ছিলো বেশ জটিল। তাঁরা তিন ভাই, খুব অকালে মৃত্যুবরণ করলেও তাদের মা ছিলেন দীর্ঘজীবি। অ্যানা পুত্রদের প্রতি উদাসীন ছিলেন। তিনি সবসময় চিন্তিত থাকতেন পরিবারের মান-সম্মান নিয়ে এবং তাঁর মতে ভিনসেন্ট পরিবারের সম্মান ক্ষুন্ন করবার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রেখেছিলো। পুত্রের শিল্পচর্চাকে তিনি কোনোদিনও উৎসাহিত করেননি। শিল্পী মনে আজীবন গভীর দুঃখ বয়ে বেড়িয়েছেন, যে তাঁর মা তাঁর শিল্পকলাকে প্রশংসা করেননি। শিল্পীর মা নিজেও কারুশিল্পে দক্ষ ছিলেন, সন্তানদেরকে শৈশবে আঁকতে শিখিয়েছিলেন। মনে করতেন ভিনসেন্টেরও কারুশিল্পের চর্চা করা উচিৎ, অর্থনৈতিকভাবে সফল হবে। ভিনসেন্ট নিজের সাফল্য দেখে যেতে না পারলেও তাঁর মা দেখে গিয়েছিলেন। যদিও এটা তাঁর কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলোনা। ভিনসেন্ট রমণীর ভালোবাসা এবং মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হলেও একজন নারী তাঁর শিল্পকলাকে সারা বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। থিও ভ্যান গো’র স্ত্রী ‘ইয়োহানা’। তিনিই শেষ পর্যন্ত ভিনসেন্টের মায়ের ভূমিকা পালন করেন। যদিও ভিনসেন্টের মা বেঁচে ছিলেন পুত্রের প্রথম একক প্রদশর্নীর সময়, কিন্তু তেমন উৎসাহ বোধ করেননি। এমনকি ভিনসেন্টের অনেক চিত্রকর্ম ফেলে দিয়েছিলেন তাঁর জীবদ্দশায়। শিল্পী সারাজীবন এই রহস্য উদ্ধার করতে পারেননি, একজন সজ্জন হওয়া সত্ত্বেও মা তাঁকে কেনো ভালোবাসতে পারেনি।
ভাস্কর কামিল ক্লদেল (১৮৬৪-১৯৪৩) ছিলেন অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান। তাঁর জন্মের এক বছর আগে তাঁর মা শিশুপুত্রকে হারিয়েছিলেন বলে তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন পরবর্তীতেও পুত্রসন্তান হবে। কিন্তু কামিলের জন্ম হওয়াতে, মা হতাশ ছিলেন। কামিল নামটা ছেলে বা মেয়ে উভয়েরই হতে পারে, মা এমন নাম রেখেছিলেন যেন সন্তানের লৈঙ্গিক পরিচয়টা অস্পষ্ট থাকে। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তিনি কামিলকে কোনোদনিও ভালোবাসতে পারেননি। কামিলের সৃষ্টিশীলতায় অনুপ্রেরণা দেননি বরং বাধা দিয়েছেন। শুধু বাধা দিয়েই ক্ষান্ত হননি, কামিলের পিতার মৃত্যুর পরপরই কামিলকে জোরপূর্বক মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন বাকি জীবনের জন্য। কামিলের সাথে অবশ্য বাবার সম্পর্ক ছিলো মায়ের থেকে ভিন্ন। কামিলের বাবা কন্যাকে নিঃস্বার্থ ভালোবেসে ছিলেন এবং যতদিন বেঁচে ছিলেন তিনি ততদিন কন্যার শিল্পচর্চায় সহযোগিতা করেছিলেন ।
কামিলকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর সেই নিষ্ঠুরতায় ছোটো ভাই পলও মাকে সহযোগিতা করেছিলো, যাকে শৈশবে নিজের সন্তানের মত লালন-পালন করেছিলেন। কামিল এবং শিল্পী রদ্যাঁর মধ্যে গভীর প্রণয়ের সম্পর্ক ছিলো। বেশ কয়েকবার কামিল গর্ভপাত ঘটিয়েছিলেন এবং মা হবার স্বপ্নও তাই পূরণ হয়নি। কামিল দীর্ঘ তিরিশ বছর মানসিক হাসপাতালের হীম-শীতল পাথরের দেয়ালের মধ্যে একাকী জীবন কাটিয়ে অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর কাজে নারী পুরুষের প্রেম ও মাতৃত্বের তৃষ্ণা প্রকাশ পেয়েছে স্বতঃস্ফুর্তভাবে।
কামিলের মতোই ফ্রিদা কাহলোর সাথে তাঁর মায়ের সম্পর্কও খুব একটা মসৃণ ছিলো না। মা ছিলেন ধার্মিক, গোড়া এবং প্রথাবদ্ধ মানুষ। বাবার সাথেই মূলত ফ্রিদার সখ্যতা, তবে মা-বাবা দু’জনই ফ্রিদার শিল্পচর্চায় সহযোগিতা করেছিলেন। মা তাকে শিশু অবস্থায় স্তন্যপান করাননি বলে দু’জনের মধ্যে হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি বলে ফ্রিদা মনে করতেন এবং তিনি এই বিষয়ে চিত্রও নির্মাণ করেছেন। ফ্রিদা নিজেও মা হবার চেষ্টায় সন্তান হারিয়েছেন বহুবার এবং সেই অভিজ্ঞতাগুলোকে শিল্পকলায় স্থান দিয়েছেন। তবে ফ্রিদা যখনই স্বামী দিয়েগোর সাথে বাড়ীর বাইরে থাকতেন মায়ের সাথে পত্রে যোগাযোগ হতো। স্বামী শিল্পী দিয়েগোও ফ্রিদাকে তাঁর শিল্পচর্চায় সহযোগিতা করেছিলেন। ফ্রিদার শারীরিক বিপর্যয় অবশ্যই ফ্রিদার মার জন্য কষ্টদায়ক ছিলো।
আধুনিক শিল্পী মারিনা আব্রামোভিচের (৩০ নভেম্বর ১৯৪৬) মাও ছিলেন খুব কঠোর প্রকৃতির। তিনি মারিনার সৃজনশীলতাকে আজীবন সহযোগিতা করে গেছেন এবং মূল্যায়ন করেছেন। তবে তিনিও ভিনসেন্টের মায়ের মতো চাইতেন মারিনা প্রথাগত শিল্পী হবেন। মা ছিলেন জাতীয় বীর; সাহসী নারী, পাথর কঠিন ব্যক্তিত্ব এবং হৃদয়ে কঠোর। মায়ের আগল ভেঙ্গে মারিনা আজ পৃথিবী বিখ্যাত শিল্পী। মারিনার সঙ্গে তাঁর মায়ের জটিল একটি সম্পর্ক ছিলো। মারিনার মায়ের আবেগ, অনুভূতি কম থাকলেও মেয়ের শিল্পচর্চায় তিনি সহযোগিতা করেছেন শৈশব থেকেই। যদিও তিনি শিল্পকলা বলতে যা বুঝতেন মারিনা সর্ম্পূণ ভিন্নভাবে দেখেছেন। তবে দিনের শেষে মারিনার মা কন্যার সফলতায় ছিলেন গর্বিত। মারিনার সংবাদপত্রের রিভিউগুলো এ্যালবাম করে রাখতেন এবং প্রতিবেশীদের দেখাতেন। একজন মানুষ যখন সফলতার আনন্দ আপনজনদের সাথে ভাগ করে নিতে পারেন তখন সফলতাটা অর্থবহ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে পিতামাতার সাথে, আরো বিশেষভাবে বললে জন্মদাত্রী মায়ের সাথে, যে কিনা আমাদের সকলের প্রথম গুরু। মারিনাও পিতা-মাতাকে বিষয়বস্তু করে শিল্পকলা নির্মাণ করেছেন তবে মাধ্যমটি ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন; কারণ তিনি একজন পারফর্মিং আর্টিস্ট। পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে- ‘বলকান বারোক’ সৃষ্টি করেছেন অনবদ্য শিল্পকর্ম, যা তাঁকে ১৯৯৭ সালে ভেনিস বিয়েনালে ‘গোল্ডেন লায়ন’ এওয়ার্ড এনে দেয়। মারিনার শিল্পচর্চায় পিতা-মাতার অনুপস্থিতির শূন্যতাগুলোর প্রভাব লক্ষণীয়। মারিনাও কয়েকবার গর্ভপাত ঘটিয়েছেন এবং তিনি মাতৃত্বের স্বাদ পেতে চেয়েছেন তাঁর শিল্পীসত্তার মধ্য দিয়ে, রক্ত মাংসের শিশুর জন্ম দিয়ে নয়।
শিল্পী ইগোন সিলাহ্ ( ১৮৯০-১৯১৮) তাঁর নাতিদীর্ঘ জীবনে অনেক ‘মা ও শিশু’র চিত্রকলা নির্মাণ করে গেছেন। মায়ের সাথে তাঁর সম্পর্কও জটিল ছিলো। মা তাঁকে শিলচর্চাতে সহযোগিতা করলেও আবেগ শূন্যভাবে করেছিলেন এবং শুধুমাত্র দায়িত্ব পালন করেছিলেন। স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীতে স্ত্রী এদিথ ও তাঁর গর্ভে তাদের সন্তানকে হারান। এদিথের মৃত্যুর ঠিক তিনদিন পরে ইগোনেরও মৃত্যু হয়; এই তিনদিনের মধ্যে ভালোবাসার মানুষটির অসংখ্য চিত্র নির্মাণ করে গেছেন। উপমাহদেশের শিল্পী অমৃতা শের-গিলের (১৯১৩-১৯৪১) মা উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনে বেশ পারদর্শী ছিলেন, কন্যার সাথেও জটিল সম্পর্ক ছিল। কন্যাও মায়ের মতো উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করতেন, তবে সৃষ্টিশীলতার গুণ পিতা-মাতা দুজনের রক্ত থেকেই এসেছে তাঁর শরীরে। তাদের সহযোগিতা অবশ্য থেমে থাকেনি তাঁর সৃজনশীলতার চর্চায়। ইগোনের মতো অমৃতাও খুব অল্প বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। অন্যদিকে শিল্পী এডভার্ড মুঙ্ক (১৮৬৩-১৯৪৪) পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারান, এরপরে বড় বোনকে। যাদের দুজনকেই তিনি খুব ভালোবাসতেন এবং তাদের মৃত্যু তাঁর শিল্পকলাকে চিরতরে প্রভাবিত করে।
ভাস্কর লুই বর্জুয়ার (১৯১১-২০১০) সাথে তাঁর মায়ের সুন্দর স্বাভাবিক ‘মাতা-কন্যা’ সম্পর্ক ছিলো । কিন্তু তাঁর মাও স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে, সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হতে পারেননি। সেই সময় লুইয়ের বাবা বাড়ীতে একজন শিক্ষিকা নিয়োগ করেন সন্তানদের শিক্ষা দেবার জন্য । কিছুদিনের মধ্যে তাদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। লুইয়ের উপর যার প্রভাব পড়ে, পারিবারিক নাটকীয় যন্ত্রণাগুলোকে শিল্পসৃষ্টির বিষয়বস্তু করেন। তাঁর মা ছিলেন নিতান্ত সাধাসিধে, স্নেহময়ী এবং ধীরস্থির একজন মানুষ। তিনি ছিলেন তাঁত শিল্পী, পারিবারিক তাঁত ব্যবসাও পরিচালনা করতেন। মা ছিলেন লুইয়ের নিকটতম বন্ধু, তিনি মায়ের মৃত্যুর পর আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। বাবার মৃত্যুও লুইয়ের উপরে ভীষণ প্রভাব ফেলে। লুই নিজেও একসময় তিন পুত্রের মা হন। তাঁর বিখ্যাত মাকড়সার ভাস্কর্য ‘মামঁ’ মাতৃত্বের প্রতীক হয়ে দাড়িয়ে থাকে পৃথিবীর বিখ্যাত সংগ্রহশালাগুলোর সামনে । মাকড়সা যেমন নিজের ডিমকে রক্ষা করে, আগলে রাখে, লুইয়ের মাও তাকে এবং তাঁর ভাইবোনকে আগলে রাখতেন।
শিল্পী মদিগ্লিয়ানির (১৮৮২-১৯২০) মা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চিত্র আমাদের উপহার দেন। যে মা আমাদের সবার কাম্য। শিল্পীদের আরাধ্যের বিষয় হতে পারে। যেমন মা পেলে অনেক শিল্পীই তাদের শিল্পচর্চাতে পাবে অদম্য উৎসাহ। শিল্পী মদিগ্লিয়ানিরও নাতিদীর্ঘ জীবন। শৈশব থেকেই তিনি রুগ্ন, শারীরিকভাবে দুর্বল ছিলেন। মদিগ্লিয়ানির মা পুত্রের প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল ছিলেন। তিনি পুত্রের শিক্ষাদানের কাজটি ঘরেই শুরু করেন এবং খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করতেন। কোন ক্ষেত্রে মদিগ্লিয়ানির প্রতিভা লুকিয়ে আছে বোঝার চেষ্টা করতেন এবং দিনলিপিতে লিখে রাখতেন। অবশেষে মদিগ্লিয়ানির কৈশোরেই তাঁর শিল্পপ্রতিভাকে আবিষ্কার করেছিলেন, অনুপ্রেরণা দিতে সংগ্রহশালাগুলোতে শিল্পীদের কাজ দেখাতে নিয়ে যেতেন। ছেলেকে ভবিষ্যতের শিল্পী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুত করে তুলেছিলেন। নারীর ভালোবাসা পাবার দিক থেকে মদিগ্লিয়ানি ভাগ্যবান বলা যায়। স্ত্রীও তাঁকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন, একটি কন্যা-সন্তান উপহার দিয়েছিলো এবং আরেকটি সন্তানকে গর্ভে নিয়েই আত্মহত্যা করেছিলো মদিগ্লিয়ানির মৃত্যূর পরপরই।
কবি খলিল জিবরান (১৮৮৩-১৯৩১), ‘সন্তান’ কবিতায় মায়ের সাথে সন্তানের প্রাকৃতিক ও আধ্যত্মিক সম্পর্কের কথা বলেছেন –
” তোমার সন্তান তোমার নয়,
তারা হলো পুত্র এবং কন্যা, জীবন যাদের প্রত্যাশা করেছিলো
তারা তোমার মাধ্যমে আসে, কিন্তু তোমাদের থেকে নয়-
যদিও তারা তোমারই সাথে থাকে কিন্তু তুমি তাদের অধিকার করো না”
উপরে উল্লেখিত শিল্পীদের মতো অনেকেই মায়ের ভালোবাসা ও প্রশংসা পাবার জন্য আজীবন ব্যাকুল ছিলেন। মানুষ মাত্রেই মায়ের সাথে নাড়ীর সম্পর্ক। মায়ের প্রতি টান অনুভব করা বা মায়ের থেকে দূরে যাবার অদম্য ইচ্ছা, দুটোই মাকে কেন্দ্র করেই ঘটে। মা হচ্ছে মানবজীবনের কেন্দ্র বিন্দু, যাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় জীবন। মাতৃস্নেহহীনতা শিল্পীদের জীবনে যে শূন্যতার সৃষ্টি করে, সেই শূন্যতা পূরণের জন্য শিল্পীরা ক্রমাগতভাবে শিল্পকলা সৃষ্টি করে চলেন। মাতৃস্নেহ বঞ্চিত বা মাতৃস্নেহ সিক্ত সব শিল্পীই নিজে একদিন সৃষ্টিকর্তা বা ‘মা’ হয়ে ওঠেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁরা এক শিশু হয়ে বাঁচেন, যে শিশু শিল্পকলার ছায়াতলে মায়ের স্নেহময় আশ্রয় খোঁজে। ভিনসেন্ট তার একটি চিঠিতে এই অপূর্ণতাটিকে প্রকাশ করে ভাই থিওকে আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘আমি ঈর্ষার সাথে তোমার কথা ভাবি, তুমি এমন কেউ, যার মা তাকে সান্ত্বনা দেয়, এবং যে তার মায়ের সান্ত্বনা পাওয়া যোগ্য।'