নরম আলো জ্বলে ওঠে পকেটের ভেতর। একবার কেঁপে তারপর থেমে যায়। আলোটা দেখা না গেলেও কাঁপুনিটা টের পাওয়া যায়। ট্রাউজারের পকেটে হাত চলে যায় অজান্তেই।
কিং বাজারে বাজার করুন ঘরে বসে। Use Code: RojkarBazaar123 & get 5% off. Additional 10% cash back on bKash payment! Hurry! Shop now! অনলাইনে অর্ডার করতে ক্লিক করুন... ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে মেসেজ। একবার চোখ বুলিয়ে ডিলিট করে মামুন। ট্রাউজারের পকেটে ফের মোবাইল ফোন রেখে মূল রাস্তা থেকে ডানের গলিতে নেমে যায়।
গলির ডান দিকে আলো ঝলমল, এসির ঠান্ডা হাওয়া ছড়ানো কিং বাজার সুপার শপ। বাঁ দিকে কৃষিপণ্যের পাইকারি বাজার। চাল, আলু, আদা, রসুন আর পেঁয়াজের আড়ত। রাজ্যের পেঁয়াজ রসুনের খোসায় কালো পিচের পথটা গোলাপি। খুব মনোযোগ দিয়ে তাকালে দু-একটা শুকনা মরিচের লাল ঝিলিক দেয় গোলাপির আড়ালে। এখানে সারা বছর বাতাসে গুমোট ঝাঁঝালো গন্ধ ভাসে। পাইকারি মার্কেটে পা দিলেই মামুনের মস্তিষ্ক এই গন্ধের তীব্রতা অনুভব করে।
একদিকে সারি সারি লাগোয়া দোকান। সব কটি দোকান একই রকম দেখতে। ছোট ছোট দোকানের মেঝে থেকে প্রায় ছাদ পর্যন্ত চালের বস্তা। মাঝখানে একজন মানুষের হাঁটার মতো জায়গা। দোকানের ভেতর এক কোণে প্লাস্টিকের টেবিল আর চেয়ার। সেখানে মহাজন বসে আছে। দোকানের সামনে লাগোয়া রাস্তায় একটার ওপর আরেকটা পেঁয়াজ-রসুনের বস্তা রাখা। একেক বস্তা ৫০ থেকে ৬০ কেজি ওজনের। আলু আর আদার বস্তার মুখ খোলা। সোজা দাঁড়িয়ে মাথা উঁচিয়ে যেন আকাশ দেখছে।
এই পাইকারি দোকানগুলোর মুখোমুখি চালের আড়ত। ভেতরে ঢুকলে শুধুই চালের এজেন্সি। ৫০ কেজির নিচে সেখানে বেচাবিক্রি নেই। তাই ওদিকে আর যায় না মামুন। মেসার্স মুন্সীগঞ্জ বাণিজ্যালয়ের সামনে দাঁড়ায়। চাল কিনবে সে। ভেতরে বিরস মুখে মহাজন বসে আছে। দোকানের মলিনতা আর গুমোটভাব তার চোখেমুখে লেপ্টে ক্লান্তিভাব বাড়িয়ে তোলে। ফ্যানের নিচে চৈত্রের ভাপানো হাওয়া ঘুরপাক খায়। বাইরে মালবোঝাই বস্তাগুলোর পাশে ডিজিটাল পাল্লা রাখা। ১০ কেজি নাজিরশাইল চালের সাথে ৫ কেজি করে আলু পেঁয়াজ মেপে দেয় দোকানের লোক। এখানে দরাদরি চলে না। দাম মিটিয়ে তিনটি বস্তা দোকানে রেখে বেরিয়ে আসে মামুন। এখন সে বাজার করবে। একটু এগিয়ে গেলেই কাঁচাবাজার। ফেরার পথে চাল, আলু আর পেঁয়াজের বস্তা নিয়ে যাবে।
চালের আড়ত পেরিয়ে বাজারের শেষ মাথায় পাইকারি মুদিদোকান। সেখানেও বাতাসে ভ্যাপসা ঝাঁঝালো গন্ধটা ভাসে। শুধু ঝাঁঝটা কম ঠেকে। রাস্তার ওপরই সবজির ডালা নিয়ে বসে আছে খুচরা সবজি বিক্রেতা। আঁটিপাড়া থেকে পাইকারি দরে সবজি কিনে এনে আগেই দোকান সাজিয়ে বসেছে। বাতাসে ফুরফুর করে কাঁপে ডাঁটা শাকের কচি পাতা। বোঁটাভাঙা কষে আঠালো হয়ে চিকচিক করে কাঁচা আমের গা। শীতের শেষে টাটকা করলা, পটোল, ধুঁধুল, সজনের সবুজাভায় চারপাশটা অদ্ভুত সতেজ। কচুর লতি, ডাঁটা, পাটশাক উঠে যায় ক্রেতাদের বাজারের ব্যাগে। টাকা শার্টের পকেটে টাকা পুরে সামান্য এলোমেলো সবজিগুলো বিন্যস্ত করে সবজিওয়ালা। অভ্যস্ত হাতে পানি ছিটিয়ে দেয়। সবজি না কিনে মাছবাজারের দিকে চলে যায় মামুন। চালের বস্তা আর মাছের সাথে সবজি নেওয়াটা ঝামেলা।
পাকা বেল সাজিয়ে বসে আছে একটা ছেলে। মুখটা শুকনো। তেমন মায়াকাড়া চেহারা না। রুখাশুখা। একটু যেন ঘুমঘুম চোখ। ছেলেটা হয়তো সকালে কিছু খায়নি। হতে পারে শরীর ভালো না। এখানেই বসে সব সময়। একেক ঋতুতে টুকরির ফলগুলো বদলে যায়। স্বল্প পুঁজিতে যেটুকু তার পক্ষে সম্ভব। কখনো নেতানো স্ট্রবেরি, কখনো দাগ ধরা সফেদা, জাম্বুরা, আমড়া, পেয়ারা। ছেলেটার কাছ থেকে সস্তায় কেনা যায়। বেলের দাম জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে যায় মামুন। পাহাড়ি বেল কিনেছে রুহিনা। ‘পাহাড় থেকে’ অনলাইন স্টোরে অর্ডার দেওয়ার এক দিনের মধ্যেই বেল চলে এসেছে। এত বেল খাবে কে? অপচয় করার পক্ষপাতী নয় সে।
মামুন নিজেও অর্গানিক অনলাইন স্টোর ‘ফ্রেশবাংলা’ থেকে মাঝে মাঝে বাজার করে। তাই সে জানে অনলাইন বাজার থেকে কিছু কেনা আর বাজারে গিয়ে বেছে বেছে মনমতো শাকসবজি তুলে নেওয়ার মধ্যে তুলনা চলে না। একটা করিয়ে নেওয়া, আরেকটা করা। দেখে বেছে সবজি কিনে নেওয়ায় নিজের একটা ইচ্ছে মিশে থাকে। কী দিয়ে কী খাওয়া যায় এমন পারমুটেশান-কম্বিনেশান চলে মাথার ভেতর। পরিচিত শব্দ আর গন্ধে ভর দিয়ে ছোটবেলাটা সময়ের সাঁকো বেয়ে ফিরে আসে।
মাছ কিনে ঘেমে নেয়ে বাড়িতে ফেরে মামুন। সাথে তিন বস্তা। পরীক্ষার খাতা দেখছিল রুহিনা। ওর ঠোঁট আর গালের মাঝখানে লাল কালির দাগ। মামুনকে দেখে খাতাপত্র তুলে রাখে সে। বেলের শরবতের গ্লাস এগিয়ে দেয়। এক চুমুক দিয়েই বেলওয়ালা ছেলেটার শুকিয়ে আসা মুখটা মন পড়ে মামুনের। সেই উদাস রুখাশুখা চেহারা।
— ভালো লাগছে না?
— হুঁ।
— যেমন স্বাদ, তেমন গন্ধ! বুনো বেল তো!
— হুঁ।
— একদম ফ্রেশ। সে জন্যই এতো স্বাদ। হিট দিয়ে পাকানো বেলে এমন স্বাদ থাকে না।
— ভেঙে যদি দেখো ভেতরটা নষ্ট? সেটা তো আর ওপর থেকে বোঝা যায় না!
— ছবি তুলে পাঠিয়ে দিলে রিপ্লেস করে দেবে। নো চিন্তা!
পাকা বেলের গন্ধে ম ম করছে ঘর। বাকি দুচুমুকে শরবত শেষ করে ফেলে মামুন। গরমে বেশ আরামদায়ক। রুহিনার ‘পাহাড় থেকে’ যতই আস্থা, বিশ্বাস আর নির্ভাবনার প্রতীক হয়ে উঠুক না কেনো, বেলওয়ালা ছেলেটার কথা ভুলতে পারে না মামুন। রুহিনার কষ্ট অন্যখানে। এত ভালো বেল! ছেলেটা একবার শরবতে চুমুক দিয়েও দেখল না। বেলের গন্ধ সহ্য করতে পারে না দীপ্ত। ছেলের রুচির সাথে তাল পায় না রুহিনা। খালি গ্লাস হাতে নিয়ে গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে যায়।
জমে উঠেছিল মাছবাজার। বেচাবিক্রি ইদানীং মোবাইল ফোনেই হয়ে যায়। তবু এখানে দারুণ ডাকাডাকি চলে। দেদার জমে ওঠে দরাদরি। মাছ নিয়ে অবশ্য ঘরজুড়ে মাতামাতির সুযোগ নেই। সেই কবে বাবা মাছ আনলে কাটা-বাছার ধুম পড়ে যেত। ডানোর কৌটায় মা ছাই কিনে রাখত। ছিটকে পড়ত মাছের আঁশ। একেকটা রুপালি পয়সা যেন। বঁটির ধারালো ফলা বেয়ে গড়িয়ে পড়ত রক্ত। আঁশটে গন্ধটা খারাপ লাগত না। ধৈর্য ধরে মায়ের পাশে বসে মাছকাটা দেখত মামুন। সমান গতিতে একের পর এক ছোট মাছের পেট পটকা যেভাবে আলাদা করে ফেলত মা, সে এক ছন্দোবদ্ধ হাতের দোলা।
অথচ দীপ্ত মাছ তেমন চেনেই না। প্রায়ই অনলাইনে মাছ কিনে ফেলে রুহিনা। সব সময় না কিনলেও ব্যস্ততার সময়ে ভরসার নাম ‘নদী থেকে নগরে’। তরতাজা কেমিক্যালমুক্ত সব ধরনের মাছের অনলাইন বিক্রেতা। সেখানে দেশি মাছের মহা উৎসব হয়। ফোনে, ওয়েবসাইটে বা ইনবক্সে অর্ডার করলেই চাহিদা অনুযায়ী মাছ ‘রেডি টু কুক’ করে পৌঁছে দেয় দোরগোড়ায়। রুহিনার মূল্যবান সময় আর শক্তি বেঁচে যায়। মামুন ইতস্তত করছিল একসময়। রুহিনা বলেছিল— কাটা-বাছার ঝামেলা নেই। যত্নের সাথে প্রসেসড। হালাল আর জীবাণুমুক্ত। কেন কিনব না বলো তো?
মাছবাজারে দাঁড়িয়ে মানুষের ভিড় দেখে মামুন। হট্টগোল শুনেই কিনা মৃগেল, মহাশোল খলবলিয়ে ওঠে খাড়িতে। জ্যান্ত টাকি, খলসে, চাষের ট্যাংড়া চিড়িক বিড়িক করে নড়ে ওঠে। ছোট ছোট বরফের টুকরো লেগে থাকে টাটকিনি, পাবদার হিম শরীরে। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে মাছ দেখে মামুন। বাঁশের ডালার ওপর পলিথিন বিছানো। পলিথিনের ওপর অল্প পানিতে পিছল গা মোচড়ায় শিঙের ঝাঁক। নড়ে উঠতেই লেজের বাড়িতে পানি ছিটকে এসে বাঁ হাতের ঘড়ির ডায়ালের কাচে আটকে থাকে। একমুহূর্ত মামুন ভেবে পায় না কী করবে। ডান হাতে ধরা বাজারের ব্যাগ দিয়ে ফোঁটা মুছে নেয়। মাছওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে— কোন জায়গার মাছ এগুলা? মাওয়ার?
— না। ধলেশ্বরীর। কোন মাছ লইবেন, কন।
বিক্রি বেশি হলে দামটা কমই থাকে। খলসে আর পাবদা কেনে মামুন। দুইভাগা করে পুঁটি আর মলা। আর একটা শোল। কায়দা করে ব্যাগের ভেতর মাছগুলো ঢুকিয়ে দেয় মাছওয়ালা।
— জ্বর সারছে আপনের?
— হ্যাঁ। এখন ভালো। কয়টা দিন খুব ভুগলাম!
— পোলার লাইগা একটা ইলিশ দিয়া দিই? এক্কেরে তাজা।
পকেটের কথা চিন্তা করে মামুন। মাস শেষ হতে আরও এক সপ্তাহ বাকি। খরচের রাশ টানে সে— সামনের মাসে ইলিশ নেব।
— আইজকা দিয়া দিই। সামনের মাসে টাকা দিয়েন।
— নাহ! পরেই নিবো।
দিন পনেরো আগে ই-মেইল এসেছিল রুহিনার ফোনে। ‘নদী থেকে নগরে’র ই-মেইলে লেখা— বড়শি দিয়ে ইলিশ ধরা যায় না। তাই ইলিশ ধরার জন্য ফোনের ডায়াল অপশনে গিয়ে নাম্বার টাইপ করতে হবে...ক্যাশ অন ডেলিভারি। দীপ্ত এসে ফোন স্ক্রল করে করে ইলিশ দেখল। ইলিশ বলেই দীপ্তর আবির্ভাব সম্ভব হলো। সর্বনিম্ন অফার মূল্যে মাছ কিনতে অর্ডার করে দিল মামুন। পরিবারের সবাই মিলে ইলিশ ধরল! বাজারের চেয়েও কম দামে। ইলিশ খাবার ইচ্ছে পেশ করতেই এক দিনের মধ্যে আশ্চর্য ভেলকিবাজির মতো উড়ে এলো ইলিশ। সর্বোচ্চ সাশ্রয়ী দামে মাছবাজারের দায়িত্ব নিয়েছে ‘নদী থেকে নগরে’। ডাকলেই মাছের পুরো বাজার দরজায় হাজির। ডিসকাউন্টের ঝড়ে কোরালের স্বাদ বেড়ে যায়। যখন তখন স্যামন-সার্ডিন ঢুকে যায় রান্নাঘরে।
ইলিশ না নিয়েই ফিরতি পথে হাঁটা দেয় মামুন। পাশে টাইলস লাগানো হাউসে সাঁতার কাটে রুই, কাতলা, কালবাউশ। সবুজ পাইপ বেয়ে অক্সিজেন নেমে যায় পানিতে। হাঁক ছাড়ে খালেক মিয়া— স্যার, কাতলা মাছ নিয়া যান।
— এইটা কাতলা?
— হ হ। দেখেন না...
মামুনের পাশে দাঁড়িয়ে হাউসের পানিতে হাত ডুবিয়ে দেয় খালেক। একটা মাছের পেটে হাত রেখে মাছের মুখটা ভাসিয়ে তোলে। কাতলা মাছ হাঁ করে নিজের মুখটা দেখিয়ে দেয়। কাতলার আত্মসম্মানবোধ দেখে নিজের মনেই হেসে ফেলে মামুন। সারা বাজারে শুধু এই দু-তিনজনের কাছ থেকেই সে মাছ কেনে। টাটকা মাছ না হলে কিনতে বারণ করে। পচা মাছ গছিয়ে দেয় না। মাছ কিনতে কিনতে টুকটাক কথা হয়। বাজারদর থেকে শুরু করে এদের ঘরের কথাও কিছু জানা হয়ে যায় মামুনের।
ছুটির দিন দুপুরে একসাথে তিনজন খেতে বসে। টেবিলে দুই পদের মাছ, আমডাল আর সবজি। পাবদা মাছের মাখামাখা তেলঝোল আর ঝিরিঝিরি করে কাটা আলু-বেগুন দিয়ে মলা মাছের চচ্চড়ি। পাবদাটা খুব ভাল রাঁধে রুহিনা। রসুন না বেটে থেঁতো করে দেয়। পাবদা মাছ দিয়েই ভাত খায় দীপ্ত। ওর মাথায় ঘুরছে বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট সিরিজ। টেস্ট ম্যাচ চলছে অথচ আজ ফিজিকসের কোচিং ক্লাস!
দীপ্তর দিকে তাকিয়েই হয়তো বেলওয়ালা ছেলেটার কথা মনে পড়ে মামুনের। এবার আর পাবদায় স্বাদ পায় না। ভালো লাগে না মলা দিয়ে আলু-বেগুনের চচ্চড়ি। ছেলেটা তো তাকে ডাকেনি, যে ডাক শুনেও সে এড়িয়ে গেছে। এমনও না যে, দামে বনল না তাই বেল না কিনেই সে ফিরে এসেছে। কথা হয়নি তবু মনে হয় ছেলেটা তাকে ডাকলেই পারত। টুকরির ওপর সাজিয়ে রাখা ছটা বেল যে বিক্রি করতে হবে, সেটা সে না বুঝলে মামুন কী করতে পারে? এসব ভাবনায় মামুনের মন কিছুটা হালকা হয়। এমনকি ভাতঘুমের অভ্যেস না থাকলেও দুচোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে।
পরের সপ্তাহে বাজারে যায় মামুন। মার্চের মাঝামাঝি কড়া রোদে সকাল যেন দুপুরের স্তব্ধতায় ঝিম ধরে আছে। অথচ ঘড়ির কাঁটা দশটা দশে। আগেই ঠিক করে রেখেছে দুটা বেল কিনবে ছেলেটার কাছ থেকে। বাঁশের টুকরি নিয়ে ছেলেটা বাজারের বাইরের দিকে একটু আলাদা জায়গায় বসে। সেখানে গিয়ে মামুন ছেলেটাকে পায় না। আজকে সরে বসেছে হয়তো। কড়া রোদে রাস্তায় পড়ে থাকা কোনো দোকানের ছায়ায়। মামুন এদিক ওদিক হাঁটে। রোদের আগুন নিশ্বাসের ভাপে চোখ মেলে রাখাই দায়। ভ্রু কুঁচকে সে ছেলেটাকে খোঁজে। আশেপাশের দু-একজন ফল বিক্রেতাকে ছেলেটার কথা জিজ্ঞেস করে। ক্যাপসিকামওয়ালা কৌতূহলী হয়ে মামুনের খোঁজাখুঁজি দেখে কিন্তু বেলওয়ালার সাথে মামুনের যোগসূত্র আন্দাজ করতে পারে না। ভ্যানের ওপর তরমুজ সাজানো। তরমুজওয়ালা চামরের মতো ডাস্টার দিয়ে তরমুজের গায়ে এসে পড়া আলগা ধুলো ঝাড়ে। মামুনকে জানায় ছেলেটা আজ আসেনি। সাত দিন ধরে আসছে না। মামুন অবাক হয়। ছেলেটার সম্পর্কে কেউই তেমন কিছু বলতে পারল না। শুধু তার নাম জানা গেল। পাগলা।
এ যেন পাগলার এক ভীষণ ষড়যন্ত্র মামুনের বিরুদ্ধে। মামুন তাকে খুঁজতে আসবে জেনেই সে বাজারে আসছে না। মামুনের খুব রাগ লাগে। বাজার করতে ভালো লাগে না। সামান্য কিছু আনাজপাতি কিনে ফিরে আসে। ফেরার পথে ফাঁকা জায়গাটায় চোখ চলে যায়। সাত দিন ধরে ছেলেটা বাজারে আসছে না। কোনো অসুখবিসুখ হলো না তো? একজন দিনমজুরই বলা যায় পাগলাকে। সাত দিন ধরে কি খাচ্ছে? ওর নামটাই কি পাগলা? নাকি এমনি সবাই পাগলা বলে ডাকে? এসব ভাবতে ভাবতেই বাড়ি ফেরে মামুন। রুহিনাকে কেন যেন কিছু বলতে পারে না। বলবেই বা কী? বেলওয়ালার জন্য এই আদিখ্যেতা রুহিনার হয়তো ভালো লাগবে না বরং একদিন বলে বসবে— সেই ছেলের জন্য তো অস্থির হয়ে গেছিলা... রুহিনার ওপরও রাগ লাগে মামুনের। সে অনলাইনে পাহাড়ি বেল না কিনলে মামুন ঠিকই ছেলেটার কাছ থেকে বেল কিনত। এতে বিরাট কিছু হতো না। কিছু টাকা আয় হতো ছেলেটার।
বিকেলে গরমের দাপট সামান্য কম। খাটে আধশোয়া হয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে মামুন। বাংলাদেশ আর নিউজিল্যান্ডের ওয়ানডে ইনিংস হচ্ছে। বারান্দায় মেলে দেওয়া কাপড় ঘরে এনে ভাঁজ করে রুহিনা। বাজার থেকে ফিরে মামুন একটু বিক্ষিপ্ত এটা সে টের পেয়েছে। তবু আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেনি।
অচেনা নম্বর ভাসে মামুনের ফোনে। ‘আসসালামু আলাইকুম, কিং বাজার থেকে বলছি’ এটুকু শোনার পর এড়িয়ে যেতে হলে কী বলতে হয়, মামুন সেটা জানে। আজ দিনটাই অস্বস্তির। কারও কোনো দোষ নেই, কাউকে দায়ী করা যায় না অথচ কী যেন ঠিক মেনেও নেওয়া যায় না। কথা শুনতে বা বলতে ইচ্ছে করে না। বাংলাদেশ ঠিক তক্ষুনি নিউজিল্যান্ডের ক্যাচটা হাত থেকে ফেলে দিল কিনা! মনোযোগটা টিভির স্ক্রিনই শুষে নিল আর মামুন ফোনে বলে ফেলল— শুনছি।
— সম্মানিত ক্রেতাদের সুবিধার্থে আমরা এখন ডোর টু ডোর কাস্টোমাইজড সার্ভিস দিচ্ছি।
— আচ্ছা!
— আমাদের এই প্রজেক্টের নাম ‘রোজকার বাজার’। প্রতিদিন আপনার কাছে নির্দিষ্ট সময়ে কল করে জেনে নেওয়া হবে আপনার কী কী বাজার লাগবে। কাঁচাবাজার, তেল, নুন, চাল, ডাল থেকে শুরু করে লন্ড্রি প্রোডাক্ট সবই পাবেন। কিং বাজারে যা পাওয়া যায়, একই দামে আপনার চাহিদা অনুযায়ী সেসব পণ্য তালিকা ধরে আপনাকে পৌঁছে দেওয়া হবে। বিকাশে পেমেন্টের জন্য আগেই প্রদেয় টাকার পরিমাণ জানিয়ে দেওয়া হবে।
— এত বড় করপোরেট হাউসও ওয়ান টু ওয়ান হোম সার্ভিস শুরু করে দিয়েছে? কিং বাজার তো মার্কেট লিডার।
— জি স্যার, কম্পিটিটিভ মার্কেট। বোঝেনই তো। আজকে রেজিস্ট্রেশন করালে স্পেশাল অফার আছে। মোট পারচেজ প্রাইসের ওপর ফাইভ পারসেন্ট ডিসকাউন্ট। বিকাশে পে করলে এক্সট্রা টেন পার্সেন্ট ক্যাশ ব্যাক। আর পয়েন্ট সিস্টেম তো আছেই। যত টাকার বাজার, আপনার ‘রোজকার বাজার’ অ্যাকাউন্টে তত পয়েন্ট জমবে। ই-মেইলে দামসহ আপডেটেড প্রোডাক্ট লিস্ট চলে যাবে। আমাদের ওয়েবসাইটে সব ইনফো আছে।
— কম্পিটিশান বুঝি। মনোপলিও বুঝি।
— জি স্যার।
— শুধু আপনারাই মার্কেটে থাকবেন তাই না? ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ীদের পেটে তো লাথি মারছেন। বাজারে চাল, ডাল, মাছ, ফল বিক্রি করা লোকটা কী খাবে ভেবেছেন?
এ কথা একজন সামান্য বেতনভূক কর্মচারীকে বলার মানে হয় না। তবু সারা দিন ধরে মামুনের পুষে রাখা মনের চাপ কেন্দ্রচ্যুত করার জন্যই যেন কথাগুলো বেরিয়ে আসে। একটা মলিন, শুকনা, উদাস চেহারার বেলওয়ালা। পাগলা আজ না মরলেও কাল ঠিকই মরবে। মরবেই। পাগলার জন্য ভেবে আর কাজ নেই। গ্লানিবোধটুকু থিতিয়ে আসে। কেন্দ্রচ্যুত চাপ বাষ্পীভূত হয়ে মামুনকে স্বস্তি দেয়। রুহিনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে— কার সাথে কথা বলছ? টিভিতে ধারাভাষ্যকার বলে ওঠে—নিউজিল্যান্ড ওউন বাই ফাইভ উইকেটস। টেন বলস লেফট...
— আমি কী বলব, স্যার? কোম্পানিতে চাকরি করি। আপনি কি আজ রেজিস্ট্রেশন করাবেন?
— না। থ্যাংক ইউ।
কল কেটে দেয় মামুন। ক্লান্ত হাতে ফোন রেখে দেয় বিছানার ওপর। কাতলা মাছের হাঁ করা মুখটা মনে পড়ে। পাগলার সাথে সে নিজেও ঢুকে যাচ্ছে দানবীয় মাছের বিশাল মুখগহ্বরে।