এই দুর্দিনে ছেলেটার সঙ্গে দেখা হলো আবার। হঠাৎ এক বিষণ্ন বিকেলে। উল্টোডাঙার চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে, পঞ্চাশ মাইল দূরের ছিটকে থাকা মফস্বল এক শহরে। যেখানে থেকে প্রতিদিন ছেলেটার চলাফেরা ছিল। জীবন-জীবিকার টানে। পেটের টানেও বলা যায়। চার ফুট বাই চার ফুটের ছোট্ট দোকান। ওপর-নিচ, চারপাশ টিন দিয়ে ঘেরা। সামনে ক-হাত ছেড়ে রেলের লাইন। পেছনে গা-ঘেঁষা সিগন্যাল। সরু স্টেশনটায় দাঁড়ালে যাত্রীদের ভিড়ে আলাদা করে চোখে পড়ে না। আবার ব্যস্ত অফিস টাইমে ক্রেতাদের ভিড়, বাড়িয়ে থাকা হাত, ঘুপচির ভেতরে অদম্য পরিশ্রমে মসলা মাখতে থাকা রোগাটে ছেলেটাকে দেখে চেনা মনে হয়।
ট্রেন ধরার তাড়া দিয়ে ক্রেতাদের চোখ যখন প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায়। মাইকে কয়েকবার ঘোষণা হওয়ার পর যখন শুধুই ট্রেন ঢোকার অপেক্ষা, তখনই মুড়ির জন্য আরেকটা আবদার। ‘একটা এদিকে’। ঘুপচি ঘরটায় ছেলেটার তখন ঘাম ঝরানো ব্যস্ততা। বাইরে দাঁড় করানো ওর সমান বস্তাটা থেকে দ্রুত মুড়ি তুলে নেওয়া। হাতের কাছে ছড়িয়ে রাখা লঙ্কার গুঁড়ো, আচারের তেল, চানাচুরের প্যাকেট, বাদাম, আরও কয়েকটা মসলা মিশিয়ে নাড়তে শুরু করা। এর মধ্যেই ‘ঢুকছে, ঢুকছে’ বলে প্ল্যাটফর্মজুড়ে হইহই শব্দ। ‘আমারটা হলো?’-র জবাবে হাসি মুখে কাগজের ঠোঙা বাড়িয়ে দেওয়া। ধুলো উড়িয়ে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে ততক্ষণে ছুটে যাওয়া ‘গ্যালপ ট্রেন’।
সেই প্ল্যাটফর্মে পা রাখালেই ওর দোকান বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকে। কটা তো মুড়ি, সঙ্গে তেল, লঙ্কা আর মসলা—তাতেই এমন নেশা! অদ্ভুত গন্ধ। কত ট্রেন চলে যায়। আপ-ডাউন। এদিক-ওদিক। তবু ওর বানানো মুড়ি মাখা শেষ করে ধীরেসুস্থে পরের ট্রেন ধরা।
দাদাদের আবদার মেটাতে মেটাতে মাঝেমধ্যে এগিয়ে আসা দিদিরাও। সেই ব্যস্ত সময়ে। কেউ কেউ ছোলামাখা কিংবা আলুকাবলি-র আবদার নিয়ে। জিব ভিজে ওঠে জল! ভেতর থেকে ছেলেটার গলা বলে, ‘একটু দাঁড়াতে হবে দিদিভাই’। মুড়ি মাখা থামিয়ে সে তখন আলুর খোসা ছাড়াতে শুরু করে। নিশ্চয়ই ভালো বানায় ছেলেটা। না-হলে রোজ রোজ অফিস ফেরত দিদিমণিরাও কেন ভিড় জমাবে ওর দোকানে? কে যেন পাশ থেকে বলে যায়। বানানো শেষ হলে একটু জিবে ছুঁইয়ে এগিয়ে যায় দিদিমণি। দু-পা বাড়ালেই তো লেডিস কামরা।
সেদিন তো মাদারির খেলা দেখানো মেয়েটা, শেষ মুহূর্তে ট্রেনটা ধরতে গিয়ে, ওর দোকানের সামনেই, হাত-পা ছুলে একাকার। শেষে ওকেই দেখলাম এগিয়ে আসতে। হাত-পা ডলে মুখে জল তুলে দিল একবার। ‘কেন যে এত রিস্ক নিতে যাস! বেশি ব্যথা পেয়েছিস?’ দলছুট মেয়েটা কান্না থামিয়ে ওকে দেখছিল একবার।
এমনি কত দিন ছেলেটাকে দেখা। ব্যস্ততা ঠেলে হাসিমুখ। সেই একই রকম। চেহারাটাও সেই এক। প্রতিদিন একরকম সাজানো দোকান। মসলা মুড়ির স্বাদটাও এক। একদিন নিজেই বলেছিল কথাটা, বনগাঁ লাইনের ওদিকে কোথায় যেন বাড়ি। আসার সময় ওদিক থেকেই মুড়ি, মসলা বানিয়ে নিয়ে আসে রোজ। এর বেশি কিছু বলেনি আর।
টানা সাত মাস পেরিয়ে বন্ধ লোকাল ট্রেন। বন্ধ যাত্রী চলাচল। শাটডাউনে প্ল্যাটফর্মে ভিড় করা দোকানগুলোও। এখন ফাঁকা প্ল্যাটফর্মজুড়ে শুধুই বিষণ্নতার ছবি। এসবের মধ্যেই ওর সঙ্গে দেখা। এত দিন পর। কেমন উদাস চোখে তাকিয়ে থাকা একবার। রোগাটে শরীরে লুকানো আরও রোগাটে ছাপ। ওর দোকানও বন্ধ সেই থেকে। বাধ্য হয়ে এখন সবজি বিক্রিতে নামা। ঝুঁকি নিয়েই পাড়া ঘুরে সেসব বিক্রি করা। ‘কবে খুলবে দোকান? কী বললে, চাকা ঘুরলে? ফের ভিড় জমলে প্ল্যাটফর্মটায়?’ চলে যেতে যেতে ছেলেটাকে দেখি আবার। অচেনা মনে হয়। আমাদের মফস্বলের স্টেশনটার মতো। ঘুমিয়ে থাকা কুকুর, ভিখিরির দল। দূরে সিগন্যাল পোস্টের লাল হয়ে থাকা আলো।