• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ১৩, ২০২১, ০২:৫৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ১৩, ২০২১, ০২:৫৯ পিএম

শুভাগমন । নিবেদিতা পোদ্দার

শুভাগমন । নিবেদিতা পোদ্দার

পোয়াতি মেয়েটা সকাল থেকে উচ্ছ্বসিত। কেন জানি আজ ওর মনটা বেশ ফুরফুরে। সকাল হতেই উঠানের জাঙ্গলা থেকে কচি শসা দেখে খুব খেতে ইচ্ছা করল। মা বলেছে, ‘এ সময় যা খেতে ইচ্ছা করবে খাবি, না হলে বাচ্চার মুখ থেকে লালা পড়বে।’ নিজের জন্য না হোক বাচ্চার কথা ভেবে দুটো শসা ছিঁড়ে আনল। পুরো উঠোনজুড়ে বাঁশের জাঙ্গলার সবুজ নদীতে হলুদ পালতোলা নৌকোতে ভরে গেছে। প্রতিদিন মৌমাছি আসে মধু খেতে। জাঙ্গলার নিচ দিয়ে কচি কচি শসাগুলো ঝুলে আছে। যেন নতুন বউয়ের কপালের টিকলি। জাঙ্গলার নিচে দাঁড়িয়ে মেয়েটার আরেকটা ঘর মনে হয়। শান্তি লাগে।

বর্ষার শুরু, থেকে থেকে আকাশ অভিমানী হয়ে উঠে মুখ কালো করে অঝোর ধারায় কান্না জুড়ে দেয়। মাটির উঠোন বৃষ্টির জলে ভিজে পিচ্ছিল হয়ে যায়। মেয়েটির ছোট ভাই প্রতিদিনই কারণে-অকারণে উঠোনে দু-একটা মাছ ধরে। মেয়েটির মা বারবার মেয়েটিকে সাবধান করে উঠানে নামতে, যদি ভালো মন্দ কিছু একটা হয়ে যায়, তাহলে তার শ্বশুরবাড়িতে কী জবাব দেবে। মেয়ে তো আর এখন তাদের নেই, ওই বংশের বংশধর বাড়ছে মেয়েটির শরীরে। যদিও মা এর এসব কথা মেয়েটি কানে তোলে না, যখন যা ভালো লাগে তাই করে। মনে হলো তো দুপুরবেলা পুকুর পাড়ে চলে যায়, নয়তো পশ্চিমের বাগানে গিয়ে ঘোরাঘুরি করে। পুকুরপাড়ের রাস্তাটা ওর খুব প্রিয়। রাস্তার দুই ধারে গোল্ডরাস্ট পাতাবাহার গাছের সারি। মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া মাটির সাদা রাস্তা যেন হাতে আঁকা ছবি। কিছু দূর যেতেই আমলকীগাছটার ঝিরিঝিরি পাতার ফাঁক দিয়ে আসা আলো ছায়ার খেলা দেখতে মেয়েটির বেশ লাগে। পুকুরপাড়ে নারকেলগাছটার গোড়ায় বসে সে হারিয়ে যায় চাম্বলগাছের ডালে বসা বুলবুল পাখির সাথে গান গাইতে গাইতে। মেয়েটির গানের গলাটাও চমৎকার। মনে পড়ে কলেজজীবনের কথা। এত ভালো গানের গলা ছিলে! বান্ধবীরা তাকে টিকিট কেটে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেত, সিনেমা দেখে ফিরে এসে তাদের গান শোনাতে হবে এই শর্তে উত্তম-সুচিত্রা, রাজ্জাক–ববিতা–কবরীর জনপ্রিয় সব সিনেমার গান মেয়েটি একবার শুনে চমৎকার তুলে নিত। এই পথ যদি না শেষ হয়, তুমি যে আমার, নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে, অথবা গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু আর কত শত গান…। কী সুখের আর আনন্দের ছিল দিনগুলো! আজ কেন জানি হৈমন্তী শুক্লার গাওয়া ‘ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না’ গানটি গাইতে ইচ্ছা করছে। গুনগুন করে ওঠে মেয়েটি। নারিকেলগাছে টিয়া পাখির ঝাঁক যখন ট্যা ট্যা করে নারিকেলের ডগাটা নাড়িয়ে পুকুরের জলে ছায়া ফেলে, হঠাৎ সংবিৎ ফেরে ওর। একটা মাটির ঢেলা পুকুরে ছুড়ে দিয়ে জলের ঢেউ দেখতে দেখতে উল্টো ঘুরে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে।

দিনেদুপুরে মেয়ের এই পুকুর ঘাটে, বাগানে, ঘুরে বেড়ানো মায়ের ভালো লাগে না। এ সময় নানা রকম অশরীরী জীব ঘুরে বেড়ায়। কারও যদি নজর পড়ে, প্রথম সন্তানের মতো এবারও যদি কোনো অঘটন ঘটে! নানা শঙ্কায় মায়ের বুক কেঁপে ওঠে।
কদিন ধরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। থামার নামই নেই। মেয়েটার এখন নয় মাস চলছে। যেকোনো সময় প্রসব ব্যথা উঠতে পারে। গ্রামে কোনো ভালো ডাক্তার নেই। ভরসা দাই। মেয়েটির মা প্রতিদিনই কাঁথা সেলাই করে।

নরম নরম কাপড় বের করে গরম জলে ধুয়ে গুছিয়ে রাখে। সরিষার বালিশ বানায়, বিড়া বাঁধে কত কী! এবার যে তাদের ঘরে নাতি আসবে! বিশ বছরের মেয়েটির তৃতীয়বারের মতো পোয়াতি। প্রথম সন্তানটি ছেলে, অসময়ে হয়েছিল বলে পৃথিবীর এই রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করার সুযোগ পায়নি। দ্বিতীয় সন্তান মেয়ে। বেঁচে যাওয়ায় কারও কোনো আপত্তি হয়নি। কিন্তু শাশুড়ি এবার বলেই দিয়েছে, ‘‘বংশের বাতি চাই। এবার কিন্তু ছেলেই চাই।” না হলে তিনি তার ছেলেকে আবার…এসব নিয়ে মেয়েটির কোনো চিন্তা নেই। মেয়ে ছেলে করার কারিগর তো সে নয়। মার কাছে এসে তার নিজেকে খাঁচা ছাড়া পাখি মনে হয়। সকালে উঠে বাগানে গিয়ে ফুলের সাথে কথা বলে। ওর ফুলবাগানের লতা বেলিগাছটা এবার ফুলে ফুলে সাদা হয়ে গেছে। দোলনচাঁপার ঝাড়টাতেও অনেক ফুল ফুটেছে। দোলনচাঁপা আর বেলিভুলের গন্ধে ওর কেমন জানো মাতাল মাতাল লাগে নিজেকে। গভীর রাতে ফুলের গন্ধে ওর ঘুম ভেঙে যায়। জানলায় দাঁড়িয়ে ফুলের বাগানের দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকে। রাতে চাঁদের আলো ফুলগুলোতে পড়ে মনে হয় যেন হাজার বাতি জ্বলছে। জোনাকিরা যখন এসে ফুলের সাথে যোগ দেয়, সুবজ আলোয় ফুলগুলোতে যেন রঙের খেলা দেখতে পায় মেয়েটি। রাত জেগে প্রকৃতির এই অপার্থিব লীলা দেখে মেয়েটি। রয়নাগাছটার ফলগুলো পেকে ফেটে লাল চামড়া চিরে কালো কুচকুচে বিচিগুলো তলায় পড়েছে। কয়েকটা ফল কুড়িয়ে এনে মেয়েটি পাঁচ গুটি খেলে। পুকুর পাড়ের বিলাতি গাবের লাল মখমলে শরীর ওকে খুব টানে। ও ভাবে এবার স্বামীর কাছে ফিরে গিয়ে একটা মখমলের চাদর কিনে দিতে বলবে।

বৃষ্টি নেমে যাওয়ায় খুব জোর অসুবিধে হলো মেয়েটির। ঘর থেকে নামতেই দেয় না মা। যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়! তাই পদে পদে সাবধানতা। ওর বড় মেয়েটি দিদার ন্যাওটা। দিদার পিছু পিছু ঘোরে সব সময়। দুদিন ধরে বৃষ্টি নেই হালকা রোদে উঠোন একটু শুকিয়ে গেছে। পুব বাগানে গিয়ে মেয়েটি বড় বড় দুটো দুধকচুর ডগা কেটে নিয়ে আসে। কচুপাতা সিদ্ধ খেতে মন চেয়েছে। আর কচুর ডগা দিয়ে ইলিশ মাছ। বিকালে হাট থেকে মেয়েটির বাবা দড়িতে ঝুলিয়ে এক জোড়া ইলিশ মাছ নিয়ে আসে। সন্ধ্যায় কুপির আলোতে বসে মা মাছ কাটে, ইলিশের রুপালি রং মেয়েটির চোখে ঝলসায়। ইলিশ মাছের গন্ধে পুরো বাড়ি ম ম করে। মা ইলিশের তেলেই ইলিশ রান্না করে ফেলেন। তাজা মাছ চুলায় দিতেই গল গল করে তেল বের হয়ে আসে। একটু তেল তুলে রাখেন গরম ভাতে খাবার জন্য।

দুপুর হওয়ার আগেই মেঘের গর্জন শুরু হয়। মেয়েটি স্নান করতে যাবার পথেই দেখতে পায় পাশের ডোবা থেকে কানে হেঁটে কই মাছ দল বেঁধে উঠে আসছে। যেন মিছিল করছে। মেয়েটি চিৎকার করে ছোট ভাইকে ডাকে, “ভাই খালই নিয়ে আয়।” মেয়েটি খালই ধরে দাঁড়িয়ে থাকে আর ছোট ভাই মাছগুলো ধরে ধরে খালুইতে রাখে। মাছ ধরা হয়ে গেলে মেয়েটি ঘাটে গিয়ে মাথা ঘসে, আর পুকুরের জলে বৃষ্টির ফোঁটার নাচন দেখে।

দুপুরের খাওয়া হতে না হতেই, মেয়েটির কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। পেটটা কেমন যেন মুচড়ে উঠছে। কয়েকবার টয়লেটে যায়। কিন্তু না ব্যথা কমার বদলে বাড়তে থাকে, মাকে বলতেই মা বুঝে ফেলেন, তাড়াতাড়ি টেঁকিঘরে মাদুরের বেড়া দিয়ে মাদুরের ওপর কাঁথা বিছিয়ে আতুড় তৈরি করেন। মালসায় কুঁড়ো দিয়ে অগুন জ্বালান। সাবান রাখেন ঘরের বাইরে। ছোট ভাইকে দাই ডাকতে পাঠান, বড় ভাই যায় ডাক্তার ডাকতে পাশের গ্রামে। মেয়েটির বাবা ঠাকুর ঘরে প্রার্থনা করতে বসেন। চুলায় বড় হাঁড়িতে জল গরম করতে দেন মা, পাশের বাড়ির ঠানদি, বউদি খবর পেয়ে চলে আসে। বাইরে চরম বৃষ্টি, বৃষ্টির ছাঁটে কিছু দেখা যায় না, চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে, মনে হচ্ছে যেন প্রলয় ঘনিয়ে এসেছে। বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে মেয়েটির মা বাগানে গিয়ে বাঁশের কঞ্চি কেটে আনে। মাটির ঘর ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে, জলের ঝাপটায় ডোয়ার মাটি নরম হয়ে আলগা হয়ে গেছে। আর টিনের চালে বৃষ্টির বেগ বেড়েই চলেছে, মনে হচ্ছে এখনই আকাশ ভেঙে পড়বে। প্রকৃতির দুর্যোগের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে মেয়েটির ব্যথা।

দাই আসার আগেই মেয়েটির বাচ্চা হয়ে গেল। পাশের বাড়ির ঠানদিই দাইয়ের কাজ করল। ফুল পড়ার পর বাঁশের কঞ্চি দিয়ে নারী কাটল ঠানদি। গরম জলে পরিষ্কার করে নরম কাপড়ে জড়িয়ে মায়ের কোলের কাছে দিল ফুটফুটে মাথা ভরতি চুল, লাল ঠোঁটের বাচ্চাটাকে। প্রকৃতি নীরব। নীরব পুরো বাড়িটি। কোনো শঙ্খ ধ্বনি নেই, নেই কোনো অনন্দ, শুধু নবাগত শিশু গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে তার আগমন বার্তা জানান দিল। ভাইয়েরা দূর থেকেই খরব পেল, বাড়ি ফিরল না কেউ। মেয়েটির মায়েরও সব উচ্ছ্বাস কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। একজনই শুধু খুশি!

আজ রমার চোখে অপরাহ্ণের ঝিলিক। মস্ত বাড়িটায় বসে অতীত দিনের স্মৃতি হাতড়ে বেঁচে আছে সে!