• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ১৩, ২০২১, ০৪:০০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ১৩, ২০২১, ০৪:০০ পিএম

প্যানিক । সোলায়মান সুমন

প্যানিক । সোলায়মান সুমন

অনেক দিন পর সুশান্ত আজ বাজারে বের হয়েছে। বাচ্চাটা আঙুরের আবদার করছে কয়েক দিন ধরে। মোটামুটি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কেনাই আছে বাড়িতে। এক মাসের খাবার বাড়িতে স্টক করেছে। সে জানে এমনটা করা ঠিক নয়। এতে বাজারের ওপর চাপ পড়ে। গরিব, নিম্নবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্তরাও তো চাইলে বাড়িতে খাবার মজুত করতে পারবে না। সুশান্ত মধ্যবিত্ত। তার জমানো কিছু টাকা আছে। একটা ফ্ল্যাট কিনবে বলে কিছু টাকা জমাচ্ছিল। তার রানিং ইনকাম আছে। আর যাহোক এক বছর লকডাউন থাকলেও মাসিক বেতনটা সে নিয়মিত পবে। সরকারি চাকরি বলে কথা। তার বউ জয়া লকডাউনের কথা শুনে বলেছিল, ‘এক মাসের বাজার নিয়ে এসো। বলা তো যায় না। বাজারে সরবরাহ সংকট হতেই পারে। গরিব দেশ, বড় বড় উন্নত দেশগুলোর যখন এই অবস্থা! বাড়িতে ডিম শেষ, ওষুধ শেষ, সবজি নেই বললেই চলে। আর বাচ্চা দুটোর নিজস্ব কিছু আবদার আছে।’ তাই বাইরে বের হতেই হলো। বড় রাস্তায় উঠতেই চার-পাঁচজন ভিখিরি তাকে ঘিরে ধরল। এ তো মহাবিপদ! করোনা টেস্ট হয় উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তদের। সামান্য যা চিকিৎসা আছে, তা যদি জোটে তবে তাদের ভাগ্যে জোটে। গরিব মানুষ কেন মরল তার খবর কে রাখে? এই ভিখিরিদের মধ্যে কেউ কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত নয় তার গ্যারান্টি কে দেবে। তাদের যে জীবনযাপন, তাতে এই প্যানডেমিকের শিকার হওয়ার আশঙ্কা খুবই বেশি। আর তারা সাহায্য চাইতে গিয়ে এত কাছে চলে আসছে, যা খুবই বিপজ্জনক! সুশান্ত চিৎকার করে ওঠে। এই তোমরা দূরে সরো। গো গো! কেউ সরে যায়, কেউ সরে না। সুশান্ত দ্রুত হেঁটে রাস্তাটা পার হয়ে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের গেটের সামনে চলে আসে। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে পারে না। গেটে সিকিউরিটির কাজে নিয়োজিত লোকটি বলে, ভেতরে ভিড় আছে অপেক্ষা করুন। কেউ বের হলে আপনি যেতে পারবেন। সব ভিখিরি চলে গেলেও একটি ত্রিশোর্ধ্ব নারী তার পেছন ছাড়ে না। সুশান্ত ভীষণ অশান্তির মধ্যে পড়ে গেছে। এই কারণে সে বাইরে বের হতে চাইছিল না। ‘এই সরো সরো এখান থেকে।’
‘ভাইজান, আপনারা না দিলে আমরা খাবো কী?’
‘কেন ত্রাণ পাও না?’
‘আমার তো গাইবান্ধা বাড়ি। ওখানকার কার্ড নাই।’
‘তাতে কী?’
‘কার্ড ছাড়া কি রিলিফ দিবে?’
‘একেবারেই পাওনি?’
‘এই আপনারা যা দেন...’
‘তোমরা যেভাবে গায়ের ওপর চড়ে যাচ্ছো। এটা অনেক বিপজ্জনক!’
‘দিলেই তো চলে যাবো। দেন না বলেই তো...’
‘মানুষজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বের হচ্ছে বাজারে। তাদের তোমরা এভাবে বিপদে ফেলছ। যে দিবার এমনই দিবে। এভাবে জোরাজুরি করতে নেই।’
‘জোরাজুরি না করলে কে দেয়? আপনি দিলেন?’
‘দূরে থাকে দূরে দাঁড়াও।’
‘ভাইজান, আমি ভিক্ষা করি না। বাসাবাড়িতে কাজ করি। কিন্তু কোনো বাড়িতে এখন ঢুকতে পারছি না। সোসাইটি থেকে নিষেধ। বাড়ির গার্ডরা দেখলে দূর দূর করে তাড়াচ্ছে। অনেকের বাড়িতে বেতন পাব, তা-ও ঢুকতে পারি না। ভিক্ষা করে খেতে চাই না। নিরুপায় হয়ে বেরিয়েছি। গোড়ান বস্তিতে থাকি। তিন তিনটা বাচ্চা। স্বামী হোটেলে কাজ করে তারও কাজ বন্ধ। বাচ্চাগুলার ভুখা মুখ দেখে আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না। গতকাল রাতেও ইঁদুর মারা বিষ খেয়ে মরতে চেয়েছিলাম, পারিনি। দুনিয়াতে কেউ বাঁচতে চায় কিন্তু বাঁচতে পারে না, কেউ আবার মরতে চাই কিন্তু মরতে পারে না।’ মেয়েটি কথাগুলো যেন মুখস্থ বলে ফেলল।
সুশান্ত সাহায্য দেওয়ার জন্য পকেটে হাত দিতে যাচ্ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাত বের করে নিল। আজ সে ক্রেডিড কার্ড দিয়ে সব বিল পেমেন্ট করবে। বিশেষ প্রয়োজন না হলে টাকায় সে হাত দেবে না। কারণ, টাকায় জীবাণু বেঁচে থাকতে পারে। সুশান্ত বলে, ‘খুচরা টাকা নাই। পরে...’ সুশান্ত ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢোকে। নিজের প্রয়োজনীয় সব পণ্য কিনে রোলিং বাস্কেট ভরে ফেলে। হঠাৎ তার কী হলো, সে একজন সেলস অ্যাসিস্ট্যান্টকে ডেকে বলল, তুমি দুই কেজি চাল, এক কেজি লবণ আর এক কেজি ডালের একটা প্যাকেট তৈরি করে দাও। দাম মিটিয়ে সুশান্ত বেরিয়ে আসে। সেই মেয়েটিকে খুঁজতে থাকে ফুটপাতের আশপাশে। কিন্তু তার মতো অনেককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেও মেয়েটিকে খুঁজে পায় না। হঠাৎ অনেকগুলো ভিখিরি তাকে ঘিরে ধরে। দ্রুততার সঙ্গে সুশান্ত সবাইকে পাশ কাটিয়ে নিজের বাড়ির রাস্তা ধরে। অতঃপর বাড়িতে এসে স্বস্তির নিশ্বাস নেয়। মাস্কটা ঢাকনাযুক্ত ডাস্টবিনে ফেলে বাইরের পোশাকগুলো ডিটারজেন্টে ভিজিয়ে দেয়। তারপর সাবান আর শ্যাম্পু দিয়ে ভালো করে সাওয়ার নেয়। সুশান্ত ওয়াশরুম থেকে বেরোলে তার বউ বীণা তাকে বলে, ‘এই অল্প কটা চাল-ডাল কিনেছ কেন?’
‘ওহ! এক ভিখিরিকে দিব বলে কিনেছিলাম। কিন্তু বেরিয়ে দেখি সে আর নেই।’
‘তাহলে অন্য আরেকজনকে দিয়ে দিতে। নিয়ত যখন করেছিলে ঘরে আনার দরকার কী ছিল?’
‘দিব কাকে? দশ-পনেরোজন ভিক্ষুক জেঁকে ধরেছিল। একজনকে দিলে অন্যরা জেঁকে ধরবে। সে এক বিপজ্জনক অবস্থা!’
‘নাহ! তা-ও ঘরে আনা ঠিক হয়নি।’
‘আচ্ছা। কাল দিয়ে আসব।’
‘তুমি আবার কাল নিচে নামবে?’
‘জাস্ট সামনে নামব। কোনো একটা ভিখিরিকে দিয়ে চলে আসব।’
বীণা বাজারগুলো সাজাতে সাজাতে বলে, ‘আজ একটা খবর পড়ে অবাক হলাম। এক মা তার আট সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে না পেরে পাথর সিদ্ধ করছে চুলায়। সন্তানেরা ভাবছে এই তো খাবার নামবে। ক্ষুধায় তারা ছটফট করছে।’
‘কোথায়?’
‘এটা কেনিয়ার উপকূলীয় মোম্বাসা শহরের গল্প। খবরটা মিথ্যা না, কারণ ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি নিউজটা করেছে আজ।’
‘আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম।’ সুশান্ত ঈষৎ হাসে।
‘কেন?’
‘নাহ মানে আমি ভেবেছি এটা আমাদের দেশের খবর। ছোটবেলায় আরব দেশের এমন একটা গল্প শুনেছিলাম।’
‘আমাদের দেশেও এমন হতে দেরি নাই।’
‘এ দেশের এত জনসংখ্যা, বেকারত্ব, দারিদ্র্য। তাছাড়া ধনী আর দরিদ্রের ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে। আবার টাকা পাচার হচ্ছে। করোনার কারণে বিদেশে আমাদের শ্রমিকেরা কাজ হারাচ্ছে।...’
‘মানুষ কেন যে বোঝে না। পাশের বাড়ির মানুষ যদি ক্ষুধার্ত থাকে তবে তুমি সুখী হবে কীভাবে?’
‘ঠিক তাই। দেশের মানুষ যদি কষ্টে থাকে তুমি নির্লজ্জের মতো আনন্দ করবে কেমনে?’ বীণার শেষের কথাটা শুনে সুশান্ত অস্থির হয়ে পড়ে। ডাইনিং রুমে পাইচারি শুরু করে। বীণা বলে, ‘এভাবে হাঁটছ কেন? চা খাবে?’
‘নাহ, ঠিক আছে আমি ব্যালকুনিতে গিয়ে একটু বসি।’ সুশান্ত ব্যালকুনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। উঁকি মেরে বাহিরটা দেখে। কী যেন খুঁজতে থাকে তার চোখ। 

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সুশান্ত সেই চাল-ডাল-লবণের ব্যাগটা নিয়ে বের হয়। বাইরে গিয়ে সেই ভিখারিটাকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু নারীকে খুঁজে সে পাই না। বিরক্ত হয়ে কিছুক্ষণ রাস্তার ধারে দাঁড়ায়। পাঁচ নম্বর রোডের মোড়ে দাঁড়িয়ে কয়েকজন ভিখিরি ভিক্ষা করছে। সুশান্ত খানিকটা এগিয়ে গিয়ে তাদের মধ্যে সেই মেয়েটিকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু তাদের মাঝেও সেই মেয়েটিকে সুশান্ত খুঁজে পায় না। তারা কী বিষয় নিয়ে যেন আলোচনা করছিল। কে যেন আত্মহত্যা করেছে। এবং ঘটনাটা ঘটেছে গোড়ান বস্তিতে। পুলিশ বলছে হত্যাকাণ্ড, কিন্তু স্থানীয়রা বলছে আত্মহত্যা। কোনটা যে সত্য, এই নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা চলছিল। সুশান্ত জিজ্ঞেস করে ‘ছেলে না মেয়ে?’ ভিখিরিরা উত্তর না দিয়ে তাকে ঘিরে ধরে। সাহায্যের জন্য সবাই তাদের ডান হাত মেলে ধরে। সুশান্ত বলে, ‘দূরে থাকো, দূরে থাকো। বললে না ছেলে না মেয়ে?’
‘মাইয়া মানুষ।’
‘দাও বাবা কিছু দাও। না খেয়ে আছি।’
‘বয়স কত?’
‘ত্রিশ-চল্লশি হবে বাবা।’
‘বাবা খুব কষ্টে আছি। আমরা করুণায় না- না খেয়ে মরব।’
সুশান্ত থলেটা একজন বৃদ্ধার হাতে দিয়ে হকারের কাছ থেকে সব কটি দৈনিক কিনে বাড়িতে ফিরে আসে। মরিয়া হয়ে প্রতিটা পেপার ঘেটে খুঁজতে থাকে, আত্মহত্যার ঘটনাটা সত্য কি না। বীণা বলে, ‘কী খুঁজছো এমন করে?’
‘একটা অত্মহত্যার ঘটনা।’
‘ওসব নিয়ে বেশি মাথা ঘামিও না শুধু শুধু প্যানিক  হবে।’