• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ১২, ২০২১, ০২:৩৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ১২, ২০২১, ০২:৩৬ পিএম

বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যের সীমানা

বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যের সীমানা

সাম্প্রতিক সময়ে বুদ্ধদেব বসুর লেখা সাহিত্যসংক্রান্ত আটটি প্রবন্ধ নিয়ে সংকলন–‘সাহিত্যচর্চা’ পড়ার সুযোগ হয়েছে। প্রবন্ধগুলো ১৯৪৬ থেকে ১৯৫২ সালের মধ্যে লেখা। বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস ও কবিতা যেমন সুপাঠ্য, তেমনি প্রবন্ধগুলো চিন্তায় প্রভাববিস্তারের ক্ষমতাসম্পন্ন। তাঁর প্রবন্ধগুলো ত্রিশ এবং তার পরবর্তী সময়কালে সাহিত্য দর্শনকে প্রভাবিত করেছিল। সাহিত্য রচনা একজন মানুষের ধ্যান-জ্ঞান-সাধনায় পরিণত হলে তার মূল অনেক গভীরে প্রোথিত হয়। প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসুর রচনায় তার চিহ্ন সুস্পষ্ট। তাঁর প্রবন্ধে সমালোচকের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ, গবেষকের গভীর জ্ঞানের ছাপ এবং শিল্পী হিসেবে তাঁর সাহিত্য রচনার পেছনে দর্শনের উপস্থাপন পাঠককে মুগ্ধ করে, আবার একই সঙ্গে এটিও মনে হয়–প্রবন্ধগুলো পাঠকের কাছে চিন্তারও দাবি করে। অর্থাৎ যিনি পড়বেন, তিনি মুগ্ধ হবেন ঠিকই, আবার ভাবনাকেও ক্রিয়া করাতে বাধ্য হবেন। পাঠক যখন ভাবনাকে সক্রিয় করবেন, তখন তিনি নিষ্ক্রিয় থাকেন না। এই অবস্থায় লেখকের সঙ্গে তাঁর চিন্তা কোথাও মিলে যায়, কোথাও আবার বৈপরীত্যও দেখা যায়। বোধ হয় লেখক নিজেও চান পাঠকের চিন্তার সঙ্গে তাঁর চিন্তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হোক। এই বোধ থেকে এই লেখার দুঃসাহস। বলা বাহুল্য, এই লেখা আলোচ্য বইয়ের সমালোচনা নয়, কেবল পাঠজাত তাড়নার ফল। লেখার শব্দ যত ডালপালাই ছড়াক, রসের উৎস বুদ্ধদেবের প্রবন্ধগুচ্ছ।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ‘সাহিত্যচর্চা’ বইটিতে মোট প্রবন্ধ আটটি। এখানে সব কটি প্রবন্ধ নয়, কেবল একটি প্রবন্ধই লক্ষ্য। ‘সাংবাদিকতা, ইতিহাস, সাহিত্য নামীয়’ রচনাটি এই লেখার আলোচ্য বিষয় প্রবন্ধটির শেষে উল্লেখিত সময় হতে জানা যায়, এটির রচনাকাল ১৯৪৭। সময়টি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এই বছর আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ থেকে শাসন ভারত ও পাকিস্তানি শাসকদের কাছে হস্তান্তরিত হয়। ইতিপূর্বে সংঘটিত হয়ে গেছে বীভৎস, মানবসভ্যতা বিধ্বংসী মহাযুদ্ধ। অন্য ক্ষেত্রগুলোর মতো এই মহাযুদ্ধ শিল্পী-সাহিত্যিকদের মনন জগৎকেও নাড়া দিয়ে গেছে, পূর্বেকার বিশ্বাসে পরিবর্তন ঘটিয়েছে। সামাজিক অস্থিরতা, পারস্পরিক অবিশ্বাস থেকে উদ্ভূত সংঘ ভাবনায় অনাস্থা ও বিচ্ছিন্নতা প্রকট রূপ ধারণ করে। এই সময় লেখকদের মধ্যে দুটো ভাগ দেখা যায়। একদল–যারা বিভিন্ন (ধর্মীয় অথবা রাজনৈতিক) অনুসারী। এই দলে যারা আছেন, তাদের লেখায় অনুসৃত মতবাদের পক্ষাবলম্বন স্পষ্ট। অপর দলটি নির্দিষ্ট কোনো মতবাদের অনুসরণকে শিল্পী বা লেখকের স্বাধীনতাবিরুদ্ধ বলে মনে করেন। এই বিভাজন প্রাক্‌-বিশ্বযুদ্ধকালেও ছিল, যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বিভাজনটি প্রকটতর হয়ে সামনে আসে। শেষোক্ত দলের শিল্পীদের এই সময় তাদের চিন্তার দর্শনগত ভিত্তি নির্মাণেচ্ছা লক্ষ করা যায়। তখন এঁদের মধ্যে বিভিন্ন ধারার উদ্ভব হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় দল দুটির মধ্যে শিল্পীর অবস্থান প্রশ্নে সৃষ্ট বিতর্কে একটি মাত্রা লাভ করে। উল্লেখিত প্রবন্ধটি এই সময়ের মধ্যে লেখা হওয়ায় বিতর্কটির ছায়া এখানে উপস্থিত।
‘সাংবাদিকতা, ইতিহাস, সাহিত্য’–প্রবন্ধটির শুরুতেই সংবাদপত্র সম্পর্কে তাঁর মতামত জানিয়ে দেন। এই মতামত অনেকাংশে সত্য। সংবাদপত্র যে নীতির ওপর ভিত্তি করে প্রকাশ হওয়ার কথা, অর্থাৎ ‘সরসতার দ্বারা নীতির উজ্জীবন আর নীতির দ্বারা সরসতা সংশোধন’—১. তা থেকে আজকের আজকের দিনের ‘বাণিজ্য সেবক পার্টি প্রেষি ‘(লেখকের ভাষায়) সংবাদপত্র সরে এসেছে। এখন সংবাদ সংগ্রহ করে নয়, সংবাদ তৈরি করে পরিবেশন করা হয়। আধুনিক সংবাদপত্রের তিনটি প্রধান অংশ–সংবাদ, মন্তব্য এবং বিজ্ঞাপন প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে সত্যের অপলাপী কীভাবে হয়, তা দেখিয়েছেন। সংবাদ পরিবেশক নিজ দলীয় বা পক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্যটিই প্রকাশ করেন আর তথ্যভোক্তা বা পাঠক সেই তথ্যের ভিত্তিতে জীবন দর্শন ঠিক করে নেন। এই সংবাদপত্রের সরবরাহকৃত তথ্য সমগ্রের অংশ নয়, বিচ্ছিন্ন এবং বিক্ষিপ্ত, তাই এগুলো সত্য থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।
ইতিহাসকে লেখক দেখছেন তথ্যের সমাহার রূপে। কালের সঙ্গে ঘটনার বিবরণই ইতিহাস। এই কাল, ঘটনা আর তার সঙ্গে সম্পর্কিত তথ্যকে একত্র করেই ইতিহাস রচিত হয়।

বুদ্ধদেব বসু সাহিত্যকে সাংবাদিকতা ও ইতিহাস থেকে পৃথক রাখতে চান। কেননা, সাহিত্য সত্যের অপলাপ করতে পারে না আবার তথ্য সমাহারও তার কাজ নয়। সাহিত্য হবে বিশ্বজনীন। সাহিত্যের সঙ্গে সাংবাদিকতা ও ইতিহাসের এই পৃথক্‌করণ যথোপযুক্ত। পাঠক এই পার্থক্যকরণের সঙ্গে একমত হবেন নিঃসন্দেহে। তবে ধাক্কা লাগে কিংবা বলা ভালো চিন্তাকে উসকে দেয়, যখন লেখক এক জায়গায় এসে বলছেন সাহিত্যে সমসাময়িক ঘটনার ব্যবহার বা সমসাময়িক ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাহিত্য রচনা ছদ্মবেশী সাংবাদিকতা, যা সমকালকে অতিক্রম করতে পারে না। ২. এখানে এসে পাঠক থামতে বাধ্য হন, লেখকের সঙ্গে কোথাও একটা বৈপরীত্য অনুভব করেন। সাহিত্যিক বা শিল্পী মাত্রই সংবেদনশীল, অন্যদের চেয়ে তাঁর সংবেদনশীলতা বেশিই। ফলে সমসাময়িক ঘটনাই তাঁর পক্ষে নিস্পৃহ থাকা সম্ভব নয়। ঘটনার বাইরে থেকে দর্শক হওয়ার তার উপায় নেই। ৩. কেননা, তিনি শিল্পী, সাধক তবে সমাজ থেকে দূরে, তপোবনে বসে নিরাসক্ত-নিষ্কাম সাধনায় তাঁর চলে না, তাঁর সাধনা মানবসমাজের মধ্যে থেকে, মানবমনের গতিপ্রকৃতি আর প্রবৃত্তির স্বরূপ অনুধাবনের মাঝে। তাঁর রচনার উদ্দেশ্য আছে, আছে ফল লাভের আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষা ব্যক্তির চেয়ে বেশি সামাজিক। আবার তিনি প্রাতিষ্ঠানিক গবেষকও নন, ঘটনার বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণ করার বিলাসিতা তাঁর জন্য নয়। তিনি ঘটনার অংশভাগী (শারীরিক অথবা মানসিক অথবা উভয়ভাবে)। সমাজের উত্থান-পতনের সঙ্গে তাঁকে জড়াতে হয়। তাঁর সামাজিক সক্রিয় ভূমিকার মধ্য থেকেই শিল্পের উপাদান খুঁজে নেন এবং শিল্পের মাধ্যমেই তিনি পথ দেখানোর চেষ্টা করেন। শিল্পীর এই ভূমিকায় তাঁকে দ্রষ্টার আসনে আসীন করে। ফলে সমসাময়িক ঘটনা শিল্পীর সৃষ্টিতে আসতে পারে। এখন সে সৃষ্টি কালোত্তীর্ণ হতেও পারে আবার না-ও হতে পারে। কালোত্তীর্ণ হওয়া অথবা না হওয়া নির্ভর করে দুটি বিষয়ের ওপর–প্রতিশ্রুতি ও দক্ষতা। এই প্রতিশ্রুতি শিল্পের প্রতি যতটা, সমাজের প্রতিও ততটাই। প্রতিশ্রুতি হলো মানবমনের সুকোমল, সূক্ষ্ম বোধগুলো জাগ্রত করা। এই প্রতিশ্রুতির সঙ্গে দক্ষতার মিলন লেখাকে কালোত্তীর্ণ করতে পারে। কোনো শিল্পের প্রতিশ্রুতি থাকলে দক্ষতার অভাবকে কাটিয়ে উঠতে পারে, কিন্তু প্রতিশ্রুতির অভাব দক্ষতা দিয়ে পোষানো যায় না, এ ক্ষেত্রে শিল্পের উপাদান যা-ই হোক না কেন, তা একটি বিশেষ কালে অথবা বিশেষ শ্রেণিতেই আবদ্ধ হতে পারে।

মানুষের হাসি, কান্না, সুখ, দুঃখ, ঘৃণা, ভালোবাসা, আশা, নিরাশা প্রভৃতি মনোজগতের বিষয়গুলো দেশকাল ভেদে রূপের পরিবর্তন হলেও অন্তর্গত বৈশিষ্ট্যে এক। এই অন্তর্গত বৈশিষ্ট্যকে ধরতে পারা এবং তাকে ফুটিয়ে তুলতে পারার মধ্যে নিহিত থাকে শিল্পের যুগোত্তীর্ণ হওয়ার বীজমন্ত্র। রেমার্কের ‘অল কোয়াইড ইন ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’-এর সুরে যে যুদ্ধবিরোধিতা তাই তো সর্বকালের সব মানুষের কাম্য। সৈনিক পাউলির ভেতরে শান্তির আকাঙ্ক্ষা তা কেবল পাউলির বা উপন্যাস রচনাকালীন নয়, যিনি পড়ছেন উপন্যাসটি তাঁর নিজের যেমন, তেমনই তাঁর স্বকালেরও প্রত্যাশা। গিলসবার্গের কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’-এ শরণার্থীদের যে চিত্র আঁকা হয়েছে, তা কি শুধু একাত্তরের বাংলাদেশের? এই কবিতার শব্দগুলো ফিলিস্তিন, সিরিয়ার অথবা অন্য কোনো দেশের সেসব লোকের কথাই বলে যাচ্ছে, যারা যুদ্ধের বিভীষিকার শিকার হয়ে শরণার্থীর মানবেতর জীবনযাপন করছে। এই কবিতার অন্তর্নিহিত ভাষ্য মানবাত্মার কাছে যে মানবিক পৃথিবীর যে দাবি রাখে একাত্তরের বাংলাদেশে স্থানিক ও কালিক সীমানায় বাধা থাকে না, সব যুগের আবেদন হয়ে সামনে আসে। ভিক্টর জারার ‘তে রিকার্ডো আরমানডা’ গানটির কথা স্মরণ করা যাক। গত শতাব্দীর ষাট-সত্তরের দশকের চিলির প্রেক্ষাপটে রচিত যেখানে আরমানডো-ম্যানুয়েল শ্রমজীবী যুগলের প্রেম, কাজের ফাঁকে সীমিত বিরতিতে মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথা এসেছে, আরও এসেছে আকস্মিক ম্যনুয়েলকে হারিয়ে আরমানডোর বিষণ্নতার কথা। এই শ্রমজীবী যুগলকে আমরা দেখি বিভিন্ন স্থানে, ভিন্ন সময়ে ভিন্ন নামে। তাঁদের উদয়াস্ত পরিশ্রম শেষে পরস্পরের জন্য যে অল্প সময় পায়, তাতে জড়িয়ে থাকে শ্রমক্লান্তি, তবু তার জন্য আছে ভালোবাসাজড়িত প্রতীক্ষা। সেই প্রতীক্ষাও অনেক সময় অনন্ত হয়ে যায়, বিষাদের আবরণে ঢাকা পড়ে যখন প্রতীক্ষিত মানুষটি আর ফেরে না, হারিয়ে যায়। হারিয়ে যায় বিভিন্ন কারণে, কখনো কারখানার কোনো দুর্ঘটনায়, কখনো ন্যায্য দাবির আন্দোলনে ছুটে আসা প্রাণঘাতী বুলেট অথবা অন্য কোনো কারণে। এই আমাদের দেশে আগুনে, ভবন ধসসহ নানা কারণে কর্মক্ষেত্রে কত শ্রমিকের মৃত্যু হয়, হারিয়ে যায় প্রিয়জনের কাছ থেকে। সেই শ্রমিকের জন্য হয়তো অপেক্ষা করে থাকে আরমানডার মতো প্রিয়জন। এইখানে এসে বিংশ শতাব্দীর চিলি, প্রায় প্রতিপাদিক স্থানে থাকা একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। ‘তে রেকার্ডো আরমানডা’ বিশেষ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত হলেও স্বকালকে পেরিয়ে সমকালকে স্পর্শ করে যায়।

শুধু ঘটনাবলিকে সমসাময়িকতার অন্তর্ভুক্ত না করে, কোনো বিশেষ কালের মানুষের চিন্তা এবং তাঁদের জীবনযাপন প্রণালিকে যদি বিশেষকালের সমসাময়িক গণ্য করা হয়, তবে বুদ্ধদেবের উপন্যাসের চরিত্ররাও সমসাময়িকতার চিহ্ন বহন করার দোষে দুষ্ট–এ কথা বলাই অত্যুক্তি হবে না বোধ হয়। কেননা, তাঁর উপন্যাসের চরিত্রদের মানস তাঁদের কালকেই প্রতিনিধিত্ব করছে। স্বাতী, সত্যেন, হারীত, শাশ্বতী, মৌলিনাথ, নীলাঞ্জন, শ্রীপতি প্রমুখ চরিত্রগুলো ঊনবিংশ শতাব্দীর নয়, বিংশ শতাব্দীরই মানসধারী, লেখকের যাপিত সময়ের মধ্যেই চরিত্রগুলোর চিন্তা, সংকট, নৈনায়িক বোধ, দার্শনিক অবস্থান প্রভৃতি প্রোথিত ও উত্থিত। কিন্তু চরিত্রের এই সমকাল ধারণ উপন্যাসগুলোকে কালের সীমানায় বেঁধে রেখেছে বলে মনে হয় না, ফলে সাহিত্যরস আস্বাদনে বাধাও হয় না।
এবার আসা যাক, সাহিত্যে ইতিহাসকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা প্রসঙ্গে। এ কথা সত্য, ইতিহাস কিছু ঘটনার সংকলনমাত্র। দিনপঞ্জি অনুসারে তথ্য সমাহারে ইতিহাসবেত্তার মনোযোগ। এখানে ইতিহাস নীরস, মানুষের বাহ্যিক আচরণে তার আগ্রহ, অন্তলোকের খোঁজ করা সেখানে দূরহ। পাঠক ইতিহাস থেকে ঘটনা ও ঘটনার নেপথ্যে থাকা মানুষ অথবা মানুষদের সম্পর্কিত বিবরণের বিস্তৃত পাঠ নেয়। এটাই তাঁর উদ্দেশ্য, এর বাইরে ইতিহাসের কাছে প্রত্যাশা থাকে না পাঠকের। ইতিহাস জ্ঞাত করে, উপলব্ধি জাগায় না। ইতিহাসের এই সীমানা থেকেই ইতিহাস আশ্রিত সাহিত্যের যাত্রা। ইতিহাস যেখানে তথ্য জানিয়ে দায়ত্ব শেষ করে, ইতিহাস আশ্রিত সাহিত্য তথ্যের পেছনে অনুঘটকের মনস্তত্ত্বের দ্বারটি উন্মোচন করার প্রয়াস নেয়। বহিঃলোক থেকে পাঠককে অন্তঃলোকের দিকে নিয়ে যেতে চায়। কখনো সেখানে কল্পনার আশ্রয় নেওয়া হয় বটে, কিন্তু সে কল্পনা বাস্তবকে উপেক্ষা করে নয়। যে মনোজগৎ তথ্যের নিচে চাপা পড়ে যায়, তাকে আলোকে আনতে দৃশ্যকল্প আর সংলাপ বিনির্মাণে শিল্পীকে কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়। না হলে ইতিহাস আর সাহিত্যে পার্থক্য থাকে না। এই কল্পনা শক্তি আসে অন্তর্দৃষ্টি থেকে যা ইতিহাসকে জীবন দান করে, পাঠককে করে নেয় তার অংশ। দাসবিদ্রোহের কথা ইতিহাসবেত্তার কাছে অবগত হই, কিন্তু এই বিদ্রোহ আশ্রিত উপন্যাস ‘স্পার্টাকাস’ আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে একাত্ম করে। এই একাত্ম করা এবং ভেতরের বাণীটি তুলে আনার মধ্য দিয়ে সাহিত্য ইতিহাসকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রয়োজনীয় করে তুলে। এ কথা সমকালীন ঘটনানির্ভর এবং সুদূর ইতিহাস উপজীব্য উভয় সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তাই ইতিহাস আশ্রিত সাহিত্যকে সাংবাদিকতা এবং সত্যের অপলাপ বলাটা বোধ হয় সত্য থেকেই দূরে।

আগেই বলা হয়েছে, লেখাটি কোনো সমালোচনা না এই গোত্রীয় কোনো কিছু নয়। কেবল পাঠক হিসেবে সক্রিয় থাকার প্রয়াস মাত্র। মানুষ মাত্রই স্বীয় বিবেচনার অধিকার রাখে। এক পাঠকের কাছে যা বিরুদ্ধ, অপর পাঠকের কাছে তা প্রয়োজনীয় বোধ হতেই পারে। পাঠক পড়বেন, স্বীয় চিন্তার পাশে রেখে বিবেচনা করবেন, মেলাবেন আবার পার্থক্যও নিরূপণ করবেন। এটি সব সৃষ্টির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এভাবেই একটি সৃষ্টি আরেকটি সৃষ্টির ভিত তৈরি করে দেয়।

পাদটিকা :
১. বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়।
২. অবশ্য লেখক এখানে রবীন্দ্রনাথকে ব্যতিক্রম মনে করেন, কারণ হিসেবে তিনি জানান, রবীন্দ্রনাথের সহজাত প্রতিভাই তাঁর সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে লেখাকে কালোত্তীর্ণ করে।
৩. বুদ্ধদেব বসুর আরেকটি প্রবন্ধ ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’-তে মত প্রকাশ করেন, শিল্পী হবে অনাসক্ত, দর্শক এবং দর্শয়িতা, তিনি ঘটনার অংশভাগী হতে পারবেন না।