• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ২৯, ২০২১, ১২:২৯ এএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ২৯, ২০২১, ০৬:৪৮ এএম

বিদ্যাসাগর স্মরণ

বিদ্যাসাগর স্মরণ

উনিশ শতকের নবজাগরণের মধ্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটে। বহুকীর্তিমান বাঙালির পদপাতে মুখরিত হয়েছিল সেই সময়। এই নবজাগরণের প্রধান চরিত্র বিদ্যাসাগর। বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী বিদ্যাসাগরের প্রধান পরিচয় তিনি রেনেসাঁস পুরুষ। ইহোজাগতিকতা, যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞান মনস্কতা, নতুন গদ্যরীতি, সমাজ-সংস্কার, নারীশিক্ষার প্রসার, পাঠ্য-সূচি থেকে অলৌকিকতার বিলুপ্তি, চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং মানবমুখিনতার মতো বৈশিষ্ঠ্য, যা ইউরোপীয় রেনেসাঁসকে তুলে ধরেছিল । বিদ্যাসাগর তাঁর জীবন্ত প্রতীক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

অত্যন্ত গ্রামীন, দরিদ্র, ঐতিহ্য ভিত্তিক ও “অনাধুনিক” শিক্ষায় শিক্ষিত পরিবার থেকে বিদ্যাসাগর উঠে এসেছিলেন বলে তাঁর উত্থান এবং পথ-পরিক্রমা ছিল অনেকের চেয়ে অনেক কঠিন । সেই কারণে বিদ্যাসাগরকে ছুঁতে বা তাঁর কাছে পৌঁছাতে পারতেন একেবারে নিঃস্বতম থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরের, সব সম্প্রদায়ের মানুষ, ভিক্ষুক থেকে অস্পৃশ্য, ভদ্রলোক থেকে গ্রামীন অভাব গ্রস্ত নারী-পুরুষ। তাঁর কাছে ধর্ম, সম্প্রদায় হিন্দু-সমাজের জাতিগোত্র, শিক্ষা, বিত্ত-কিছুই কোনো বাধা ছিলনা। উনবিংশ শতাব্দীতে আর কোনো অগ্রনেতা সম্বদ্ধে এমন কথা বলা যায় কিনা সন্দেহ। যে জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লোকের মুখে “বিদ্যেসাগর” হয়ে বাংলার “ফোকলোর” বা লোককথার মধ্যে প্রবেশ করেছেন, যা অন্য কারো সম্বন্ধে বলা যায় না। তাঁর সম্বন্ধে এত লোকগল্প প্রচলিত হয়েছে যে, আমরা শৈশবে তাঁর জীবনী পড়বার আগেই এই গল্পগুলি দিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হই। তাঁর জীবনীকারেরাই তাঁর সম্বন্ধে কিছু গল্প যে কল্পিত; বাস্তব ঘটনা নয়- তা উল্লেখ করে আমাদের “ভ্রমনিরাস” করেছেন। যেমন তার মধ্যে একটি বর্ষায় প্লাবিত ভয়ঙ্কর দামোদর সাতরে পার হয়ে তাঁর মায়ের  কাছে পৌঁছেছিলেন বলে যে গল্প; কিংবা নীলদর্পন অভিনয় দেখতে দেখতে তাঁর রাগ সাহেবের অভিনেতা অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাকীকে চটি জুতো ছুড়ে মারার গল্প। অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের নামে প্রচারিত একাধিক লোকগল্প বাস্তবভিত্তিহীন। তবু আমাদের কথা হলো, এই সব গল্প তৈরি হলো কেন? হলো, এমন এক লোক বিশ্বাস থেকে যা বলতে চায়- এমন যদি কেউ পারে তো একা বিদ্যাসাগরই এটা পারেন- ওই দামোদর সাঁতরে পার হওয়া বা অভিনেতাকে চটি জুতো ছুড়ে মারা। তার কারণ বিদ্যাসাগরের মধ্যে প্রকাশিত ছিল ওই অজেয় মনুষ্যত্বের আরেক দিক, দুর্জয় সাহস আর বীরত্বের পাশাপাশি এক অন্তহীন মানবিক করুণা, যা মানুষকে ভালোবাসার অন্য নাম।

বিদ্যাসাগর জন্মেছিলেন মেদিনিপুরের বীরসিংহ গ্রামের দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে। পিতা ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায় ছিলেন কোলকাতার এক দোকান কর্মচারী। মাতার নাম ভগবতী দেবী। ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায়ের বেতন কখনো মাসে দশ টাকার বেশী হয়নি। দারিদ্র্য তাদের নিত্য সহচর ছিল। সম্পদ বলতে ছিল পুরুষানুক্রমিক চরিত্রবল। বিদ্যাসাগরের জননী ভগবতী দেবীও এ-চরিত্রগুনের অধিকারীনী ছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে বিদ্যাসাগর যদি তাঁর পরিবার থেকে কিছু পেয়ে থাকেন, তবে তা ছিল তাঁর চরিত্রের এই তেজ।

ছবিঃ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। 

পাঁচ বছর বয়সে বীরসিংহ গ্রামে বহুবিবাহিত ভগ্নকুলীন কালীকান্ত চট্টপাধ্যায়ের পাঠশালায় বিদ্যাসাগরের শিক্ষা জীবনের সূচনা হয়। অতি দূরন্ত ও অবাধ্য বালক ছিলেন তিনি। অতিশয় বুদ্ধিমান ছিলেন; শ্রুতিধর বললেও অত্যুক্তি হতো না। আট বছর বয়সে পিতার সঙ্গে ছাব্বিশক্রোশ পথ হেটে তিনি কলকাতায় আসেন। এই পথে আসবার সময়েই মাইলষ্টোন দেখে ইংরেজি সংখ্যা চিনে নেন। কিন্ত কলকাতায় এসে তাঁর ইংরেজি পড়ার কোনো ব্যবস্থা হয়নি। ঠাকুরদাসের ইচ্ছে ছিল জ্যেষ্ঠ সন্তানকে হিন্দু কলেজে ভর্তি করাবেন। হিন্দু কলেজের ছাত্রদের স্বেচ্ছাচারের নিন্দা তখন শুরু হয়ে গেছে। দরিদ্র ব্রাহ্মণের এই অভিলাষ একটু বিষ্ময়কর বই কি! কিন্ত হিন্দু কলেজে পড়ার খরচ বিস্তর-তাই ঈশ্বরচন্দ্রকে ভর্তি করা হলো  শিবচন্দ্র মল্লিকের বাড়ির পাঠশালায়, থাকার ব্যবস্থা হলো জগদ্দুর্লভ সিংহের বাড়িতে। পরবর্তীকালেও অন্যের আশ্রয়ে থেকেই বিদ্যাসাগরকে লেখাপড়া শিখতে হয়েছে।

১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজে প্রবেশ করেন ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্ররুপে। ব্যাকরণ শ্রেণিতে পড়তে পড়তে তিনি ইংরেজি শ্রেণিতেও যোগদেন। দেড় বছর পর তিনি মাসিক পাঁচ টাকা বৃত্তি লাভ করেন, পরে তা আট টাকায় পরিণত হয়। বিদ্যাসাগর এ টাকা ঠাকুরদাসকে পাঠাতেন। ঠাকুরদাস তা জমিয়ে বীরসিংহে জমি কিনেছিলেন—ভবিষ্যতে ঈশ্বরচন্দ্র টোল খুলবেন, এই ধারণা করে। সংস্কৃত কলেজে ঈশ্বরচন্দ্র প্রায় সাড়ে বারো বছর অধ্যায়ন করেন। শুধু ব্যাকরণের নয়, সাহিত্য, অলংকার, বেদান্ত, স্মৃতি, ন্যায় ও জ্যোতিষ শ্রেণির ছাত্র হিসাবেও তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। পড়াশোনা সাঙ্গ করে ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলেজের প্রশংসাপত্র লাভ =\করেন। এর অন্তত  দু-বছর আগে তিনি “বিদ্যাসাগর” উপাধি পেয়েছিলেন। হিন্দু “ল” কমিটির পরীক্ষাও পাশ করেছিলেন, আর প্রায় সাত বছর আগে দিনময়ী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের সময় পাত্রের বয়স চৌদ্দ, পাত্রীর আট। এতঅল্প বয়সে দারপরিগ্রহ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্রকে কেবল পিতার ভয়ে মাথায় টোপর দিতে হয়েছিল। পুত্রের অবাধ্যতারোগ উপশম করার জন্য ঘনঘন প্রহারের ব্যবস্থায় ঠাকুরদাস অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন।

সংস্কৃত কলেজ থেকে পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর  ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগে সেরেস্তাদার বা প্রথম পন্ডিত নিযুক্ত হন। ওই কলেজের সেক্রেটারি ক্যাপ্টেন মার্শাল তাঁর একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। পঞ্চাশ টাকা মাইনের চাকরি পেয়ে ঠাকুরদাসকে কর্মত্যাগ করতে বাধ্য করলেন ঈশ্বরচন্দ্র। বাড়িতে মাসে মাসে তিনি কুড়ি টাকা পাঠাতেন, বাকি ত্রিশ টাকায় দুই সহোদরসহ এগার জনের ব্যয়নির্বাহ হতো। এখানে থাকতেই তিনি হিন্দি ও ইংরেজী ভাষা শিক্ষায় মনোযোগ দেন।

বিদ্যাসাগরের কর্মজীবনের একটি হিসাব দিতে গিয়ে বিনয় ঘোষ জানিয়েছিলেন, ১৮৪১ থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত তাঁর কর্মজীবনের প্রস্তুতির পর্ব বলা যায়। এর মধ্যে ১৮৪১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ১৮৪৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় চার বছর চার মাস কাল তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে একটানা সেরেস্তাগিরি করেন। তারপর প্রায় এক বছর তিন মাস, ৬ এপ্রিল ১৮৪৬ থেকে ১৬ জুলাই ১৮৪৭ পর্যন্ত, সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদকের কাজ করেন। পরে আবার এক বছর নয় মাস, ১ মার্চ ১৮৪৯ থেকে ৪ ডিসেম্বর ১৮৫০ পর্যন্ত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেড রাইটার ও কোষাধ্যক্ষের কাজ করেন।‘ সেই সঙ্গে তিনি এ-ও জানিয়েছেন, ‘একবার  ফোর্ট উইলিয়াম  কলেজ, একবার সংস্কৃত কলেজ, এইভাবে তাঁর প্রথম কর্মজীবন প্রধানত চাকরির টানাটানিতেই কেটে যায়। অবশেষে ১৮৫০ সালের ৫ ডিসেম্বর তিনি সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন এবং তাঁর একমাস কয়েকদিন পরেই (২২ জানুয়ারি, ১৮৫১) কলেজের অধ্যক্ষ পদ লাভ করেন। তখন তাঁর বয়স একত্রিশ বছর। এই সময়ে তাঁর কর্মজীবনের মধ্যাহ্নের শুরু। মাঝখানের অন্তবর্তী সময়কাল সম্পর্কে বিনয় ঘোষের পর্যালোচনা এ রকম—“মধ্যের একুশ থেকে একত্রিশ বছর পর্যন্ত দশটি মূল্যবান বছর অপচয় করেছেন, তা নয়। বাইরের বৃহত্তম সমাজের পাঠশালায় তিনি তাঁর কর্মজীবনের (শিক্ষানবীশি-?) করেছিলেন। গোলদিঘির কলেজের শিক্ষার পরে লাল দিঘির এ—শিক্ষার গুরুত্ব অল্প নয়।” তৎকালিন সামাজিক গঠন প্রক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া বিদ্যাসাগরের মানস-গঠনে একটা প্রভাব ফেলেছিল, বিনয় ঘোষ এ বিষয়ে সবিস্তারে গিয়ে জানিয়েছেন, “ধর্মান্দোলের প্রতি ঈশ্বরচন্দ্রের আস্থা ছিল না। বরং তিনি মনে করতেন, ধর্মান্দোলনে সামাজিক আন্দোলন ব্যাহত হয়”। আর সে-কারণেই এই রকম ধারণার বশবর্তী হয়ে বিদ্যাসাগর তাঁর কর্মজীবনের উদযোগপর্বে, উনিশ শতকের চতুর্থ-দশকে, “তত্ত্ববোধিনী” সভা ও পত্রিকার প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসেছিলেন। ধারণা তাঁর মিথ্যা হয়নি। তাতে তিনি নিজেও উপকৃত হয়েছিলেন এবং তাঁর সান্নিধ্যে অন্যান্য সহকর্মীরাও লাভবান হয়েছিলেন। সভার মধ্যে থেকে তিনি তাঁর ধর্মপ্রবনতার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন।

তৎকালীন পশ্চাৎপদ সমাজের অন্ধকারকে ভেদ করে বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষার প্রসারে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছিলেন। মেয়েদের জন্য ৩৫টি বিদ্যালয় খুলেছেন। বহু বছর আগেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন নারীকে অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত রেখে সমাজ অগ্রসর হতে পারবে না। তাঁর পূর্বসূরি রামমোহন রায় “সতীদাহ প্রথা” রদ করে নারীর জীবন রক্ষা করেছিলেন। বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রবর্তন করে নারীকে জীবস্মৃত অবস্থা থেকে রক্ষা করেছিলেন। বিধবাবিবাহকে তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ বলে মনে করতেন। কাজটি  মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিলনা। বিধবাবিবাহকে আইন সংগত করার জন্য ১৮৫৫ সালে যে-আবেদনপত্র দাখিল করা হয়েছিল তাতে স্বাক্ষর করেছিলেন ৯৮৭ জন ব্যক্তি। সর্বশেষ স্বাক্ষরটি ছিল স্বয়ং বিদ্যাসাগরের। আর এই আবেদনের বিরোধিতাকারী পাল্টা আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন প্রায় ৩৬০০০ ব্যক্তি। বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে এই অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাধাকান্ত দেব। দুই আবেদনের সমর্থকদের সংখ্যার বিশাল তারতম্য দেখে সেই সময়ের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্দ চিত্র পাওয়া যায়। বোঝা যায় কি প্রতিকূল পরিস্থিতি ডিঙিয়ে বিদ্যাসাগরকে অগ্রসর হতে হয়েছিল। শুধু বিধবাবিবাহ নয়, জীবনের প্রতিটি গুরত্বপূর্ণ কাজে বিদ্যাসাগরকে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়। তবে সংখ্যায় কম হলেও কিছু সহযোগীও তিনি পেয়েছিলেন।

উনিশ শতকীয় নব জাগরণের অন্যতম স্তম্ভ ইয়ং বেঙ্গল। ধুমকেতুর মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী শিক্ষক ডিরোজিও একদল যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক ছাত্র তৈরি করেছিলেন, যারা প্রচলিত বিশ্বাস ও সংস্কারকে টলিয়ে দেওয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। “ইয়ং বেঙ্গল” নামে পরিচিত এই যুবকরা ছিলেন বিদ্যাসাগরের অন্যতম ভরসাস্থল। দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ সিকদার, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, হরচন্দ্র ঘোষ, শিবচন্দ্রদেব, রামতনু লাহিড়ীর মতো ইয়ং বেঙ্গলরা বিধবাবিবাহ আন্দোলন ও নারী শিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগরকে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন। উগ্র পাশ্চাত্য আধুনিকতার কারণে সমাজ তাঁদের গ্রহণ করতে চায়নি। ধনী সমাজপতিদের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া প্রাচীন পন্ডিত সমাজের মোকাবিলা করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। বিদ্যাসাগরের মতো বটবৃক্ষতূল্য ব্যক্তিত্বের আশ্রয়ে ইয়ং বেঙ্গল জ্বলে উঠেছিল। রাজা জমিদারদের কাছে, সরকারি প্রশাসনের কাছে বিদ্যাসাগর ছিলেন সমীহ-জাগানিয়া ব্যক্তিত্ব। অকাট্য যুক্তি ও শাস্ত্রীয় পান্ডিত্য দিয়ে নির্বাক করে দিয়েছিলেন গোড়া ও যুক্তিবিমূখ পন্ডিতদের।  ১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রথম বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। এই বিয়ের আয়োজনে ইয়ং বেঙ্গলরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

বিধবাবিবাহ প্রবর্তন করতে গিয়ে বিদ্যাসাগর জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল এবং কিছুদিন পথে চলাচল করার সময় তিনি লাঠিয়াল রেখেছিলেন। বিধবাবিবাহ ব্যয় নির্বাহে অকাতরে অর্থ ব্যয় করেছেন তিনি। বিদ্যাসাগরের তেজস্বী চরিত্রের অন্যতম দিক হচ্ছে, কোনো প্রতিকূলতাই তাঁকে সংকল্পের অটলতা থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলাভাষায় গদ্যকে রসসমৃদ্ধ সহজগতি করেন। আগে প্রচলিত গদ্যধারা বড় বেশি নীরস, সুমধুরতাবর্জিত, কষ্টবোধক ছিল, যা পান্ডিত্যের দ্যোতনাই প্রকাশ করত। পাঠককুলের মহাকাশে সরস আবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হতো। বিদ্যাসাগরই প্রথম সাধু গদ্যের সরস উপস্থাপনা শুরু করেন। ছন্দময় পেলব কোমল ভাষা যা হৃদয়ে দোলা দেয়, পড়তে পড়তে বড় বেশি আপনবোধ হয় যেন। বৃষ্টির টুপটাপ বা পিয়ানোর টুংটং যেন গদ্যে তখন। এক আপন বেগে চলা স্রোতস্বিনীর পাঠক মনে ছলাৎছল যেন!

পাঠ্যপুস্তক, রচনায় ও অনুবাদ-চর্চায় বিদ্যাসাগরের জীবনের অধিকাংশ কাল ব্যয় হয়েছে একথা সত্য। নব্য শিক্ষার্থীদের জন্য যেসব পাঠ্যবই বিদ্যাসাগর প্রনয়ন করেছিলেন, তাতে আর কিছু না হোক তার উদ্ভাবন শক্তির পরিচয় আছে। গত শতাধিক বৎসরে বর্ণপরিচয়মূলক যত বই বাংলায় লেখা হয়েছে, তার মধ্যে কোনোটি বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়কে অতিক্রম করতে পারেনি। যোগীন্দ্রনাথের “হাসি-খুশী” ছাড়া এই সঙ্গে নাম করা যায় এমন আর কোনো বইয়ের কথা মনে পড়ে না। ভাষার রহস্য আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ ভঙ্গির একটা চিরত্ব অর্জন করতে পেরেছিলেন বলেই “বর্ণপরিচয়” লেখা সম্ভব হয়েছিল। এই বইয়ের প্রতি শ্রেষ্ঠ সম্মান নিবেদন করতে গিয়ে জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- “সেদিন পড়িতেছি, জল পড়ে পাতা নড়ে”। আমার জীবনে এইটেই আদি কবির প্রথম কবিতা। সেদিনের আনন্দ আজও যখন মনে পড়ে  তখন বুঝিতে পারি, কবিতার মধ্যে মিল জিনিসটার এত প্রয়োজন কেন। মিল আছে বলিয়াই কথাটা শেষ হইয়াও শেষ হয় না—তাহার বক্তব্য যখন ফুরায় তখনো তাহার ঝংকারটা ফুরায় না, মিলটাকে লইয়া কানের সঙ্গে মনের সঙ্গে খেলা চলিতে থাকে। এমনি করিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া সেদিন আমার সমস্ত চৈতন্যের মধ্যে জল পড়িতে ও পাতা নড়িতে লাগিল”।  মৌলিক সাহিত্য রসজ্ঞতার পরিচয় ছিল বলেই এই বাক্য বালক রবীন্দ্রনাথের মনকে এতটা নাড়া দিতে পেরেছিল।

শিশুশিক্ষা ক্ষেত্রে তার অবদান অসাধারণ। প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধে শিশুশিক্ষায় তিনি প্রবর্তন করেন আধুনিক চেতনার বিজ্ঞান ও প্রকৃতি মনস্কতা—যাতে শৈশব থেকেই শিশু ও বালক বালিকাদের মন যুক্তিবাদী চেতনায় গড়ে  উঠতে পারে, তেমন পাঠ্যপুস্তকের অভাবে তার লেখা বর্ণপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ, বোধদয় ইত্যাদি বই। নীতি-নৈতিকতা শিক্ষায় এই পন্থার অনুসরণ করে লিখেছেন একাধিক বই।

“দয়ার সাগর”  “করুণার সাগর” বিদ্যাসাগর তাঁর জীবনের সিংহভাগই ব্যয় করেছেন শিক্ষাবিস্তারে। নিজ গ্রাম বীরসিংহে ১৮৫৩ সালে অবৈতনিক ও আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপন থেকে শুরু করে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত ৩৭ বছর ধরে তিনি একটি নর্মাল স্কুলসহ ২০টি মডেল বিদ্যালয়, ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় ও একটি কলেজ স্থাপন করেছিলেন। আজকের শিক্ষা ব্যবসায়ীরা হয়তো জানেন না বিদ্যাসাগরের এই প্রচেষ্টা ছিল শিক্ষাবিস্তারের লক্ষ্যে, বিত্ত অর্জনের জন্য নয়।

ইতালীয় রেনাসাঁসের সঙ্গে প্রায়ই বাংলার নবজাগরণের তুলনা করা হয়। ইতালীয় রেনেসাঁসের নায়কদেরও ছাড়িয়ে গিয়েছে বিদ্যাসাগররের কীর্তি। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, বিধবাবিবাহ, দুস্থ-পীড়িতকে সেবাদান প্রভৃতি সমাজহিতৈষী কাজের জন্য বিদ্যাসাগর যে শ্রম, অর্থ ও বিদ্যা ব্যয় করেছেন এর কোনো তুলনা ইতালীয় রেনেসাঁসের ইতিহাসে নেই। ইতালীয় রেনেসাঁসের হিউম্যানিষ্টরা ছিলেন সমাজ বিচ্ছিন্ন ‌আত্মকেন্দ্রিক মানুষ। বিদ্যাসাগর ছিলেন মানব সেবায় উৎসর্গীকৃত প্রাণ। তিনি ছিলেন পরাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। প্রখর আত্মমর্যাদা ও অসামান্য  তেজস্বিতায়, বিপন্ন মানুষের দুর্দশা মোচনে, শিক্ষা বিস্তারে, নারী অধিকার রক্ষায় খাঁটি হিউম্যানিস্ট বিদ্যাসাগর ছিলেন অতুলনীয়। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলিছিলেন, “ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব”।

সমাজ সংস্কারে আধুনিকতার জাজ্জ্বল্যমান প্রতীক বিদ্যাসাগর ধর্মীয় অনাচার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ইহজাগতিকতাকে প্রাধ্যন্য দিয়ে। উপমহাদেশে ও বিশ্বের নানা স্থানে যখন সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তখন বিদ্যাসাগরের  মানবকেন্দ্রিক ইহজাগতিকতাকে স্মরণ করা একান্ত জরুরী। গ্রিক পুরাণের বিদ্রোহী মহানায়ক প্রমিথিউস। তিনি স্বর্গ থেকে আগুন এনে মানুষকে দিয়েছিলেন। মানবপ্রেমিক প্রমিথিউসকে এজন্য যন্ত্রণা ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতবর্ষে রেনেসাঁসের আলোকবর্তিকা হাতে প্রমিথিউসের ভূমিকাই পালন করেছেন বিদ্যাসাগর। রেনেসাঁসের নায়কদের মধ্যে তিনি ছিলেন অনন্য, একক ও নিঃসঙ্গ।

 

সহায়ক-সূত্রঃ 

1) বিনয় ঘোষ ২০১১-বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ কলকাতা, ওরেয়েন্ট ব্লাক সোয়ান।

2) আনিসুজ্জামান-বিদ্যাসাগর ও অন্যেরা। অন্যপ্রকাশ। 

3) আহম্মেদ রফিক-নানামাত্রায় অনন্য বিদ্যাসাগর। কালি ও কলম, সপ্তদশ বর্ষ. নবম-দশম সংখ্যা. কার্তিক-অগ্রহায়ণ ১৪২৭।

4) সৌভিক রেজা- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরঃ একটি সাধারণ পর্যালোচনা। কালি ও কলম, সপ্তদশ বর্ষ. নবম-দশম সংখ্যা. কার্তিক-অগ্রহায়ণ ১৪২৭।

5) রাজীব সরকার- বিদ্যাসাগরঃ নিঃসঙ্গ প্রমিথিউস। কালি ও কলম, সপ্তদশ বর্ষ. নবম-দশম সংখ্যা. কার্তিক-অগ্রহায়ণ ১৪২৭।

6) পবিত্র সরকার-কতটুকু আছেন, কতটুকু নেইঃ বিদ্যাসাগর। কালি ও কলম, সপ্তদশ বর্ষ. নবম-দশম সংখ্যা. কার্তিক-অগ্রহায়ণ ১৪২৭।

7) দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়ঃ আগুনটা আজো সমাজ-আশ্রয়ী কালি ও কলম, সপ্তদশবর্ষ, নবম-দশম সংখ্যা কার্তিক-অগ্রহায়ন ১৪২৭।

 

লেখকঃ সংস্কৃতি কর্মী ও সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা।

দ্রষ্টব্যঃ- প্রকাশিত লেখাটি লেখকের একান্ত নিজস্ব মতামত এবং এর দায়-​দায়িত্বও লেখকের একান্ত নিজস্ব।