জগদীশ চন্দ্র ঘোষ, ফরিদপুরে যিনি সকলের কাছে প্রিয় তারাপদ স্যার নামেই পরিচিত। তাঁর জন্ম ১৯২৮ সালের ০৬ আগস্ট, মানিকগঞ্জের কাঞ্চনপুর গ্রামে, মাতুলালয়ে। তার বাবা শহীদ যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, মা প্রফুল্ল বালা ঘোষের জ্যেষ্ঠ সন্তান তিনি। গত বছর ৪ এপ্রিল এই অকৃতদার প্রবীণ সাংবাদিক এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক করোনায় আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী তারাপদ স্যার ফরিদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে সুদীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছেন এবং ৪০ বছর যাবত ‘দ্যা বাংলাদেশ অবজারভার’ ফরিদপুর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে সেবারত ছিলেন ফরিদপুরবাসীর এই বাতিঘর। ২০১৯ সালে ‘আইপিডিসি প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক’ সম্মাননা পেয়েছিলেন তিনি। আজ ৬ আগস্ট শ্রদ্ধেয় এই মানুষটির ৯৩ তম জন্মবার্ষিকী। এই বিশেষ দিনটিতে তাঁকে স্মরণ করেছেন সুদূর ইংল্যান্ড থেকে তাঁরই একজন প্রিয় ছাত্র মোহম্মদ ইদ্রিস।
১৯৬০ সালে ময়েজউদ্দিন হাই স্কুলের অংকের মাষ্টার শ্রী জগদীশ চন্দ্র ঘোষ যখন ফরিদপুর হাই স্কুলের শিক্ষক হয়ে এলেন তখন আমি হাই স্কুলের ক্লাস সিক্সের ছাত্র। তখন থেকেই তাঁর কাছে অংক শেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাঁকে আরও কাছ থেকে জানার সুযোগ হয় ক্লাস নাইনে ইলেকটিভ ম্যাথস নেয়ার ফলে।
ভাত-খাওয়া বাঙালির উন্নত কপোল, গোল মুখ, মাথা ভরা ঘন কালো চুল, দাড়ি-গোঁফ ক্লিন শেভ করা, উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের এই সুঠামদেহি শিক্ষক প্রত্যেকদিন একই ধাঁচের পোশাক পরে স্কুলে আসতেন।
ধোপায় ধোয়া, ধপ ধপে সাদা শার্ট আর সাদা পায়জামা। এই ছিল তার পোষাক । তিনি শার্ট গায়ে দিতেন কলার উঁচু করে এবং বোতাম খোলা রেখে । তিনি অন্য কোন পোষাক পরতেন না, এমন কি সনাতন ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানে মালকাচা দিয়ে ধুতি পরার প্রচলন থাকলেও তিনি তা পালন করতেন না। আমি তাঁকে কোনো দিন প্যান্ট শার্ট পরতে দেখি নাই, অন্য রঙের শার্ট গায়ে দিতে দেখি নাই। আমরা বলতাম প্রেমে ব্যর্থতা, অন্যরা বলতো বৈষ্ণব ধর্ম। লুঙ্গি আর ধুতি দিয়ে যারা মানুষের ধর্ম নির্ধারণ করতে অভ্যস্ত ছিল তাদের অসুবিধার অন্ত ছিল না।
লেখক মোহাম্মদ ইদ্রিস, ৪৫ বছর যাবৎ ইউকে প্রবাসী। প্রবাসী অধিকার আন্দোলনে এক প্রখ্যাত নাম। আশির দশকের শুরুতে যুক্তরাজ্যে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের ফরিদপুরের মোহাম্মদ ইদ্রিস। তখন তাঁকে নিয়ে ব্রিটেনে বড় মুভমেন্ট হয় এবং যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম শহরে তাঁকে নিয়ে স্লোগান উঠেছিল, ''মোহাম্মদ মাস্ট স্টে''।
জগদীশ চন্দ্র ঘোষের মূল এবং প্রথম পরিচয় অংকের শিক্ষক হিসাবে। তিনি আমাদের সাধারণ গণিত এবং নৈর্বাচনিক গণিত দুটোই পড়াতেন। হাই স্কুলে তখন সায়েন্স ছিলনা। কলেজে সায়েন্স পড়ার ইচ্ছা থাকলে স্কুলে ইলেকটিভ ম্যাথস পড়তে হতো। ভালো ছাত্ররা সবাই পড়তো জেলা স্কুলে। হাই স্কুলে ইলেকটিভ ম্যাথ পড়ার ছাত্র ছিল কম। সেই সুবাদে ইলেকটিভ ম্যাথ ক্লাসের সব ছাত্রদের তিনি কাছ থেকে চিনতেন এবং নাম ধরে ডাকতেন।
ক্লাস নাইনের হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় ইলেকটিভ ম্যাথস এ ৮৫ নম্বর পেয়ে স্যারের নজরে পড়ে গেলাম। তিনি আমাকে শিক্ষকদের বসার ঘড়ে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি ১৫ নম্বর কম পেলে কেন?” ৩৩ নম্বর পেলে পাশ, আর ৮০ নম্বর পেলে লেটার, আমি ৮৫ নম্বর পেয়েছি তাতে স্যারের মন ওঠে নাই। আমি কি বলবো তা চিন্তা করার আগেই স্যার বললেন, “এখন থেকে ১০০ পাওয়ার চেষ্টা করবে। মেট্রিকে ফার্স্ট ডিভিশন পেতে হবে।” ব্যস, ঐ পর্যন্তই কথা।
প্রাইমারি স্কুলে অংকে ১০০ পেয়েছি তাতে বিরাট কিছু মনে হয় নাই। কিন্তু ক্লাস নাইন-টেন এ যে ১০০ পাওয়া যায় সে কথা কোনো দিন চিন্তা করি নাই। কেউ কোনোদিন বলেও নাই। স্যারের কথায় আমার সাহস বাড়ল। নিজের সামর্থ্য সম্বন্ধে আস্থা আসলো। বড় হবার সখ জাগলো। ক্লাস নাইনের বার্ষিক পরীক্ষার পরে স্যার আবার আমাকে শিক্ষকদের বসার ঘরে ডেকে নিলেন এবং বললেন, “তোমার খাতার নম্বর গুলো যোগ করে দেখতো, ১২০ হয় কেন?'' এবার সাহসের সাথেই বললাম, “স্যার, আপনি দশটি প্রশ্নের উত্তর দিতে বলেছিলেন, আমি বারোটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি।‘ স্যার রাগ করতে পারে তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু তিনি রাগ করলেন না। হেসে দিলেন, “তুমি আমাকে খাটিয়েছো, তোমাকে ১০০ দিব না ৯৯ দিব।'' আমি বললাম, “স্যার, এখন আপনি ৩৩ দিলেও আমার কোনো অসুবিধা নাই।'' স্যার বললেন, “এই দেখ, ৬ মাসের মধ্যেই তোমার কত উন্নতি হয়েছে! অংক করতে শিখেছ কথাও বলতে শিখেছ। মানুষের জন্য কিছুই অসম্ভব নয়। তোমার বাবা গরীব মানুষ, তোমাকে বড় হতে হবে।''
১৪ বছর বয়সী ছাত্র আর ৩৬ বছর বয়সি শিক্ষকের মধ্যে এমন কথোপকথন অন্য কোথাও অন্য কোনো দিন হয়েছে কি না, আমি যানি না। তবে, স্যারের এই কথা গুলো আমার মনে যে গভীর দাগ কেটেছিল তা মুছে না গিয়ে এখনও আমার গর্ব, প্রত্যয় এবং আত্মবিশ্বাসের ভিত্তিমূল হয়ে আমাকে শক্ত রাখছে।
বড় হওয়ার অর্থ কি? আমি কতটুকু বড় হয়েছি- তা জানি না। আমি ইংল্যান্ডের ইংরেজদেরকে ভারতীয় পদ্ধতিতে বড় বড় সংখ্যার বর্গমূল নির্ণয় করা শিখিয়েছি, বৃত্তের পরিধি এবং ব্যাসের অনুপাত নির্ণয়ে পুরাতন ভারতীয় নিয়ম ব্যাখ্যা করেছি। আর এই যে বিদেশ বিভুঁইয়ে মাথা উঁচু করে ,নিজের আত্মপরিচয় অক্ষুণ্ণ রেখে বেঁচে আছি, জীবন যুদ্ধে টিকে আছি- তা যদি বড় হবার পরিমাপ হয়, তবে সে বড় হওয়াতে আমার অংক শিক্ষকের অবদান অপরিসীম।
আমাদের সময় “অংকের জাহাজ বলে একটা কথা প্রচলিত ছিল। যে শিক্ষক ভালো অংক করতে পারতো তাঁকে অংকের জাহাজ বলা হতো। জগদীশ চন্দ্র ঘোষ ছিলেন ফরিদপুর শহরে সর্বজন স্বীকৃত ''অংকের জাহাজ''। তিনি নিজে কেবল মাত্র মেট্রিক পাশ করেই, মেট্রিকের নৈর্বাচনিক গণিত অনায়াসে পড়াতেন। সরকারি আইন মান্য করে, হাই স্কুলে বিএসসি পাস করা একজন অংকের শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল বটে কিন্ত তাকে নৈর্বাচনিক গণিতের কোনো ক্লাস নিতে দেয়া হতো না। জগদীশ চন্দ্র ঘোষের চারণক্ষেত্রে অন্যের ''প্রবেশ নিষেধ ছিল''!
অবশেষে ভদ্রলোক অপমানিত বোধ করে হাই স্কুলের চাকরি ছেড়ে অন্য স্কুলে চলে যান। স্যারের অনুগত ছাত্র, আমরা অন্যদের বললাম, এই নতুন বিএসসি পাস শিক্ষক ছিল জগদীশ চন্দ্র ঘোষের কাছে নস্যি মাত্র। নস্যি কথাটা-ই ব্যবহার করলাম। কারণ, ক্লাসে ঢুকে প্রথমে পকেট থেকে বেড় করে হোমিওপ্যাথিক ওষুধের একটা বড়ি খাওয়া আর রূপালি রঙের ছোট্ট ডিব্বা থেকে নস্যি নেয়া, সেই কালে বয়স্ক শিক্ষকদের মধ্যে ভয়ানক জনপ্রিয় ছিল।
জুতা আবিষ্কারের জন্য হবুচন্দ্র রাজার আহুত বাংলা বিজ্ঞান সম্মেলনে আমাদের কোনো শিক্ষক অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে আমরা জানতাম না, তবে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সৌজন্যে এই সমস্ত ''চশমা পরা উপাধি-ধরা'' বিজ্ঞানীদের উনিশ পিপে নস্যি ব্যবহার করার খবরটা তাদের জানা ছিল- এতে কোনো সন্দেহ ছিল না।
জগদীশ চন্দ্র ঘোষ হোমিওপ্যাথিক ওষুধের বড়ি খেতেন না, তিনি চশমা পরতেন না, তাঁর কোনো উপাধি ছিল না, তবে তিনি নস্যি নিতেন।
অংকের এই জাহাজ খানা ‘সরল কর’ অংক দেখলেই বলতেন ''ঘাইষ্যা অংক'' যোগ-বিয়োগ করতে পারলেই এই অংক করা যায়, বুদ্ধি লাগে না।' ঐকিক নিয়মের অংক তিনি পছন্দ করতেন। কারণ, এতে ''বুদ্ধির চর্চা আছে ''।
বৃত্ত আঁকতে তাঁর কম্পাসের দরকার হতো না। ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দাঁড় করিয়ে, তর্জনী আর মধ্যাঙ্গুলের মাঝে কলম রেখে হাতের কবজি ঘুরিয়ে তিনি যে বৃত্ত আঁকতেন -তা কম্পাস ব্যবহার করে আঁকা বৃত্তের মতই নিখুঁত গোলাকার হতো।
ট্রিগোনমিট্রি পড়ানোর সময় চোখের অনুমানে তিনি ৬০ ডিগ্রি কোণ আঁকতেন, চান্দা দিয়ে মেপেও তাতে ১ মিনিট ভুল ধরা যেত না। বাম হাতে ডাস্টার আর ডান হাতে চক নিয়ে তিনি যখন ব্লাক বোর্ডে অংক করতেন তখন ক্লাসরুম পিন-ড্রপ সাইল্যান্ট হয়ে যেত। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমরা দেখতাম যেন চিত্রকরের পাটার সামনে দাড়িয়ে একজন শিল্পী ছবি আঁকছে।
‘অংকের-শিল্পী’ বলে কোনো বিশেষণ পদ বাংলা ভাষায় নাই। তবে, একমাত্র জগদীশ চন্দ্র ঘোষের স্বার্থেই এমন একটা পদ থাকা উচিত ছিল।
পাটিগণিতের কঠিন সমস্যা গুলো তিনি সমাধান করতেন এবং সহজ ব্যাখ্যা করে কাঠখোট্ট অংক গুলোকে রসাত্মক করে তুলতে পারতেন। ক্লাস টেনে একদিন তিনি একটি অংক করতে বললেন, ''একটি শামুক একটি পিচ্ছিল খুঁটির নিচ থেকে উপরের দিকে ওঠার চেষ্টা করছে। এক ঘন্টায় শামুকটি চারফুট উপরে ওঠে এবং পরের ঘন্টায় পিছলিয়ে এক ফুট নিচে নেমে যায়। ৩৪ ফুট উঁচু এই খুঁটির মাথায় পৌঁছাতে শামুকটির কত সময় লাগবে?''
আমাদের মধ্যে একদল বলল, যেহেতু প্রতি ২ ঘন্টায় শামুকটি সাকুল্যে ৩ফুট উপরে উঠে সুতরাং ৩৪ ফুট উঠতে সময় লাগবে ২২ ঘন্টা ২০ মিনিট। আর একদল বলল, শেষের ঘন্টায় ৪ ফুট উপরে উঠে খুঁটির মাথায় পৌঁছে যাবার পর তার পরের ঘন্টায় ১ ফুট নিচে নামার সময় যোগ দেয়ার কোনো দরকার নাই কারণ শামুক খুঁটির মাথায় পৌঁছে গেছে।
প্রথম ৩০ ফুট উঠতে সময় লাগবে ২০ ঘন্টা এবং শেষের ৪ ফুট উঠতে সময় লাগবে ১ ঘন্টা। সুতরাং, মোট ২১ ঘন্টায় শামুকটি খুঁটির মাথায় পৌঁছে যাবে।
স্যার বললেন, ২১ ঘন্টা যারা বলেছে তাদের উত্তর টি শুদ্ধ। কারণ, তারা সঠিক যুক্তি ব্যবহার করেছে। শামুকটি খুঁটির মাথায় পৌঁছে যাবার পরে আর সময় গণনার প্রয়োজন নাই। এটা যুক্তিপূর্ণ কথা। তাই তোমাদের উত্তর শুদ্ধ। তবে পুরো প্রশ্নটাই অযৌক্তিক। একটা শামুক প্রথম এক ঘন্টা কেবল উপরে উঠবে আর পরের এক ঘন্টা কেবল নিচে পড়বে এটা কোনো যুক্তিপূর্ণ কথা হতে পারে না। সুতরাং, এই অংকটার কোনো যুক্তিপূর্ণ সমাধান হতে পারে না। প্রশ্ন শুদ্ধ না হলে উত্তর শুদ্ধ হয় না। ক্লাস টেনের অংক করার জন্য এত যুক্তির দরকার নাই। তবে, কথাটা মনে রেখো ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। জীবনের উপকার হবে। সঠিক উত্তর পেতে হলে সঠিক প্রশ্ন প্রয়োজন। 'অংক আর যুক্তি একই জিনিস। একটির প্রকাশ সংখ্যায়, অন্যটির প্রকাশ কথায়।'
১৫ বছর বয়সে, সেদিন স্যারের সব কথা বুঝি নাই কিন্ত কথাগুলো শুনতে খুব ভালো লেগেছিল।
পাটিগণিতের সিঁড়ি-ভাঙ্গা অংক, ল.সা.গু আর গ.সা.গু নির্ণয় করার মতো নিরস বিষয়ের বাইরে, যুক্তির মাধ্যমে অংক করা যায় স্যারের মুখ থেকে প্রথম শোনা কথাগুলো পরে অবশ্য বৃটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের লেখায় পড়ে আনন্দ পেয়েছি। যে বয়সে মানুষ ভয় পেয়ে অংক করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সেই বয়সে স্যারের কথাগুলো অংক করার প্রতি আমার আগ্রহ বাড়িয়েছে। অংকশাস্ত্র আনন্দের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
কর্মজীবি মানুষের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে বেসরকারি রাজেন্দ্র কলেজে ১৯৬০ সালে নাইট সেকসন খোলা হয়। জগদীশ স্যার সেই নাইট কলেজের প্রথম ব্যাচে ভর্তি হন এবং নাইট কলেজের ছাত্র হিসাবে প্রথমে আই.এ এবং পরে বি.এ পাশ করেন। উভয় পরীক্ষাতেই তাঁর একটি সাবজেক্ট ছিল অংক কিন্ত কোনো পরীক্ষায় তিনি অংকে ১০০ নম্বর পান নাই; এমনকি হাই স্কুলের কোনো পরীক্ষায়ও না।
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন একদিন সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “স্যার, আপনি নিজে কোনো পরীক্ষায় অংকে ১০০ নম্বর পান নাই, তাহলে আমাকে কেন ১০০ পেতে এত চাপ দিয়েছেন?
তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “আমাকে কেউ ১০০ পেতে বলে নাই। আমি অংকে ৮০ পেলে অংকের শিক্ষক আমার প্রশংসা করতো। আমি অল্পতেই তৃপ্ত হয়ে গেছি; বড় হতে পারি নাই। আমি চাই তোমরা বড় হও।''
এরপর তিনি ছোটখাটো একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তার সারমর্ম এই রকম: ''আমি আমার ছাত্রদের সাফল্য দেখে ঈর্ষান্বিত হই না, খুশি হই। পিতার চেয়ে পুত্র বড় চাকরি করবে, বেশী আয় করবে এটা সব পিতাই ইচ্ছা করে। কিন্ত শিক্ষকের চেয়ে ছাত্র বেশী প্রতিভাবান হবে তা সব শিক্ষক ইচ্ছা করে না। মেনে নিতেও পারে না। তারা ছাত্রদের প্রতিভা বিকাশের সহায়ক নয়, অন্তরায়। সব মাষ্টার মহাশয় শিক্ষক নন। আমি শিক্ষক।বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইনকে আমরা চিনি কিন্ত তাঁর পিতা অথবা শিক্ষক কাউকে চিনি না। আমার কোনো ছাত্র যদি আইনস্টাইন অথবা ছাত্রী যদি মেরি কুরির মতো বড় বৈজ্ঞানিক হতে পারে তা হলে আমি হব পৃথিবীর সবচেয়ে পরিতৃপ্ত শিক্ষক। আমার কাজ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা নয়, শিক্ষিত মানুষ তৈরি করা। তোমরা আমার চেয়ে বড় ম্যাথমেটিসিয়ান হবে। আমি তোমাদের কাছে অংক শিখবো। এটা হবে আমার জীবনের বিরাট প্রাপ্তি।''
ছাত্র ভালো রেজাল্ট না করতে পারলে শিক্ষকের কিছু দায়িত্ব বহন করতে হবে এমন কথা তখনকার দিন সব শিক্ষকের চিন্তার মধ্যে ছিল না। পরীক্ষায় কোনো ছাত্র রেজাল্ট খারাপ করলে আমাদের হাই স্কুলের অন্য একজন শিক্ষক খুব গর্ব করে বলতেন: “বাবুর্চি যতই ভালো হোক, আউশ ধানের চাল দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করা যায় না।”
তিনি ছিলেন নিরামিষাশী ব্রাহ্মণ, তিনি কেমন করে আমিষ প্রধান খাদ্য বিরিয়ানির স্বাদ জানেন সে কথা জিজ্ঞেস করার সাহস আমাদের ছিল না। শিক্ষকের মুখ থেকে উচ্চারিত মিছরির ছুরির মতো আঘাত করা এমন কথা আমাদের আত্মবিশ্বাসের কতটা ক্ষতি করেছে- তা আমরা বুঝি নাই।
জগদীশ চন্দ্র ঘোষ আমাদের পক্ষ হয়ে তা বুঝতেন। তিনি বলতেন, “শিক্ষা যদি ছাত্রদের আত্মবিশ্বাস উন্নত করতে না পারে তাহলে তোমাদের কি উপকার হবে? শিক্ষকদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে এক সময় ফ্রান্সের ছেলেরা দলে দলে স্কুল থেকে পালিয়েছে আর ফ্রান্সের দুর্দিনে এই সমস্ত স্কুল পলাতক ছেলেরাই ফ্রান্সকে রক্ষা করেছে। আমি চাই আমার ছাত্র-ছাত্রীরা মেরুদন্ড সোজা রেখে মাথা উঁচু করে চলতে শিখুক।''
তিনি মাঝে মধ্যে বলতেন, ''মানুষ অজ্ঞ হয়ে জন্ম গ্রহণ করে, বোকা হয়ে নয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষকে বোকা বানায়। এই শিক্ষা ব্যবস্থার ধারক ও বাহক সামর্থের অতিরিক্ত সন্মান পাওয়া শিক্ষকদের মধ্যে প্রকৃত শিক্ষক খুব কম। স্কুলে যারা চাকরি করে তারা সবাই শিক্ষক নয়।''
জগদীশ চন্দ্র ঘোষ একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, শিখতে উৎসাহ দিয়েছেন। আমাদের আত্মবিশ্বাস উন্নত করেছেন, গর্বিত হতে শিখিয়েছেন, আমাদের উপকার করেছেন।
১৯৬৫ সালে মেট্রিক পাশ করার পরেও আমি স্যারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছি। প্রথমে ঢাকা এবং পরে ইংল্যান্ড যাওয়ার পরে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয় নাই; তথাপি যখনই আমি ফরিদপুর গেছি তখনই স্যারের সাথে দেখা করেছি।
স্কুলের শিক্ষকতা আর প্রাইভেট টিউশনির ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি আমার সাথে কথা বলার সময় করেছেন। ধর্ম, রাজনীতি, নৈতিকতা, আদর্শ নানা বিষয়ে আমাদের আলাপ হয়েছে। প্রথম প্রথম তিনি একাই বলতেন, আমি শুনতাম। পরে অবশ্য অবস্থার পরিবর্তন হয়। আমাদের কথাবার্তা আলোচনার রূপ নেয়।
এই সমস্ত কথোপকথন থেকে স্যারের জীবন-দর্শন আর কর্মযজ্ঞের যে ধারণা আমি পেয়েছি তাতে কোনো সন্দেহ নাই যে, সনাতন ধর্মীয় পরিবারে জন্ম হলেও বেদ-শাস্ত্র অথবা পূরাণ-কাহিনী বিষয়ে তিনি খুব বেশী মনযোগ দিতেন না। তবে উনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু ধর্ম সংশোধন এবং পুনর্জাগরণ দুটো আন্দোলনকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। রাজা রামমোহন রায় এবং স্বামী বিবেকানন্দ দুজনকেই তিনি মহাপুরুষ মনে করতেন।
তিনি ব্রাহ্মসমাজ মন্দির এবং রামকৃষ্ণ মিশন দুটি প্রতিষ্ঠানকে সমান মর্যাদা দিতেন। যদিও ততদিনে ফরিদপুর সদর হাসপাতালের সামনে ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরটি বন্ধ হয়ে গেছে, তবুও তিনি এই প্রতিষ্ঠানের শুরু করা ধর্ম সংশোধনবাদের প্রশংসা করতেন এবং একই সময়ে তিনি চরকমলাপুরের রামকৃষ্ণ মিশনের কর্মযজ্ঞ এবং পরিচালন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতেন।
রামমোহন রায়ের সংস্কার এবং বিবেকানন্দের পূণর্জাগরণ আন্দোলন একে অন্যের বিপরীত। বাঙালি হিসেবে দুইজন মানুষকে শ্রদ্ধা করা চলে কিন্ত দুজনের মতবাদ সমানভাবে সমর্থন করা যায় না। আমার এই উক্তির প্রতিবাদ করে তিনি বলেছিলেন, ‘সময়ের প্রবাহে তির্যক অথবা নতুন শক্তির টানে আর ধাক্কায় পুরাতন আন্দোলন নতুন পথে চললে তাকে বিপরীত বলা যায় না।” তিনি আরও বলেছিলেন, “ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে সতী-দাহ প্রথার বিরোধিতা করে রাজা রামমোহন রায় আর দ্বারকানাথ ঠাকুর যে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিলেন, ষাট বছরের মধ্যে তা কেশব চন্দ্র সেন আর দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুরের হাতে ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনে পরিণত হয়। ইউনিটারিয়ান খ্রিষ্টানদের একেশ্বরবাদের অনুকরণ এবং গির্জাঘড়ের মতো প্রার্থনালয় স্থাপন করে ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলন সমালোচনার মুখে পড়ে যায়। সংস্কারের নামে এরা নতুন ধর্ম সৃষ্টি করছে। এমন কথা উঠতে থাকে। সংস্কার আন্দোলনের এই ক্রান্তি লগ্নে আবির্ভূত হন বাংলার সক্রেটিস, যুক্তিবাদী পুরুষ রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। তাঁর বাণী ছিল নতুন এবং সরল। যেখানে মানুষ সেখানে ভগবান। যত্র জীব তত্র শিব। মানুষের সেবাই পরমধর্ম।
হিন্দু ধর্মে সুফিবাদ। বাঙালির চেতনায় এক নতুন রেনেসাঁর জন্ম হয়। পরমহংসদেবের তরুণ শিষ্য বিবেকানন্দ আমেরিকা এবং ইউরোপে বক্তৃতা দিয়ে প্রভূত সাফল্য লাভ করে। তারা সতীদাহ প্রথা ফিরিয়ে আনতে চায় নাই। মানুষের মধ্যে ভগবান প্রতিষ্ঠা করে তারা মূলতঃ ভগবানকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছে। মানুষকে বড় করেছে। এতে তুমি আপত্তি করার কি দেখলে? এই আন্দোলন পূণর্জাগরণ না, নবজাগরণ।”
আমি বলেছিলাম, সক্রেটিস জাতিভেদ প্রথা সমর্থন করতেন। মানুষের সেবা করা সহজ কিন্ত সমান অধিকার দেয়া কঠিন। সেবার চেয়ে সমতা বড়। আমি আরও বলেছিলাম, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সমর্থকদের মধ্যে অনেকেই স্বামী বিবেকানন্দকে হিন্দু ধর্ম পুনর্জাগরণের নতুন দেবতা বলে মনে করে, তারা ভবিষ্যতে গোড়া হিন্দুত্ববাদ জন্ম দিতে পারে।
স্যার বলেছিলেন, “সক্রেটিস কর্মের ভিত্তিতে বর্ণভেদ সমর্থন করতেন, গুনের ভিত্তিতে নয়। আর তুমি তো দেশ বিদেশ ভ্রমণ কর, তুমি নিজে গিয়েই কোলকাতার ‘বেলুড় মঠ’টা দেখে এসো। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সম্মানে স্বামী বিবেকানন্দের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করা এই মন্দিরে বিশ্বের চারটি প্রধান ধর্মের গঠনরীতির কি অপূর্ব সম্মমিলন করা হয়েছে। সাঁনচির বৌদ্ধ স্তুপ। দক্ষিণ ভারতের হিন্দু মন্দির, ফতেপুর সিক্রির ইসলামিক আর্কিটেকচার, ফ্লোরেন্স ক্যাথিড্রালের গম্বুজ সব মিলিয়ে সৃষ্টি করা—Universal faith বা সার্বজনীন বিশ্বাসের এমন উদাহরণ তুমি কোথায় পাবে?”
আমি বলেছিলাম, স্যার, আমি বেলুড়মঠ দেখেছি, এটা শক্তি নয়, আপোষের প্রতীক। অসাম্যের আদিমূল বর্ণভেদ প্রথার মুখোমুখি (confront) না হয়ে মুসলমান, খ্রিষ্টান আর বুদ্ধধর্মের সাথে আপোষ করে নতুন বিশ্বজনীন ধর্মের আদর্শবাদের নামে মূল সমস্যা এড়িয়ে যাবার প্রয়াস মাত্র।
স্যার বলেছিলেন, ‘তুমি যা বলছো তা প্লেটোর Utopia, শুদ্ধ আদর্শবাদ। পরিপূর্ণ-শুদ্ধ আন্দোলনের ব্যর্থতার চেয়ে অল্প-শুদ্ধ আন্দোলনের সাফল্য নিঃসন্দেহে আমাদের কাম্য।'
তিনি আরও বলেছিলেন: ''সাফল্য মানুষের সাহস বাড়ায়, ব্যর্থতা আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করে। তত্ত্বগতভাবে যতই শুদ্ধ হোক না কেন, মানুষের সমর্থন না থাকলে কোনো আন্দোলন সফল হতে পারে না। মানুষের মধ্যে ভগবান- এই কথা বিশ্বাস করে যদি দলে দলে মানুষ রামকৃষ্ণ মিশন আন্দোলনে যোগ দেয়, তাহলে জাতীভেদ প্রথা ঝড়ের বেগে খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে। যদি তা না হয় তাহলে অন্তত আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। পূর্ণ-আদর্শ আন্দোলনের ব্যর্থতা জনপ্রিয় আন্দোলনের সফলতার চেয়ে বেশী ক্ষতি করতে পারে।''
আমি তর্ক আর লম্বা করি নাই। কারণ, আমি জানতাম স্যার মানুষের মঙ্গল চান। মানুষের উপকার করতে চান এবং করেন। স্যারের এই সহজ সরল বিশ্বাসে বিশ্ব মানবতার বিরাট কোনো উপকার হোক বা না হোক, কাজের মাধ্যমে তিনি মানুষের উপকার করছেন এটাই বড় কথা। আমার মনের কথা বুঝতে পেরে তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন: “আমরা বর্তমান সময়ের মানুষ। এখন ধর্মের চেয়ে রাজনীতি, বিশ্বাসের চেয়ে দর্শন, ইতিহাসের চেয়ে অর্থনীতি বড়। চলমান বিশ্বের রাজনীতি, যুক্তিবাদ এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কোন ধারাকে আমরা সমর্থন করি আর কোনটার বিরুদ্ধাচরণ করি তাই দিয়ে আমাদের মূল্যায়ন হবে, তাই দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ রচনা হবে।''
তিনি মার্কসবাদী সমাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন। তিনি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মস্কো-পন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সদস্য ছিলেন কি না- আমি জানি না। তবে তিনি এই দলের সমর্থক ছিলেন।
১৯৬৮-১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি আওয়ামি লীগের ৬ দফার চেয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবী বেশী পছন্দ করতেন। কারণ, তাঁর মতে, “১১ দফার মধ্যে সমাজতন্ত্রের কথা আছে, সম্পদের সুষম বন্টনের কথা আছে, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধাচরণ আছে।''
ফরিদপুর শহরের একান্ত নিজস্ব প্রতিষ্ঠান শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গনের তত্ত্ব-গুরু ডক্টর মহানামব্রত ব্রহ্মচারীকে তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অবতার বলে মনে করতেন। তিনি ছিলেন ডক্টর মহানামব্রতের আধ্যাত্মিক শিষ্য।
“পুকুরে ডুবানো কলসি’র বাইরে জল, ভিতরে জল। মানুষের বাইরে ভগবান মানুষের ভিতরে ভগবান। ভগবান সর্বত্র আছেন এবং প্রত্যেক কনায় আছেন। কিন্ত তিনি একটি মানুষের মধ্যে অধিক থাকেন। তাই ভগবানরূপী মানুষের সেবা করাই ভগবানের আসল সেবা।”
ডক্টর মহানামব্রতের বক্তৃতা থেকে অনেকবার আমি তাকে এই বাণী উদ্ধৃতি দিতে শুনেছি । ডক্টর মহানামব্রত ছিলেন আধ্যাত্মিক সাধক, ধর্ম রক্ষক আর ধর্ম শিক্ষক। কপালে চন্দন আর শ্বেতাম্বর বেষ্টিত ব্রক্ষচারী।
জগদীশ চন্দ্র ঘোষ সংসারবিরাগী ছিলেন না, তবুও কৌমার্য্য পালন আর সাদা শার্ট, সাদা পায়জামা পরা নির্বিলাস জীবনে আমরা কেউ ব্রহ্মচারীর আভাস পেলে আশ্চর্য হওয়ার কারণ নাই। তিনি ছিলেন গৃহবাসী ব্রক্ষচারী। চিরকুমার জীবনের প্রথম দিকে তিনি বলতেন “এখন বিয়ের বয়স হয় নাই।‘ পরে বলতেন, “এখন বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে।''
প্রেমকে যে ভয় পায়, জীবনকে সে ভয় পায়। স্যার জীবনকে ভয় পাবার মতো মানুষ ছিলেন না। যুবক বয়সে প্রেমে ব্যর্থ হয়েছিলেন বলে তিনি শার্টের বোতাম লাগাতেন না -এমন কথা যারা বলতো তাদের কথাও সত্য হতে পারে। কাকে ভালোবাসা উচিত এবং কেমন করে ভালোবাসতে হবে, সমাজের সমষ্টিগত মূল্যবোধ তা আমাদের জন্য স্থির করে দেয়। তার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের চলতে হয়, নিজেদের আবেগ গোপন রাখতে হয়।
কাছাকাছি বসে অংক করানোর অসাবধানতার কোনো মুহুর্তে কোনো তরুণীর প্রশ্বাসের উষ্ণতায় তিনি শিহরণ অনুভব করেছিলেন নাকি উচ্ছল যৌবনার শানিত চাহনিতে নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলেন- তা আমি জানিনা। রাত জেগে প্রেম পত্র লিখে তিনি ভালোবাসার গভীরতায় প্রবেশ করেছেন কি না- তা আমি জানিনা।
স্যারের প্রাইভেট পড়ানো বুদ্ধিদীপ্ত সুন্দরী প্রাক্তন ছাত্রীদের সংখ্যা কম ছিল না এবং শিক্ষক-ছাত্রীর প্রেম কাহিনীর মুখরোচক গল্প আমাদের সেই দিনের ছোট্ট ফরিদপুর শহরেও দু’চারটা ছিল। তবুও স্যারের প্রেম অথবা প্রেমের ব্যর্থতা নিয়ে মুখরোচক কোনো সত্য অথবা কল্পিত কাহিনী কোনো দিন শুনি নাই। শুনলে খুব খুশি হতাম। জীবনের চেয়ে বড় এই মহান মানুষটা ঈশ্বরের প্রেমে শ্বেতবসন-ব্রক্ষচারী না হয়ে উদাসী, ব্যর্থ প্রেমিক হলে তিনি আমাদের আরও কাছের মানুষ হতে পারতেন।
জগদীশ চন্দ্র ঘোষ। আমাদের কাছে তাঁর ডাক নাম “তারাপদ ঘোষ” দিয়েই বেশী পরিচিত ছিলেন। শিক্ষকতার বাইরে, তিনি প্রথমে পাকিস্তান অবজারভার এবং পরে বাংলাদেশ অবজারভার কাগজের মফস্বল সাংবাদিক হিসাবে কাজ করেছেন। প্রত্যেক খবরের কাগজেরই রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা থাকে এবং সাংবাদিকদের ঐ রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যে থেকেই কাজ করতে হয়। আমি স্যারের কোনো লেখা পড়ি নাই, তাই এ নিয়ে মন্তব্য করতে পারি না। বিপরীত ধারার রাজনীতির সমর্থকেরা তাঁকে পক্ষপাতী বললে আমি আশ্চর্য হব না। তবে একজন শিক্ষক হিসাবে তিনি ছিলেন শতভাগ নিরপেক্ষ। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, তিনি হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মের ছাত্রদের সমান ভাবে শিখিয়েছেন। তিনি নারায়ন চন্দ্র সাহা এবং মোহম্মদ ইদ্রিস কে সমান যত্ন দিয়েই অংক করিয়েছেন। তার মুখেই শুনেছি তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তিনি স্বাধীন এবং অবিভক্ত ভারতবর্ষ সমর্থন করতেন। তিনি পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে ছিলেন না। ধর্মের নামে রাষ্ট্র হলে পরিশেষে মানুষের ভালো হবে না, মন্দ হবে- এই বিতর্কে তিনি মৌলানা আবুল কালাম আযাদ এবং হুমায়ূন কবীরের যুক্তিতে বিশ্বাস করতেন। ফরিদপুর শহরের কৃতি সন্তান, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হুমায়ূন কবীরের লেখা মৌলানা আবুল কালাম আযাদের রাজনৈতিক স্মৃতি চারণ গ্রন্থ ''India wins freedom'' তিনি নিজে পড়েছেন এবং আমাকে পড়তে উৎসাহ দিয়েছেন।
১৯৪৬/১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময় তিনি পশ্চিম-বঙ্গের কোনো এক কলেজে পড়াশুনা করতেন। জীবনের নিরাপত্তার জন্য তিনি পশ্চিম থেকে পূর্ব বাঙ্গালায় ফেরত চলে আসেন। তিনিই সম্ভবতঃ একমাত্র হিন্দু মানুষ, যিনি পশ্চিম বাংলার চেয়ে পুর্ব বাংলাকে বেশী নিরাপদ মনে করেছেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি নতুন দেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে পাকিস্তানেই রয়ে গেছেন।
ছোটবেলা রেলগাড়ি দেখতে ফরিদপুর রেল স্টেশনে গিয়ে আমি অনেক হিন্দু পরিবারকে ভারতের পথে চলে যেতে দেখেছি। মাঝেমধ্যে চেনা মানুষদের বিদায় দিতে স্যারকে সেখানে উপস্থিত দেখেছি। কিন্ত তিনি এ দেশ ছেড়ে কোথাও যান নাই।
''এ দেশ ছাড়িও না ভাই, এ দেশ তোমার আমার সকলের।''
পাকিস্তান ছেড়ে হিন্দুদের চলে যাওয়া ফেরাতে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ছাপানো পোষ্টারে কতটা কাজ হয়েছিল তা আমার জানা নাই। তবে, সব হিন্দুরা পাকিস্তান ছাড়ে নাই, সব মুসলমান পাকিস্তান আসে নাই।
হুমায়ূন কবির পাকিস্তানে আসেন নাই। জগদীশ চন্দ্র ঘোষ হিন্দুস্তান যান নাই। হুমায়ূন কবীর তাঁর পৈতৃক বাড়ী দান করেছেন সাজেদা মেমোরিয়াল স্কুলকে, জগদীশ চন্দ্র তাঁর জীবন দান করেছেন আমাদের শিক্ষিত করতে। মহান এই দুই মানুষ আমাদের ফরিদপুর শহরবাসীর গর্ব।
তবুও হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করার একমাত্র অপরাধে ১৯৭১ সালে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁর পিতা, ভাই এবং কাকাকে হত্যা করেছে। আবার স্বাধীন বাংলাদেশের সেনা শাসন আমলে তাঁকে ''স্বাধীন বঙ্গভূমি'' সমর্থনের মিথ্যা মামলায় হয়রানি করা হয়েছে।
পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কোনো দিন তাদের দুষ্কর্মের জন্য স্যারের কাছে ক্ষমা চায় নাই। আত্ম-তৃপ্তিতে ভরা ফরিদপুরের রাজনৈতিক নেতাদের কেউ অথবা জাতীয় সরকারের পক্ষে কোনো মন্ত্রী তারাপদ স্যারের কাছে মরন্নোত্তর ক্ষমা চাইবেন কি না- তা জানি না।
ছোট্ট শহর ফরিদপুর। এখানে জন্ম নেয়া স্যারের অসংখ্য ছাত্র ছাত্রী জীবনের তাগিদে অথবা প্রতিভার বিকাশে এ শহর ত্যাগ করে দেশ বিদেশ চলে গেছে। কিন্ত তিনি কোথাও যান নাই। বাড়ীর পাশে বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের কোলাহল। হাসপাতালের ভিতরে জীবন মৃত্যুর লড়াই। বাইরে উদ্বিগ্ন আত্মীয়দের সমাবেশ। রাস্তায় যানজটের বিশৃঙ্খলা। ব্যস্ত মানুষের হৈ হুল্লোড়। সবকিছু উপেক্ষা করে তিনি পাহারের মতো স্থির থেকেছেন। শহরকে শিক্ষিত করেছেন।
শুধু স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য নয়, নিজেদের মর্জাদা বাড়ানোর স্বার্থেও তাঁর স্মৃতি রক্ষা করা শহরের পৌরপিতাদের কর্তব্য। তাঁরা কিছু করবেন কি না, আমি জানি না। তবে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই স্যারের ছাত্র ছাত্রীদের নিজস্ব চেষ্টায় এমন কিছু করা সম্ভব যা তাঁর স্মৃতিকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ধরে রাখবে, আমাদেরও সন্মান বাড়াবে।
ইতিহাসের প্রায় সমবয়সী এই মানুষটির ৯৩ বছরের বর্ণাঢ্য এবং কর্মময় জীবন ফরিদপুরের অনেক মানুষকে স্পর্শ করেছে। তিনি আমাদের মধ্যে বেঁচে ছিলেন জীবনের যা কিছু সুন্দর তাঁর প্রতীক হয়ে। আমাদের শিক্ষক, নির্ভিক সাংবাদিক, সততা আর নিষ্ঠার প্রতিচ্ছবি হয়ে।
ঘোষ বংশের লোক হলেও তাঁর পূর্বপুরুষেরা কেউ মিষ্টি তৈরি করেছে কি না তা আমার জানা নাই। তবে, জগদীশ চন্দ্র ঘোষ প্রচুর মিষ্টি খেতে পারতেন। স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে তিনি স্টেশন রোড সাদীর দোকানে বসে একের পর এক রাজভোগ খেয়ে যেতেন। আমার বন্ধু মিলন এবং আমি মাঝে মধ্যে স্যারকে দেখেও না দেখার ভান করে সাদীর দোকানে ঢুকে যেতাম। এমন ভাব করতাম যেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমরা কাউকে খুঁজছি। যতক্ষণ আমরা স্যারের চোখে না পরতাম, ততক্ষন ঘোরাঘুরি করতাম।অবশেষে স্যার ডাক দিয়ে একটা রাজভোগ খাওয়ালে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ হয়ে যেত।
পাঁচ বছর আগে একদিন স্যারকে জিজ্ঞেস করায় তিন জবাব দেন, “আমার কোনো ডায়াবেটিক-টেটিক নাই। ওরা অযথাই আমার বাড়ির পাশে ডায়াবেটিক হাসপাতাল করছে। আমি এখনও দুই চারটা রাজভোগ খাই, তাতে কোনো অসুবিধা হয় না। তবে, আমি কিন্ত রাজভোগ ছাড়া অন্য কোনো মিষ্টি খাই না। কারণ, রসের নিচে ডুবে থাকে বলে রাস্তার ধূলি বালি একে স্পর্শ করতে পারে না।'
ছবি- তারাপদ স্যারের সঙ্গে লেখক মোহম্মদ ইদ্রিস
একদিন স্যার কে আমার বাড়ী নিয়ে আসলাম। প্লেট ভরে রাজভোগ দিলাম। শিশুর মতো পুলকিত হয়ে স্যার মিষ্টি খেলেন আমি প্রাণ ভ’রে ছবি তুললাম। স্যারের চলে যাওয়াতে ডায়াবেটিক রোগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের বিরুদ্ধে আমার “শ্রেণী-সংগ্রাম “ করার মারাত্মক অস্ত্র এই ছবি গুলোর উপযোগিতা এখন কমে গেছে।
কাজকে কর্তব্য মনে করে, মহাকালকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে তিনি জীবনের শেষ দিনগুলোতেও শিক্ষকতা করেছেন। ২০২০ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে, অর্থাৎ ৯২ বছর বয়সেও আমি তাঁকে ছাত্র পড়াতে দেখেছি। শিক্ষকতার মহান ব্রত থেকে স্যারের সম্পর্ক ছিন্ন করতে স্বয়ং ঈশ্বরেরও কষ্ট করতে হয়েছে। বিশ্ব-বিধ্বংসী করোনা ভাইরাসের প্রয়োজন হয়েছে। সপ্তাহ কাল তিনি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়েছেন। অবশেষে নিজেই সম্মতি দিয়ে বলেছেন: “Now, I am ready to go."স্যারের মতো আমিও ইংরেজিতে বলি: In death as in life, he made his own choice. He left as he lived, on his own terms.
শুদ্ধতম শিক্ষক, শ্রীমান জগদিশ চন্দ্র ঘোষের ছাত্র হতে পেরে আমি গর্বিত।