• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৮, ২০২১, ০১:০৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ১৮, ২০২১, ০৭:১১ পিএম

রাসেল: শূন্য এ বুকে ফিরে আয় ফিরে আয়..

রাসেল: শূন্য এ বুকে ফিরে আয় ফিরে আয়..
চিত্র- শেখ রাসেল। আঁকিয়ে- আলপ্তগীন তুষার।

শিশু রাসেল অনন্তলোকে চলিয়া গিয়াছে। আর কোনোদিন ফিরিবে না। ইহাই সত্য। নির্মম নিষ্ঠুর সত্য। এই সত্য ধারণ করিয়া তাহার জীবিত দুই ভগ্নি পাষাণে হৃদয় বাঁধিয়া আজও বেদনায় দগ্ধ হইতেছেন। আদরের ভ্রাতাটিকে কতদিন আলিঙ্গন করেন নাই তাঁহারা। কতদিন তাহার গালে-কপালে চুম্বন আঁকিয়া দেন নাই। জ্যেষ্ঠ ভগ্নির কোলে মাথা রাখিয়া যে রাসেল রূপকথার গল্প শুনিত, তাহার সেই গল্পটি তো আজও সমাপ্ত হইল না। রূপকথার রাজকুমার কি সত্যি সত্যি পাতালপুরি হইতে রাজকুমারীকে উদ্ধার করিতে পারিয়াছিল? রাসেল তাহা জানিয়া যাইতে পারিল না। জ্যেষ্ঠ ভগ্নি হাসু বু, কনিষ্ঠ ভগ্নি রেহানা বু, দুলাভাই সুধামিয়াসহ আদরের দুই ভাগিনা-ভাগ্নি একদিন তাহাকে রাখিয়া জার্মান চলিয়া গেলেন। তাহার ঘন চুলে কে চিরুনী করিয়া দিবে, কে তাহার অংক খাতার দুই দিকে স্কেল দিয়া মার্জিন টানিয়া দিবে– ইহা লইয়াই শিশুটি বেদনায় কাতর হইয়াছে। এমনই এক নির্দয় সময়ে রাসেল তাহার পিতা-মাতা, দুই ভ্রাতা, দুই ভাবী এবং চাচাকে চোখের সামনে হত্যা হইতে দেখিল। ঘাতকচক্র কোমলমতি রাসেলকেও রেহাই দিল না। ইতিহাসের সব চাহিতে বর্বর ও জঘন্য এই হত্যাকাণ্ডে পরিবারের অন্য সকলের সহিত দশ বৎসরের শিশু রাসেলও শহিদ হইল। রাসেলের জীবিত ভগ্নিদ্বয় এই বেদনাকে বক্ষে ধারণ করিয়া আজও অঝোরে অশ্রু নিপাত করিতেছেন।

শিশু রাসেলকে যাহারা হত্যা করিয়াছে তাহাদের নিষ্ঠুরতাকে পরিমাপ করিবার সাধ্য আমাদের নাই। এই দেবশিশুর হত্যা হইয়াছে এই কারণে যে, বঙ্গবন্ধুর কোনো উত্তরসূরি যাহাতে আর থাকিতে না পারে। ইতিহাস হইতে বঙ্গবন্ধু ও তাহার পরিবারের নাম নিশানা চিরতরে মুছিয়া ফেলিয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে বিনষ্ট করিয়া ঘাতকেরা একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করিতে উদ্যোগ নিয়াছিলো। স্বাধীনতা বিরোধীদের একত্র করিয়া যে রাজনৈতিক দূর্বৃত্তায়নের সূচনা হইয়াছিলো ১৯৭৫’র আগস্টে ইহার অবসান তো আজও হয় নাই। আজও খুনীচক্রের আস্ফালন, গোপন কর্মসূচী এবং তৎপরতা লক্ষ্যনীয়। তাহারা সংগঠিত হইয়া ভিন্ন কৌশলে আবার যে ছোবল মারিবে না তাহার গ্যারান্টি কি আছে? তাহাদের এখনই প্রতিহত করিতে হইবে, তাহা না হইলে ভয়ঙ্কর এক পরিণতির দিকে অগ্রসর হইবে বাংলাদেশ। 

যাহা হউক রাসেলের জন্মদিনে বেদনার কথা আর না বলি। কিন্ত একটি প্রশ্ন আমাকে বহুভাবে বহুদিন হইতে জর্জরিত করিয়া চলিতেছে। কোমলমতি এই প্রাণবন্ত শিশুটিকে যাহারা হত্যা করিল তাহাদের হৃদয় কি তখন কাঁপিয়াছিল? ক্রন্দনরত শিশুটির মুখ দেখিয়া কি হত্যাকারীরা একবারের জন্য অনুতপ্ত হয় নাই?  না, হয় নাই। হয় নাই বলিয়াই তো যাহারা শিশু রাসেলকে হত্যা করিয়াছে তাহারা সীমারের চাহিতেও নিষ্ঠুর। তাহাদের মধ্যে অন্তর বলিয়া কিছু ছিলো না, হিংস্র জানোয়ার তাহারা।

শিশু রাসেল পিতার মতোই মানবিক ছিলো। প্রশস্থ হৃদয় ছিলো রাসেলের। তাহার চোখের মধ্যে এক বুদ্ধিদীপ্ত, সজাগ ও নেতৃত্ববাদী আগামীর আভা দেখা যাইত। হতদরিদ্র মানুষের জন্য রাসেলের অন্তর কাঁদিত। জানিয়াছি, রাসেল ছবি আঁকিতে ভালোবাসিত, অঙ্কনকলায় তাহার আগ্রহ প্রগাঢ় ছিলো। এই দূরন্ত শিশুটি বাঁচিয়া থাকিলে আপদমস্তক বাঙালি হইত, হয়তো শিল্পকলায় পারদর্শী হইয়া উঠিত, হয়তো দেশের রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করিত; কিন্ত সেই সকল সম্ভাবনাকে আঁচ করিয়া ঘাতকের দল রাসেলকেও নির্মমভাবে হত্যা করিল। রাসেলের হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের সকল শিশুর অন্তরকে বিদীর্ণ করিয়াছে। প্রাচীনকালে রচিত কাহিনিতেও এমন নিষ্ঠুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিবরণ নাই। শিশু হত্যা করিয়া তাহারা নতুন এক কলঙ্কজনক ইতিহাসের জন্ম দিয়াছে। তাহাদের ক্ষমা নাই। করুণাময় সৃষ্টিকর্তাও তাহাদের ক্ষমা করিবেন না।

বাংলাদেশের সকল শিশুদের জন্য রচিত পাঠ্যে রাসেলের পাঠ যুক্ত করিতে হইবে। শিশুরা জানিবে কাহারা রাসেলকে হত্যা করিয়াছে, কি ছিলো এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের করুণ ইতিহাস। আমরা রাসেলের জন্য ক্রন্দন করিব, রাসেলের জীবনী হইতে  আমাদের দেশের শিশুরা নিজেদের নির্মাণ করিবে। শেখ হাসিনা শিশুদের মাঝে তাহার ভ্রাতা রাসেলকে খুঁজিয়া পাইবে। 

 

লেখক ● সাংবাদিক, গবেষক ও সংস্কৃতি কর্মী।। 

 

জাররণ/এসকেএইচ