জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামাল কিছুটা হলেও নিভৃতচারী ছিলেন। মিতভাষী এবং অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত এই তরুণ তাঁর ছেলেবেলা থেকেই নানারকম বই পাঠে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন।
শেখ জামালের জন্ম ১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ থেকে তিনি মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। লেখাপড়া ছাড়াও সংস্কৃতি এবং ক্রীড়াক্ষেত্রে তাঁর ভীষণ আগ্রহ ছিল। তিনি ভালো গিটার বাজাতেন এবং ক্রিকেট-ফুটবল খেলায় পারদর্শী ছিলেন। ক্রিকেট ফুটবল ছাড়াও টেনিস, বাস্কেটবল ও ভলিবল খেলতেন শেখ জামাল। ঢাকার ফুটবল লিগে অভিষেক ঘটে তাঁর। তিনি আবাহনী ক্লাবে ফুটবল ও ক্রিকেট দলের সদস্য ও ছিলেন।
১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট শেখ জামাল গৃহবন্দি অবস্থায় পাকিস্তানি পাহারাদারদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে গোপনে ভারতের আগরতলা চলে যান। আগরতলা থেকে কলকাতা পৌঁছে তিনি বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের সহযোগিতায় ভারতের উত্তর প্রদেশের কালশীতে গমন করেন মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে। সেখানে তিনি মুজিব বাহিনীর ৮০ জন নির্বাচিত তরুণের সঙ্গে ২১ দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে রণাঙ্গনের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি ৯ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হন। অসীম সাহসী শেখ জামাল রণাঙ্গনের সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ থেকেছেন সব সময়। যুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর রণকৌশল প্রশংসিত হয়েছিল সেনাবাহিনীর চৌকষ অফিসারদের কাছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বঙ্গবন্ধু পূর্ণগঠন করেন। সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচের কমিশন্ড অফিসার ছিলেন শেখ জামাল। শেখ জামাল ব্রিটেনের রয়াল মিলিটারি একাডেমি স্যান্ডহার্স্টের ক্যাডেট হিসেবে ছয় মাস কঠোর প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৭৫ সালের ২৭ জুন কৃতিত্বের সাথে কমিশন লাভ করেন। সেবার বিদেশি ক্যাডেটদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তিনজন তরুণ কমিশন লাভ করেছিলেন। তাঁরা হলেন অফিসার ক্যাডেট আলাউদ্দিন মো. আবদুল ওয়াদুদ, মাসুদুল হাসান এবং শেখ জামাল।
শেখ জামাল মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে মনে মনে নিজেকে সেনাবাহিনীর একজন চৌকষ কর্মকর্তা হিসেবে প্রস্তুত করতে চেয়েছিলেন। সেই সুযোগ তিনি লাভ করেন ১৯৭৪ (২৯ জানুয়ারি) সালে যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল জোসেফ টিটো। শেখ জামালের সেনাবাহিনীর ক্যাডেট অফিসার হবার আগ্রহ দেখে অভিভূত মার্শাল টিটো তাঁকে যুগোস্লাভিয়ার মিলিটারি একাডেমিতে ভর্তি করে দেন। কিন্তু যুগোস্লাভিয়ার বৈরি আবহাওয়া এবং ভাষাগত জটিলতার কারণে শেখ জামাল ভীষণ অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন; এমন অবস্থায় প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোই তাঁকে ব্রিটেনের রয়েল একাডেমি স্যান্ডহার্স্টে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পরামর্শ দেন।
ব্রিটেনের রয়েল মিলিটারি একাডেমি স্যান্ডহার্স্ট থেকে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে শেখ জামাল ঢাকা সেনানিবাসের দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করেন। স্বল্প সময়েই অফিসার ও সৈনিকদের মাঝে তাঁর অসাধারণ মেধা ও নৈপুণ্য এবং দক্ষতা প্রকাশ পায়। সৈনিক অফিসার সবার কাছেই তিনি ছিলেন সমান জনপ্রিয়। মাত্র দেড়মাস সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন শেখ জামাল। সেনানিবাসে তাঁর সর্বশেষ কর্মদিবস ছিল ১৪ আগস্ট ১৯৭৫। সেদিন রাতেই তিনি ডিউটি অফিসার হিসেবে দায়িত্ব শেষে বাসায় ফিরেন। কে জানতো- এর কয়েকঘণ্টা বাদেই শেখ জামাল তাঁরই সিনিয়র কর্মকর্তাদের দ্বারা সপরিবারে শহিদ হবেন।
১৯৭৫ সালের ১৭ই জুলাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা পছন্দ করে শেখ জামালের বিয়ে দেন পারভীন জামাল রোজীর সাথে। রোজী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছোটবোন-এর মেয়ে। শেখ জামালের বিয়ের মাত্র এক মাসের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী ও বাঙালি সংস্কৃতিবিনাশী একটি চক্র। এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিনষ্ট করে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে বিদেশি মদদপুষ্ট হয়েই এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। এই নির্দয় নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে শেখ জামালও শহিদ হন। তাঁর স্ত্রী রোজীর হাতে তখনও মেহেদীর রং লেগেছিল। ঘাতকচক্রের উগ্র তাণ্ডব ও নৃশংসতার কাছে শেখ জামাল ও রোজীর প্রণয়ের কোনো মূল্য ছিল না। উন্মত্ত খুনিরা এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে দেশে পাকি ধারার হুকুমৎ কায়েমের স্বপ্নে বিভোর ছিল।
শেখ জামাল একজন দেশপ্রেমী আদর্শ নাগরিক ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সন্তান হলেও তাঁর চলাফেরা ছিল একেবারে সাদাসিধে। নিরহংকারী শেখ জামাল তাঁর ২২ বছরের জীবনে দেশপ্রেম, মানবিক মূল্যবোধ এবং ধীর-স্থিরতার যে উদাহরণ রেখে গেছেন সেটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলাদেশের তরুণদের মননে ও চেতনায়।
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও সংস্কৃতি কর্মী।