চলতি মাসের ১০ ফেব্রুয়ারি ছিল ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি দিবস। ১৯৯৮ সালের সেই দিনের ঐতিহাসিক মুহূর্তসহ পুরো ঘটনাটিই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম ও মধুরতম স্মৃতি। আমি তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের নিয়মিত অনুষ্ঠান ঘোষক এবং উপস্থাপক। বিটিভিতে একদিন অনুষ্ঠান ঘোষণা করছিলাম। হঠাৎ একজন এসে আমাকে বললেন, আপনাকে আলী ইমাম সাহেব ডাকছেন, খুব জরুরি। আলী ইমাম ভাই তখন উপস্থাপন শাখার অনুষ্ঠান অধ্যক্ষ। আমি ভাবলাম কোনো ভুল ঘোষণা করলাম না তো? ছুটে গেলাম ইমাম ভাইয়ের কক্ষে এবং তার সামনের চেয়ারে বসলাম। আলী ইমাম ভাই তখন বললেন, ‘এক্ষুণি নওয়াজীশ আলী খান সাহেবের কাছে তোমার বায়োডাটা দিয়ে এসো (নওয়াজীশ সাহেব তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন)। তোমাকে খাগড়াছড়ি যেতে হবে।’ আমি এতক্ষণ যে আশঙ্কায় ছিলাম তা কেটে গেল। পরদিন বায়োডাটা জমা দিলাম বিটিভির সিকিউরিটি পাসের রুমে। খাগড়াছড়ির কথা শুনে খুব ভালো লাগলো। সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা লোকমুখে অনেক শুনেছি, বই-পত্রে পড়েছি। খাগড়াছড়ি একটি নদীর নাম। নদীর পাড়ে খাগড়ার বন থাকায় পরবর্তীকালে তা পরিষ্কার করে জনবসতি গড়ে ওঠে। তখন থেকেই এটি খাগড়াছড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে। এখন সেখানেই আমাকে যেতে হবে, ভাবতেই ভিষণ ভালো লাগছে।
এর আগে বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি পার্বত্য অঞ্চলে শান্তিবাহিনীর সাথে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন সময়কার সংঘর্ষ, রক্তপাত, হানাহানির বিবরণ। কিন্তু কি কারণে এত হানাহানি কখনো জানতে পারিনি। বিগত দিনে যারা দেশের ক্ষমতায় ছিলেন তারাও কখনো এই ব্যাপারটি জনগণের কাছে পরিস্কার করেনি। দীর্ঘদিনের এই হানাহানি, রক্তপাত বন্ধের জন্য বহুদিন আগে থেকেই শান্তি বাহিনীর সাথে আলাপ আলোচনা চলতে থাকে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৯৬-এ নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার দেশের শাসনভার গ্রহণ করার পর তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় পার্বত্য সমস্যাকে একটি রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা চালায় এবং সরকার গঠনের সাথে সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানে সাংসদ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহকে চেয়ারম্যান করে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে। এই কমিটি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা নামে পরিচিত) ও অন্য সদস্যের সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর ২রা ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে দীর্ঘ কাক্সিক্ষত ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি দেশ-বিদেশে বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়। শান্তিচুক্তির অনেকগুলো শর্তের মধ্যে একটি শর্ত হচ্ছে চুক্তি স্বাক্ষরের ৪৫ দিনের মধ্যে অস্ত্র জমাদানের দিন তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করা হবে। তারই ধারাবহিকতায় ১০ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ সালে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পাহাড় টিলা পরিবেষ্টিত সবুজে ঘেরা খাগড়াছড়ি জেলার নবনির্মিত স্টেডিয়ামে অস্ত্র জমাদানের ঘোষণা দেয়া হয়। ঐদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ৭৩৯ জন সদস্য, সমিতির চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম দফা অস্ত্র জমা দেবে, সূচিত হবে আর একটি ঐতিহাসিক দিন।
অনুষ্ঠানটিকে সফল করার জন্য চলতে থাকে বিপুল আয়োজন। খাগড়াছড়ির চারদিকে সাজ সাজ রব। নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ টেলিভিশন। কিন্তু বিটিভি থেকে সরাসরি সম্প্রচার সম্ভব নয়। কথা চলছে কোলকাতা দূরদর্শনের সাথে। সফল হয়নি আলোচনা। আবারো অনিশ্চয়তা। কিন্তু অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করতেই হবে। সেদিন পুরো জাতির দৃষ্টি থাকবে খাগড়াছড়ির দিকে।
পরবর্তীতে তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদের প্রচেষ্টায় ৮ই ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি কোম্পানির সাথে চুক্তি হয় সরাসরি সম্প্রচারের। বাংলাদেশ বেতারও সরাসরি সম্প্রচার করবে এই অনুষ্ঠান। ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, খাগড়াছড়িতে ঐতিহাসিক অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচারের জন্য ধারাভাষ্যে সৈয়দ হাসন ইমাম, আলী যাকের, আবেদ খান, শাহরিয়ার কবির, ড. হারুন অর রশিদ এবং সার্বিক উপস্থাপনা ও বর্ণনার জন্য বিটিভির পক্ষ থেকে আমাকে নির্বাচন করা হয়। এত বড় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজনও ব্যাপক। এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে বিটিভির নিজস্ব প্রযুক্তির ইতিহাসে এই প্রথম স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সরাসরি অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করা হবে। অনুষ্ঠানটির ধারা বর্ণনার বিষয়ে তথ্য মন্ত্রণালয় এমনকি বিটিভির মহাপরিচালক মহোদয়ের অফিস থেকে যখন আমাকে কয়েকবার ফোন করা হলো তখন আমি অনুষ্ঠানটির গুরুত্ব আরো বেশি উপলব্ধি করতে পারলাম। সবাই জানতে চায়, খাগড়াছড়ির প্রোগ্রামে যাওয়ার জন্য আমি সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছি কি না? কারণ পুরো অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনার দায়িত্ব একমাত্র আমার ওপর ন্যস্ত।
যা হোক অনুষ্ঠানটিকে সফল করার জন্য খাগড়াছড়ি যাওয়ার আগে ৮ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠানটির ধারাভাষ্যকার আমরা সবাই সৈয়দ হাসান ইমাম ভাইয়ের অফিসে বেলা ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মিটিং করে অনুষ্ঠানটি কীভাবে করবো, কে কতটুকু বলবো- তা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ হয়। মিটিংয়ের মাঝে আবার বেশকিছু মজার মজার গল্পও হয়েছে। যেমন আমরা সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি ১০ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠান শেষে হাসান ভাই প্রধানমন্ত্রীর ইন্টারভিউ নেবেন। আবেদ ভাই তখন বললেন, “আচ্ছা হাসান ভাই ধরুন ইন্টারভিউ নেয়ার সময় আপনাকে কেউ গুলি করলো, ‘আপনি মাটিতে পড়ে গেলেন, তখন আপনার কাজ আমি কীভাবে চালিয়ে নিতে পারি বলুন তো?’ হাসান ভাই তখন বললেন, “আমি গুলি খেলে তোমাকে আর অনুষ্ঠান চালাতে হবে না।” আবেদ ভাই মুখ গম্ভীর করে বললেন, “কেন”? হাসান ভাই বললেন, “ছোটবেলায় একটা ধাঁধা আমরা প্রায়ই একজন আরেকজনকে বলতাম, তা হলো একটি গাছে ৬টি পাখি আছে। একটিকে গুলি করলে আর কয়টি থাকবে।” এই কথা শোনার সাথে সাথে আমরা সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম।
ঢাকা থেকে খাগড়াছড়িতে হাজারো অতিথি যাবেন। এই ছোট্ট শহরে এত লোকের থাকা খাওয়ার ভাল ব্যবস্থা হবে কি না এ ব্যাপারে সবাই সন্দিহান ছিলাম। ম.হামিদ ভাই বললেন, (বিটিভির অনুষ্ঠান অধ্যক্ষ), “কোথায় থাকা হবে জানি না, হয়তো সবাইকে কষ্ট করতে হতে পারে” তিনি সবাইকে মশার কয়েল, কিছু শুকনো খাবার, চিড়া, গুড় এবং পানি সাথে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। সেই সাথে খাবার স্যালাইন এবং ঔষধপত্রও নিয়ে যেতে বললেন। আমার ভেতর এক ধরনের ভয়, আনন্দ, উত্তেজনা বিরাজ করছিলো। আমি সবার কথাই রাখলাম। ৯ই ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় হাসান ভাই’র অফিসের সামনে থেকে আমরা খাগড়াছড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হব। আগের দিন রাত ১২টা পর্যন্ত জিনিসপত্র গোছালাম, স্লিপিং ব্যাগ, গরম পানির ফ্ল্যাক্স, মিনারেল ওয়াটার, বিস্কুট, জুস, মশার কয়েল, ঔষধ, জামা-কাপড়, সেভিংয়ের জিনিসপত্র, টুথব্রাশ, ক্রিম, টাই, ব্লেজারসহ আরো অনেক কিছু নিয়ে বড় এক ব্যাগ ভর্তি করলাম। বুঝলাম একজন মানুষ বাইরে কোথাও যেতে হলে কত কিছুর প্রয়োজন হয়, যা ঘরে থাকলে বোঝা যায় না।
ভোর হলো, যাওয়ার জন্য সকল প্রস্তুতি শেষ। আমার স্ত্রী বিলকিস নাহার স্মৃতিসহ একসাথে বের হলাম। সে মতিঝিলে অফিসে যাবে। আমি বিএমএ ভবনে হাসান ভাইর অফিসে নেমে গেলাম। সবাই একত্র হলাম। আমাদের যাওয়ার বাহন ছিল ২টি মাইক্রো, ২টি পাজেরো এবং একটি ছটলু ভাইয়ের (আলী যাকের) গাড়ি।
সবাই গাড়িতে উঠে বসলাম। দলের সবচাইতে কনিষ্ঠ সদস্য ছিলাম আমি। শাহরিয়ার কবির, আবেদ খান, আলী যাকের এক গাড়িতে। সাংবাদিকবৃন্দ এক গাড়িতে, মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তাগণ এক গাড়িতে, সৈয়দ হাসান ইমাম, ড. হারুন অর রশিদ এবং আমি অন্য আরেকটি গাড়িতে। সব গাড়িতেই কিছু কমলা এবং পানীয় বোতল দেয়া হলো। রওয়ানা হবার আগে আমাদের সিদ্ধান্ত ছিলো চলতি পথে হাইওয়ে-ইন রেস্টুরেন্টে সবাই মিলে একসাথে লাঞ্চ করবো। যাই হোক যাত্রা হলো শুরু। তখন সকাল ১০টা। ঢাকা শহরের অতি পরিচিত ঐতিহ্যবাহী জ্যামের মুখোমুখি হলাম।
প্রেসক্লাব থেকে ডেমরা যেতে এক ঘন্টা সময় লাগলো। তারপরের পথ ছিল খুবই আরামদায়ক। গাড়িতে গল্প করতে করতে দুপুর দেড়টা বেজে গেল।
হাইওয়ে ইন রেস্টুরেন্টের সামনে আমাদের তিনটি গাড়ি থামালো। ছিমছাম চমৎকার রেস্টুরেন্টের দোতলায় সবাই বসলাম। অপর গাড়িটির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। সাংবাদিকদের নিয়ে ঐ গাড়িটি ভুলে অন্য এক রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেছে। খাগড়াছড়ি পৌঁছার আগে তাদের সাথে আর আমাদের দেখা হয়নি। যাই হোক হাসান ভাই খাবারের অর্ডার করলেন। তিনি ভেজিটেবল পছন্দ করেন তার সাথে মাছ।, আমিও হাসান ভাইয়ের দেখাদেখি ভেজিটেবল এবং মাছ নিলাম। তার আগে আমরা সবাই স্যুপ খেলাম। সবাই খাচ্ছি আর গল্প করছি। অনেক গল্পের মাঝে ছটলু ভাই (আলী যাকের) তার বাবার স্মৃতিচারণ করলেন। তার বাবা একজন আইনজীবী। “দরিদ্র পরিবারের একটি ছেলে তার মাকে বটি দিয়ে আঘাত করলে এলাকার লোকজন ক্ষুদ্ধ হয়ে ছেলেটিকে ধরে মারধর করে এবং তার মাকে দিয়ে ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করায়। মামলাটি তাহের সাহেবের (আলী যাকেরের বাবা) কাছে যায়। তিনি মামলাটি অন্যভাবে সমাধান করার চেষ্টা করেন। এলাকাবাসীর জোর দাবি ছেলের বিচার হতে হবে। তাহের সাহেব ছেলে আর ছেলের মাকে একটি রুমে নিয়ে দরজা বন্ধ করলেন এবং একজনকে বললেন একটি বড় কাঁঠাল নিয়ে আসতে। তিনি দু’জনের সাথেই কথা বললেন। কাঁঠাল আনা হলো। তাহের সাহেব কাঁঠাল হাতে নিয়ে একটি গামছা দিয়ে ছেলের পেটে কাঁঠাল বেঁধে এক ঘন্টা হাঁটতে বললেন। কিন্তু ১০ মিনিট হাঁটার পর ছেলের কষ্ট দেখে মা চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন, ছেলেও মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। তখন তাহের সাহেব হাসতে হাসতে ছেলেকে বললেন, তোমার মা ১০ মাস ১০ দিন কষ্ট করে তোমাকে পেটে ধরেছেন আর তুমি তাকে মারতে গেলে। ছেলে মা’র কাছে ক্ষমা চাইলো। মা ছেলেকে ক্ষমা করে দিলেন। মামলা তুলে নেয়া হলো।
এরই মধ্যে আমাদের খাওয়া শেষ। কিন্তু প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেল কেউ উঠছে না, অবশেষে আমি বললাম এবার মনে হয় আমরা উঠতে পারি। সবাই সাহাস্যে সম্মতি জানালেন। ভাল সময় কাটলো রেস্টুরেন্টে। যাত্রাপথের বিরতি স্থানগুলো এখন আগের চেয়ে অনেক আধুনিক হয়েছে। আমরা যে যেই গাড়িতে ছিলাম আবার সেভাবে যাত্রা শুরু করলাম।
আমরা কথা বলছি, গাড়ি চলছে দ্রুতগতিতে। পথে একটা বাস খাদে পড়ে থাকতে দেখেছি। সম্ভবত কিছুক্ষণ আগে দুর্ঘটনা ঘটেছে। মনটা খারাপ হলো। আমি প্রায় সময় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে ভাবি। প্রতিদিন আমাদের দেশে এখানে সেখানে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছেই। কত নারী, পুরুষ, শিশু মারা যাচ্ছে। আমরা কেউ তাদের খোঁজ খবর রাখি না। আমরা কখনই ভাবি না যে, একটা পরিবারে একমাত্র উপার্জনকারী পুরুষ বা নারী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন। পরবর্তীতে ঐ পরিবারের কী করুণ অবস্থা হয়?
প্রসঙ্গে ফিরে আসি। গাড়ি চলছে হঠাৎ চোখে পড়লো- “বিধ্বস্ত সেতু ধীরে চালান। সড়ক ও জনপথ বিভাগ।”আমরা সবাই জানি বিধ্বস্ত সেতু অথচ এই বিধ্বস্ত সেতুটিকে দ্রুত মেরামত করার কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। গাড়ি চলছে- সড়ক ও জনপথ বিভাগের আরেকটি লেখা চোখে পড়লো ভাষাগত চমৎকারিত্বের জন্য- ‘একেবারে না যাওয়ার চেয়ে দেরিতে যাওয়া ভাল।’ লেখাটি দেখে চালককে আস্তে চালাতে বললাম।
ফেনী পার হয়ে আমরা রামগড় দিয়ে খাগড়াছড়ির দিকে রওনা হলাম। রামগড়ে শান্তিচুক্তি বিরোধী ৮-১০ টি কালো পতাকা চোখে পড়েছে। কিছুদূর যাওয়ার পর অনেকগুলো সাদা পতাকা চোখে পড়লো। আমরা শঙ্কামুক্ত হলাম। অনেকগুলো পাহাড়, টিলা উঁচু নিচু পথ পেরিয়ে আমরা খাগড়াছড়ির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছি। ভীষণ ভালো লাগছে। হঠাৎ গাড়ি থেমে গেল। ড্রাইভার বললো এটা সবচেয়ে বড় পাহাড়। এ পাহাড়ের উপর দিয়ে ঘুরে ঘুরে আমাদের যেতে হবে। কিন্তু গাড়ির পানি শেষ। ইঞ্জিন গরম। ঠান্ডা না হওয়ার আগে যাওয়া যাবে না। আরো ৭-৮ মাইল পথ বাকি। আমাদের সাথের অন্যরা আগেই চলে গেছে। কি করি, কোথায় পানি পাবো! হাসান ভাই, ড. হারুন আমরা সবাই চিন্তিত। ১০-১৫ মিনিট পর রোডস্ অ্যান্ড হাইওয়ের ২টি ট্রাক আমাদের ক্রস করে যাওয়ার সময় হাসান ভাইকে দেখেই গাড়ি থামালো। হাসান ভাইকে তারা সবাই চেনে, তাদের পছন্দের শিল্পী, কিন্তু আমি বা হারুন স্যারকে কেউ চিনলো না। যা হোক তারা আমাদের গাড়ির জন্য পানি এনে দিল দুই বালতি। আধা ঘন্টা পর আমাদের গাড়ি পাহাড়ের উপর দিয়ে যাত্রা শুরু করল। পাহাড়ের উপর থেকে খাগড়াছড়ি শহরের নবনির্মিত স্টেডিয়াম দেখতে পেলাম। এর মধ্যে হাসান ভাই এই পাহাড়ি এলাকার তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। খাগড়াছড়ি শহরে ঢুকতেই ট্রাফিক পুলিশ আমাদের গাড়ি থামালো। কিছু দূরেই দেখতে পেলাম সেনাবাহিনীর ৩-৪টি গাড়ি, আর তার পেছনে আসছে ১৪-১৫টি বড় বাস। কাছাকাছি আসতেই তারা হাত বাড়ালো, আমরাও হাত উঁচিয়ে তাদের অভিবাদন জানালাম। এরাই জনসংহতি সমিতির সদস্য। আগামীকাল অস্ত্র জমা দেবে। তাদের পেছন পেছন আমাদের গাড়িও চললো। তারা স্টেডিয়াম অভিমুখী, আমরা প্রেসক্লাব অভিমুখী। তখন বিকাল ৫টা, প্রেসক্লাবে গিয়ে দেখি আগামীকালের অনুষ্ঠান সম্পর্কে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় হচ্ছে। আমরাও যোগ দিলাম। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সায়িদ, বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, উপ মহাপরিচালক মোস্তফা কামাল সৈয়দ ও বেতারের মহাপরিচালক এম.আই. চৌধুরীসহ আরো অনেকে।
ঢাকা থেকে আমরা যে কয়জন রওয়ানা করেছিলাম, প্রেসক্লাবে সবাই একত্রিত হলাম। এবার আমাদের জন্য থাকার জায়গা খোঁজা শুরু হলো। তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদের নেতৃত্বে একটা বাসা দেখতে গেলাম। উল্লেখ্য যে, ১০ তারিখের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আগেই খাগড়াছড়ির সবগুলো সরকারি কোয়ার্টার খালি করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের গ্রামের বাড়ি, নানার বাড়ি, দাদার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের এই সাময়িক কষ্টের জন্য আমরা দুঃখিত।
যাহোক দোতলা বাড়িটিতে আমরা সবাই গেলাম। সবারই মোটামুটি পছন্দ হয়েছে। বাদ সেধেছেন ছটলু ভাই (আলী যাকের)। সমস্যা একটা, তাঁর হাই কমোড চাই। স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে খোঁজা শুরু হলো হাই কমোডওয়ালা বাসা। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোথাও পাওয়া গেল না। এরই মধ্যে রাত ৮টা বেজে গেল। পরে আলী যাকের, রুনু ভাই (আবেদ খান) এবং শাহরিয়ার কবির হাই কমোডের সন্ধানে সম্ভবত রাঙ্গামাটি পর্যন্ত চলে গেছেন। আমি হাসান ভাই, ড. হারুন থেকে গেলাম অন্য একটি দোতলা বাড়ির নিচতলায়। দুটো রুম তিনটি খাট। হাসান ভাই সিনিয়র মানুষ উনাকে একটা বাথরুমসহ সিঙ্গেল রুমটি দিয়ে, আমি ও ড. হারুন অপর রুমে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে গল্প করতে বসলাম। এর মধ্যে একজন ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের খোঁজ নিলো। আমাদের পাশের বাসায় স্থনীয় স্কুলের হেড মাস্টার থাকেন। তিনি তার সন্তানদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। ২ ছেলে মেয়ে। ছোট ছেলের বয়ষ ৭-৮ বছর আর মেয়েটি সম্ভবত দশম শ্রেণির ছাত্রী। হাসান ভাই একজন বড় মাপের শিল্পী। মেয়েটি হাসান ভাইকে দেখে ভীষণ খুশি হলো। আর আমাকে অনুষ্ঠান ঘোষণায় দেখেছে বলে জানাল। মেয়েটি ছোটবেলায় ভালো নাচ করতো। বছর দুয়েক আগে ছাদ থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছে এখন আর নাচতে পারে না। হাসান ভাই চা খেতে চাইলেন সাথে সাথে মেয়েটি চা করতে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর গাড়ি আসবে আমাদেরকে সার্কিট হাউজে নিয়ে যাবে। সেখানে ডিনার ও মিটিং হবে। মিটিংয়ে যাওয়ার আগে আমি হাসান ভাইকে বলে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যেতে চাইলাম। ঢাকা থেকে শুনেছি এখানে উপজাতীদের হাতে তৈরি সুন্দর সুন্দর জিনিসপত্র পাওয়া যায়। হাসান ভাই বললেন- ‘খন্দকার ডব অৎব ঙহ উঁঃু তাড়াতাড়ি চলে এসো।’ আমাদের রেস্ট হাউজের কাছে বেশ কয়েকটি ভাল দোকান আছে সেখানে যাবো। সাথে নিয়ে গেলাম আমাদের কেয়ার টেকার চান্দুকে (চাকমা)। দ্রুতগতিতে ছুটলাম দোকানে। একটা দোকানে ঢুকতেই আমার মনে হলো আমি ঢাকার কোন দোকানে আছি। আমার সামনেই নৃত্য শিল্পী নীপা, লিবলীসহ আরো অনেকে। আগামীকাল স্টেডিয়ামে অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানে তারা নাচ পরিবেশন করবে। তাদের সাথে কুশল বিনিময় করে কেনাকাটায় মনোযোগ দিলাম। সময় বয়ে যাচ্ছে হাসান ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে তাড়াতাড়ি রুমে ফিরতে হবে। একটা বেড শিট, মেয়েদের একটা জামা, আমি পছন্দ করলাম। প্যাকেট করার পর দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম এগুলো এখানেই তৈরি তো? দোকানি বললো এগুলো কুমিল্লা থেকে আনা খদ্দরের তৈরি। মনে বড় দুঃখ পেলাম। কি আর করা প্যাকেটগুলো নিয়ে দ্রুত রুমে ফিরলাম।
রুমে গিয়ে দেখি হাসান ভাইও ড. হারুন নেই। গাড়ি আসার পর আমার জন্য ১০ মিনিট অপেক্ষা করে তাঁরা চলে গেছেন। আমি পোশাক বদলিয়ে রিকশাযোগে সার্কিট হাউজ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে গিয়ে দেখি একজন ম্যাজিস্ট্রেট এসেছে গাড়ি নিয়ে আমাকে নেয়ার জন্য। তাঁর সাথে সার্কিট হাউজে গেলাম। অনিচ্ছাকৃত বিলম্বের জন্য হাসান ভাইকে স্যরি বলে তার পাশে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই কনফারেন্স রুমে ডাক পড়লো। সেখানে উপস্থিত আছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সায়িদ, স্থানীয় সাংসদ ও অন্যান্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ তাদের সাথে সৈয়দ হাসান ইমাম, ড. হারুনুর রশিদ ও আমি যোগ দিলাম। আলোচ্য বিষয় আগামীকালের অনুষ্ঠান। মিটিং শেষে সার্কিট হাউজেই ডিনার শেষ করে রাত ১১:৩০ মিনিটে গেস্ট রুমে গেলাম।
হাসান ভাই ড. হারুন ও আমি আধা ঘন্টা আলোচনার পর হাসান ভাই ঘুমাতে গেলেন। ড. হারুন তাঁর বক্তব্য তৈরিতে ব্যস্ত। আমি ধারাবাহিকভাবে পুরো অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট তৈরিতে ব্যস্ত। আমাদের সবার একই উদ্দেশ্য আগামীকাল অনুষ্ঠান ভাল করতে হবে। সারাদেশের মানুষের দৃষ্টি খাগড়াছড়িতে। সরাসরি সম্প্রচার হবে। এতটুকু ভুল করা চলবে না। আমার স্ক্রিপ্ট হারুন স্যারকে শুনালাম। স্যারেরটা আমি শুনলাম। রাত প্রায় দেড়টার দিকে শুয়ে পড়লাম। মশক সঙ্গীত ও নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য বেশ কয়েকবার স্প্রে করা হলো। ওখানকার মশাগুলোর জীবনীশক্তি অনেক বেশি, হতে পারে পাহাড়ে ট্রেনিংপ্রাপ্ত। কারণ স্প্রে করার পর মশাগুলো সেন্সলেস হয়ে ছিল, ঘন্টা দুয়েক পরে আবার শুরু করে আক্রমণ। তবে স্প্রেতেও ভেজাল থাকতে পারে। কিন্তু ভেজাল নাই মশার কামড়ে। তবে শান্তিচুক্তির বিষয় মশারা জানে না, কাজেই অশান্তি করার অধিকার তাদের আছে।
সকাল ৭টায় ঘুম থেকে তিনজনই উঠে তৈরি হলাম। পাশের বাসার হেডমাস্টারের সেই মেয়েটি আবারো চা করলো। আমার ব্যাগে কিছুবিস্কুট ছিলো, সেটিকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সার্কিট হাউজে গেলাম। সেখানে নাস্তার বিরাট আয়োজন। ড. হারুন বললেন হাসান ভাই আর না খেলেও চলবে। হাসান ভাই হাসতে হাসতে বললেন, ‘আরে ভাই খেয়ে নিন, সময়মত উটের মত কাজে লাগাবে। আমি অবশ্য খাওয়ার পক্ষেই ছিলাম। নাস্তার টেবিলে সাজানো আছে পরটা, ডিম, ভাজি, পাউরুটি। তৈলযুক্ত পরাটা না খেয়ে তিন জনই পাউরুটি, ভাজি, ডিম নিলাম। ড. হারুন ১টি ডিম, ভাজি, পাউরুটি নিলেন, হাসান ভাই আবার ডিমের কুসুম খান না। তিনি ডিমের সাদা অংশ নিয়ে দুটো কুসুম আমাকে দিলেন। নাস্তার পর রওয়ানা করলাম স্টেডিয়ামে। পথে হাজার হাজার নারী পুরুষের ভিড়ে অতি কষ্টে ধীরে ধীরে আমাদের গাড়ি স্টেডিয়ামের গেটে পৌঁছালো। চারদিক থেকে মানুষ ছুটে আসছে জোয়ারের মত। উৎসবমুখর পরিবেশ।
মেটাল ডিটেক্টর পেরিয়ে আমরা ভিতরে প্রবেশ করলাম সকাল ৮.৩০ মিনিটে। সেখানে বিটিভির ডি.জি সৈয়দ সালাউদ্দিন কাজী, উপ মহাপরিচালক মোস্তফা কামাল, হামিদ ভাই ও রিয়াজ উদ্দিন বাদশা (প্রযোজক) এর সাথে অনুষ্ঠান সংক্রান্ত অলোচনা সেরে নিলাম। তখনো আলী যাকের, আবেদ খান, শাহরিয়ার কবির এসে পৌঁছাননি। অনুষ্ঠানসূচি নিয়ে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সাথেও আলোচনা সেরে নিলাম। বেলা ১০টা মূল মঞ্চের পাশে আমাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে বসলাম। ততক্ষণে আলী যাকের, আবেদ খান, শাহরিয়ার কবির এসে পৌঁছলেন। এদিকে হাজার হাজার দর্শকে নবনির্মিত স্টেডিয়ামটি পরিপূর্ণ। মাঠের পূর্ব দিকে সেনাবাহিনীর বাদক দলের পরিবেশন চলছে। আমি ক্যামেরা ও মাইক্রোফোনসহ সাউন্ড চেক করে দেখলাম। সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছে উত্তেজনা ততই বাড়ছে। ইতোমধ্যে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, সাংসদবৃন্দসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেত্রীবৃন্দসহ বিদেশি কূটনীতিকরাও উপস্থিত হয়েছেন।
ঠিক পৌনে ১১টায় স্যাটেলাইট কানেকশন পাওয়া গেল। আমাকে বলা হলো অনুষ্ঠান শুরু করতে। আমি স্টেডিয়ামের সকল দর্শক এবং টি.ভি. সেটের সামনের সকল দর্শককে অভিনন্দন আর শুভেচ্ছা জানিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করলাম।
কিছুক্ষণ বলার পর আবেদ ভাইকে মাইক্রোফোন দিলাম। তিনি কিছুক্ষণ পটভূমি বলে ড: হারুনকে দিলেন। একে একে হাসান ভাই, আলী যাকের, শাহরিয়ার কবির সবাই বলার পর আবার আমি কিছুক্ষণ স্টেডিয়ামের বর্ণনা দিলাম। এভাবে চলতে থাকলো কিছুক্ষণ।
হঠাৎ শুনতে পেলাম সেনাবাহিনীর বাদক দল উপজাতীয় সঙ্গীতে একটি চমৎকার সুর বাজাতে শুরু করেছে। সাথে সাথে দেখলাম স্টেডিয়ামের গেইট দিয়ে আজকে যাদের নিয়ে অনুষ্ঠান তারা অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্যরা সারিবদ্ধভাবে একে একে মাঠে প্রবেশ করতে শুরু করলো। দর্শক করতালি দিয়ে তাদের বরণ করে নিচ্ছে। আমি টিভির দর্শকদের বিষয়টি তাৎক্ষণিক অবগত করলাম।
অনুষ্ঠানটি একই সাথে বাংলাদেশ বেতার ও বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে। যাক সে কথা, জনসংহতি সমিতির সদস্যদের মাঠে প্রবেশ শেষ হওয়ার পর, তারা সকলে সামরিক কায়দায় মাঠে তাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে বসেছে। এরই মধ্যে জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান জোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা মাঠে প্রবেশ করেছেন। আমি সেটি ঘোষণা করলাম। আলী যাকের সাহেব ইংরেজিতে ঘোষণা করলেন। একদিকে আমরা স্টেডিয়ামে চিত্র তুলে ধরছি বর্ণনার মাধ্যমে। অন্যদিকে বাদক দলের বাজনা আর কানায় কানায় পূর্ণ স্টেডিয়াম ভর্তি মানুষ। গ্যালারিতে দর্শক আর উঠতে পারছে না। মাঠের বাইরে অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে। সবাই অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কখন আসবেন।
কিছুক্ষণ পর বাদক দল ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটির সুর বাজাতে শুরু করলো। ১৯৭১-এ গানটির ভূমিকা সম্পর্কে আবেদ ভাই কিছুক্ষণ বললেন। এরই মধ্যে খবর এলো প্রধানমন্ত্রী আসছেন। সাথে সাথে আমি প্রধানমন্ত্রীর আগমনবার্তা ঘোষণা করে দিলাম। তিনি স্টেডিয়ামে প্রবেশ করলেন। সবাই দাঁড়িয়ে এবং করতালির মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানালেন। মঞ্চে আসন গ্রহণকারী অন্যান্য অতিথির নাম আমি একে একে ঘোষণা করলাম।
এরপর ঘোষণা করলাম-সুধী দর্শকবৃন্দ এখন জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হবে- আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম শুরু হলো জাতীয় সঙ্গীত। এরপর কোরআন তেলাওয়াত, গীতা পাঠ, ত্রিপিটক ও বাইবেল পাঠ শেষ হলো। ঘোষণা করলাম সুধীবৃন্দ এখন মূল্যবান ভাষণ প্রদান করবেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যাঁর অক্লান্ত ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় আজকের এই ১০ ফেব্রুয়ারি। সুধীবৃন্দ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী... আলী যাকের সাহেব ইংরেজিতে ঘোষণা করলেন। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে তিন পার্বত্য জেলার অনেক সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিলেন। সবাইকে শান্তির পতাকাতলে একত্রিত হবার আহ্বান জানালেন এবং অস্ত্র জমাদানকারী সকল সদস্যকে সাদরে বরণ করে নিলেন। প্রধানমন্ত্রী ভাষণ শেষ করলেন। এরপরই ঘোষণা করলাম সুধীদর্শক এখন সূচিত হচ্ছে বহু কাক্সিক্ষত সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি, যে মুহূর্তটির জন্য খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামের দিকে তাকিয়ে আছে সমগ্র দেশবাসী। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যার জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা কর্তৃক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট অস্ত্র জমাদান পর্ব। হাসিমুখে প্রধানমন্ত্রীর হাতে অস্ত্র তুলে দিলেন জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। স্টেডিয়ামে উপস্থিত হাজার হাজার দর্শক দাঁড়িয়ে করতালির মাধ্যমে শান্তির পক্ষে সম্মতি জানালো এবং করতালির মাধ্যমে এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটিকে আরো প্রাণবন্ত আকর্ষণীয় করে তুললো। প্রধানমন্ত্রী সন্তু লারমার হাতে একজোড়া সাদা গোলাপ তুলে দিলেন। সূচিত হলো শান্তির এক নব দিগন্ত।
প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য অতিথির সাথে সন্তু লারমা মঞ্চে আসন গ্রহণ করলেন। এরপর ঊষাতন তালুকদারের নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতির ৭ শত ৩৯ সদস্য নির্ধারিত স্থানে অস্ত্র জমা দিলেন। আরেকটি ঘোষণা দিলাম। প্রধানমন্ত্রী শান্তির পায়রা উড়িয়ে দিলেন খাগড়াছড়ির উন্মুক্ত আকাশে। একই সাথে গ্যালারি থেকে রং বেরঙের বেলুন উড়ানো হলো। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। প্রধানমন্ত্রী জমাকৃত অস্ত্র পরিদর্শনে গেলেন এবং সমিতির সদস্যদের সাথে কুশল বিনিময় করে মঞ্চে আসন গ্রহণ করলেন। এরপর শুরু হলো সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ঢাকা ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গীত ও নৃত্যশিল্পীদের অংশ গ্রহণে শামীম আরা নীপার পরিচালনায় আনন্দ সঙ্গীত ও দলীয় নৃত্য। সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন আজাদ রহমান, মহাপরিচালক (বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি)।
ঐতিহাসিক দিনটির আনুষ্ঠনিকতা শেষ হলো। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানস্থল থেকে বিদায় নিলেন। স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শক ধীরে ধীরে আসন ছেড়ে বাড়ি ফিরতে শুরু করলো। মাঠের মাঝখানে তখনও সারিবদ্ধভাবে বসে আছে জনসংহতি সমিতির অস্ত্র জমাদানকারী ৭৩৯ জন সদস্য। এদিকে প্যাভিলিয়ন থেকে আমাদের ঘোষণা মঞ্চের দিকে এগিয়ে এলেন গোলাম কুদ্দুস, জেনারেল সেক্রেটারি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। তিনি সকাল ১১টায় হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা থেকে অন্যান্যের সাথে আজকের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। তাঁর সাথে কুশল বিনিময় করে আমি, হাসান ভাই, ড. হারুন ও
গোলাম কুদ্দুসসহ জনসংহতি সমিতির সদস্যের সাথে কথা বলার জন্য মাঠের ঠিক মাঝখানে গেলাম। হাসান ভাই ও আমি ৩-৪ জন সদস্যের সাথে হ্যান্ডশেক করতে চাইলে তারা অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্তভাবে হাত এগিয়ে দেয়। নাম জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু কোন উত্তর পেলাম না। ধরে নিলাম তারা আমাদের কথা বোঝেনি, যেহেতু তারা গভীর জঙ্গলে বাস করে। সাধারণ মানুষের সাথে মেলামেশা করার সুযোগ তাদের হতো না। তাদের চোখে মুখে দেখেছি হতাশা, ভয়, আতঙ্ক। মনে হয়েছে তারা বিশ্বাস করতে পারছে না যে, তাদেরকে সরকার সাধারণ ক্ষমা করেছে। শুধু তাই নয়, তাদেরকে পাঁচ হাজার টাকা প্রদানসহ চাকরিও দেওয়া হবে।
এই সদস্যদের মধ্যে যারা অস্ত্র জমা দেয়নি বা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায়নি হয়তো তারা এদেরকে বলেছে, অস্ত্র জমা দিলে সরকার সবাইকে একসাথে মেরে ফেলবে। আর সে জন্য তাদের চোখে মুখে এত আতঙ্ক। সবাই মাঠ ছেড়ে যাচ্ছে যে যার মত করে। আমরাও বের হতে শুরু করলাম।
মাঠের বাইরে এসে দেখি মামুনুর রশীদ (নাট্যকার ও অভিনেতা) হাসান আরিফ, আফজাল হোসেন, পরিচিত অভিনেতাসহ আরো অনেকে। সবাইকে একসাথে দেখে মনে হলো যেন টিএসসিতে আছি। টিএসসিতে মাঝে মধ্যে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকেই একত্রিত হন।
আমি, হাসান ভাই, ড. হারুন আমরা আমাদের জন্য নির্ধারিত গাড়ির সন্ধানে ছুটলাম হাজারো মানুষের ভিড়ে আর ধুলোবালি উপেক্ষা করে। এর মধ্যে গোলাম কুদ্দুস বললেন তিনি আমাদের সাথে যাবেন। অনুষ্ঠানের দিন সকালে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার যোগে এসেছে এবং অনুষ্ঠান শেষ হলে আবার তাদের জন্য নির্ধারিত হেলিকপ্টারে ঢাকায় ফেরার কথা। হাসান ভাই কুদ্দুস ভাইকে বললেন, তুমি হেলিকপ্টারের আরামের জার্নি ছেড়ে আমাদের সাথে মাইক্রোতে যেতে চাচ্ছো কেন? কুদ্দুস ভাই বললেন, হাসান ভাই, আমি আগে কখনো হেলিকপ্টারে উঠিনি- আজকেই প্রথম। সবাই বসলাম, এরপরই দেখলাম, একজন এসে দরজা জানালা সব বন্ধ করে দিলেন। পরক্ষণেই দেখলাম একই লোক চালকের আসনে বসলো। স্টার্ট হলো হেলিকপ্টার উপরে উঠতে লাগলো। অনেক উপর দিয়ে আমরা উড়ে যাচ্ছি আর ভাবছি খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি তিন পার্বত্য অঞ্চলের কথা। দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সমস্যার একটা সফল সমাধান হতে যাচ্ছে। সেই দৃশ্য আজ স্বচক্ষে দেখবো। ততক্ষণে আমরা অনেক উপরে। হঠাৎ দেখি পাইলট আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছে, সবার খোঁজ খবর নিয়ে যাচ্ছে। পাইলটের আসনে তাকালাম, আসন শূণ্য। আমি চোখে মুখে অন্ধকার দেখলাম। হেলিকপ্টার কিন্তু চলছে। আমি তখন রীতিমত ঘামছি। এ কি করে সম্ভব। আমরা এখন কার নিয়ন্ত্রণে যাচ্ছি, কী ভাবে যাচ্ছি। আদৌ যেতে পারবো কি না ! যা হোক শেষ পর্যন্ত খাগড়াছড়ি এসে পৌঁছলাম। তবে আমি আর হেলিকপ্টারে যাবো না। আপনাদের সাথে চার চাকায় পাহাড় পর্বত দেখতে দেখতে যাবো। (পুরো বর্ণনা নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায়) কুদ্দুস ভাইয়ের বর্ণনা শুনে আমরা আর না করতে পারিনি। চারজনই মাইক্রোতে বসলাম। প্রথমেই গেলাম গতরাতে যেখানে ছিলাম সেখানে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে কিছু খাবার খেয়ে নিলাম। কুদ্দুস ভাই বললেন, দুপুর বেলা ভালো ভালো খেতে পারলে হতো। আমার একটু ঘুমাতে ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছিল তখন। গতকালের ৮-৯ ঘন্টা ঔঁৎহবু, সারারাত পরের দিনের স্ক্রিপ্ট তৈরি, সকাল ৭টায় উঠে ৮টায় অনুষ্ঠান স্থানে উপস্থিত হওয়া, বেলা ২টা পর্যন্ত রোদে বসে অনুষ্ঠান পরিচালনা, সবকিছু মিলেমিশে আমরা সবাই ক্লান্ত। বিশ্রাম নেয়া আর হলো না। কারণ, আর কিছুক্ষণ পরেই ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হতে হবে।
বিরোধী দল ইঘচ সহ সাত দল ১০ই ফেব্রুয়ারি শান্তিচুক্তিকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম বিভাগে হরতাল ডেকেছে। কিন্তু খাগড়াছড়িতে হরতালের ছোঁয়া লাগেনি। হাসান ভাই বললেন, চলো সবাই সার্কিট হাউজে যাই। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হবো। সার্কিট হাউজে গিয়ে দেখলাম দুপুরের খাবারের ভালো ব্যবস্থা রয়েছে। সার্কিট হাউজটি পাহাড়ের উপর, চমৎকার ছিমছাম। কুদ্দুস ভাইয়ের ডাল ভাতের স্বপ্ন সত্যি হলো। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিল্ডিং, ডাইনিং রুমের পাশে বিশাল কনফারেন্স রুম। সেখানে আমরা প্রায় কুড়ি মিনিট বিশ্রাম নেয়ার সময়ই ঢাকায় ফেরার সময় নির্ধারণ করি। ঠিক ৩:৩০ মিনিটে সার্কিট হাউজ থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। গাড়ি চলছে, গত কয়েক ঘন্টার দৃশ্য চোখের সামনে ভাসতে লাগল। আমরা যাচ্ছি পশ্চিম দিকে। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। পাহাড়ের উপর থেকে পুরো খাগড়াছড়ি শহরটি দেখা যায়। দালান কোঠা সব কিছু অনেক নিচে ছোট ছোট দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের গায়ে ছোট বড় গাছগুলোর পাতায় সূর্যের সোনালী আলো চিকচিক করছে। হাসান ভাই বললেন, কুদ্দুস তুমি হেলিকপ্টারে গেলে এই সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পারতে না। হ্যাঁ আপনাদের সাথে পাহাড় পর্বত দেখতে দেখতে যাচ্ছি, ভালোই লাগছে, বললেন কুদ্দুস ভাই। হাসান ভাই বললেন-তুমি তো ভয়ে হেলিকপ্টারে যাওনি ! আমি বললাম, কুদ্দুস ভাইয়ের এই ত্যাগ ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে’ হেসে উঠলেন সবাই। দ্রুতগতিতে চলছে আমাদের মাইক্রো। পাহাড়ি এলাকার উঁচু নিচু পথ পেরিয়ে আমরা রামগড় পার হয়ে বিশ^ রোডে এসে পড়লাম। তখন সূর্য ডুবুডুবু। গাছ গাছালীর ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে। বিশ্বরোডে উঠে সবাই স্বস্তির নিঃশ^াস ফেললো। বাকি পথ কোন প্রকার ঝাঁকুনি ছাড়া পার হওয়া যাবে। বিশ্বরোডে উঠে আমি আমার পাশের গ্লাসটি নামিয়ে দিলাম। ঘন অন্ধকার মাঝে মধ্যে আলো দেখা যায়। দূরে অনেক দূরে। গাছপালা দ্রুত পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছি।
নীরবতা ভেঙে হাসান ভাই আবার তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের কথা শুরু করলেন। ৬০-এর দশকের চিত্র নায়ক আজিমের একটা ভক্সওয়াগন ছিল। আমরা দুজন যাচ্ছিলাম পুরনো ঢাকার একটা সরু রাস্তা দিয়ে। ড্রাইভ করছিলো আজিম। আমি পাশের সিটে। আজিম একটু অন্যমনস্ক হলো। আর তখনই ঘটলো বিপত্তি। আমাদের গাড়ির ধাক্কায় পাশের রিকশাচালক রাস্তায় ছিটকে পড়লো। আকস্মিক এই ঘটনায় আমরা দু’জনই হতভম্ব হয়ে পড়লাম। আশপাশের মানুষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আজিম গাড়ি থেকে নেমে রিকশা চালককে বললো, করো কি মিয়া রাস্তায় রিকশা চালাও একটু দেখে শুনে চালাতে পারো না। তোমাদের জন্য তো রাস্তায় গাড়ি বের করা যাবে না। রিকশাচালক এবং আশপাশের মানুষ কার ভুলের কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বুঝে ওঠার আগেই আজিম গাড়ি ঝঃধৎঃ দিয়ে দ্রুত প্রস্থান। না হলে সে দিন গণধোলাই খেতে হতো।
আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফেনীতে যাত্রা বিরতি। যে রেস্টুরেন্টের সামনে আমাদের গাড়ি থামলো সেখানেই আলী যাকের, আবেদ খান ও শাহরিয়ার কবির তিনজনের সাথে দেখা। তারা আমাদের আগেই রওয়ানা হয়েছিলেন খাগড়াছড়ি থেকে। আমরা চায়ের অর্ডার দিলাম। কুদ্দুস ভাইয়ের বমি বমি ভাব, তিনি চা খাবেন না- একটা আড়সরহ ঞধনষবঃ খেয়ে নিলেন। এরই মধ্যে ফেনী কলেজের কয়েক জন ছাত্র এগিয়ে এলো বিশেষ করে হাসান ভাইকে দেখে। হাসান ভাই এর আগে বেশ কয়েকবার ফেনী কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে এসছেন। ছাত্ররাও হাসান ভাইয়ের পরিচিত। আর হাসান ভাইতো সর্ব মহলে পরিচিত। সবাই আজকের অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানের প্রশংসা করলো, প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে। আমাদেরও তাই। চা খাওয়া শেষ হলো, বিল পরিশোধ করলেন হাসান ভাই। বেরিয়ে আসলাম গাড়িতে উঠবো, এমন সময় একজন ছাত্র বললো একটু দাঁড়ান প্লিজ। আপনাদের সাথে কয়েকটি ছবি তুলবো, ফটোগ্রাফার আসছে। স্ন্যাপ নেওয়া হলো কয়েকটি। ছাত্রদের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে বসলাম। এবার কুদ্দুস ভাই সামনের আসনে চালকের পাশে। আমি, হাসান ভাই ও ড. হারুন মাঝখানের আসনে বসলাম।
যাত্র শুরু বৃহত্তর নোয়াখালীর বর্তমান ফেনী জেলার উপর দিয়ে। আমার বাড়ি নোয়াখালী জেলার মাইজদীতে। ফেনী অতিক্রম করার সময় বাড়ির কথা মনে পড়লো। দীর্ঘদিন নানা কাজের চাপে বাড়ি যাওয়া হয় না। একে একে বাড়ির সবার কথা মনে পড়তে লাগলো। হঠাৎ গাড়ির ব্রেকে বাস্তবে ফিরে আসি। শুনলাম আমরা একটা মারাত্মক দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে গেছি। আমার এক প্রিয়বন্ধু হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ একবার বলেছিলো চালকের অদক্ষতা, অসতর্কতা ও নানাবিধ কারণে লং ড্রাইভে গেলে ৮-১০ বার দুর্ঘটনায় পড়তে হয় এবং তাই হলো। আমরাও বেশ কয়েকবার ... থাক এখনো অক্ষত আছি। হঠাৎ সামনে চিৎকার ভাঙচুর দেখে আমাদের গাড়ি থামলো। কি ব্যাপার জানতে চাইলাম একজন পথচারীর কাছে। পথচারী জানালেন, আজকের হরতালের প্রতিক্রিয়া এটি। আগেই বলেছি শান্তিচুক্তির প্রতিবাদে বিএনপি ও সাত দল চট্টগ্রাম বিভাগে হরতাল ডেকেছে। সবার একটাই প্রশ্ন হরতাল শেষ হয়েছে প্রায় দু’ঘন্টা হতে চললো এখন কেন ভাঙচুর। অন্যজন বললেন ভাই এটা আমাদের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। আরো খোঁজখবর নিয়ে জানা গেলো জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কুমিল্লা শাখা বিক্ষোভ মিছিল বের করেছে। দু-চারটা গাড়ি ভাঙচুর না করলে বিক্ষোভ জমবে না। এই রীতি চলে আসছে দীর্ঘদিন যাবৎ। ১৯৭১-এর আগে জ¦ালাও-পোড়াও অসহযোগ, অবরোধ, ভাঙচুর এসব হতো পশ্চিম পাকিস্থানের বিরুদ্ধে আর সেই প্রক্রিয়া আমরা এখন নিজেরা নিজেদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করছি। ভাবতে কষ্ট হয়। যা হোক পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আমরাও রওয়ানা হই। ঢাকা আর মাত্র ২ ঘন্টার পথ। গাড়ি চলছে আমরা ক্লান্ত কারো মুখে কথা নাই। বেশি দ্রুত চালাতে গেলে কুদ্দুস ভাই ও হাসান ভাই যৌথভাবে চালককে নিবৃত্ত করে। ময়নামতি পার হয়েছি। সমনেই দাউদকান্দি ব্রিজ অনেক বড়, দেখার মত সুন্দর। আর কিছু দূর পরেই মেঘনা ব্রিজ যোগাযোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশের উন্নতি দেখতে বেশ ভাল লাগে। এদিকে দ্রুত প্রস্তুতির পথে দেশের সর্ববৃহৎ বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু, যা আগামী ২৩শে জুন (১৯৯৮) ৯টায় সেতুটি উদ্বোধন করা হবে। এদিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের দু’বছর পূর্ণ হয়। আমরা তখন ডেমরা পার হচ্ছি। সেখান থেকে রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে পৌঁছাতে ঘন্টা খানেক লাগার কথা। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের টার্গেট রাত ১০টার আগে বাসায় পৌঁছানো। গাড়ি চলছে, আমরাও ক্লান্ত। সাথে ঘরে ফেরার আনন্দ। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগে হাসান ভাইকে তার মগবাজারের বাসায় নামিয়ে আমি হাতিরপুল নেমে গেলাম।রাস্তার পাশেই আমার বাসা। দ্রুত বাসায় গেলাম। ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলাম সেদিন সকালে সারসরি সম্প্রচারিত অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানটি এতক্ষণ বিটিভিতে পুনঃপ্রচার হয়েছে। ঘোষকের ছবি ভেসে উঠল- সুধীবৃন্দ, এতক্ষণ ঐতিহাসিক অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানটি প্রচার করা হলো। আমি নিজেও একজন টিভি ঘোষক। আমিও বলতে চাই- প্রিয় পাঠকবৃন্দ, এতক্ষণ খাগড়াছড়ি অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানে আমাদের অংশগ্রহণের বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।
ধন্যবাদ সবাইকে।
লেখক : উপস্থাপক