পেটেই ভাত দিবার পাইতাছি না আংগরে আবার ঈদ। পুলাপান কান্দাকাঠি করতাছে, ঈদ আইয়া পড়লো নয়া কাফর কিনা দেও। পেটে ভাতই দিবার পাইতাছি না নয়া কাফর কিন্যা দিমু ক্যামনে। আল্লায় আমগো কফালে ঈদের আনন্দ লেহে নাই। এভাবেই চোখের পানি ফেলে কষ্টের কথা জানালেন ইসলামপুরের পার্থশি ইউনিয়নের শেখপাড়া গ্রামের মৃত সাকোয়াত হোসেনের স্ত্রী (৬০)
বছর বয়সি বানভাসী হিমানি বেগম।
চোখের সামনে বাঁধ ভেঙে প্রবল বেগে বন্যার পানির ধাক্কায় ঘর বাড়ি ও সহায় সম্পদ ভেসে যাওয়ার করুণ কাহিনী তুলে ধরে হিমানী বেগম আরো জানান, পানির শো শো গর্জন, তীব্র স্রোতে এক পলকেই বেড়ের ধান, গৃহস্থলির জিনিসপত্রসহ বাড়ি ঘর ভেসে যায়। বাড়ির পিছনে গাছ বাঁশ ধরে ধরে কোনমতে পাড়ে উঠে প্রাণে বেঁচে যায়। আশ্রয় নেয় পাশের শেখপাড়া হাফিজিয়া মাদ্রাসায়। পানি নেমে যাওয়ার পর মাদ্রাসা খুললে সেখান থেকে চলে আসতে হয়। বিধ্বস্ত বাড়িঘরে পড়ে থাকা টিনের চালের তলে রাত কাটাচ্ছেন তিনি। টাকার অভাবে বাড়িঘর মেরামত করতে পারছেন না। ঈদ তার কাছে ঝলছে যাওয়া এক ফালি রুটি।
চামেলা বেগমের (৩০) জানান, স্বামী অসুস্থ, টাকার অভাবে বাড়িঘর ঠিক করতে পারছেন না। ত্রাণ পেলে পেটে আহার জুটে। এক বেলা খেলে অন্য বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। ছেলে মেয়েদের চোখেমুখে তাকাতে পারছে না। ঈদে নতুন কাপড়ের বায়না ধরে কান্নাকাটি করছে। অবুঝ সন্তানরা আমার অসহায়ত্বে কথা বুঝাতে চাইছে না বলে আঁচলে চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে গেলেন।
একই গ্রামের আবুল হাসেম। বয়স ৫৫। চার ছেলে মেয়ে স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। কংকালসার শরীর। বন্যাকালীন ঠিকমতো খেতে না পেয়ে শরীর ভেঙে পড়েছে আবুল হাসেমের। আমাদের দেখে ত্রাণকর্মী ভেবে ছুটে আসে সে। বলে বাবা বুড়া মানুষ ঠেলাঠেলি করে ত্রাণ নিতে পারি না। আমার নামটা লেখেন। আমরা সাংবাদিক পরিচয় দিতেই চুপ হয়ে যায়।
ঈদ নিয়ে প্রশ্ন করতেই বলেন, ছেলে মেয়ে নাইনাতির চিৎকারে থাকতে পারছি না। যেহানে খাইতে পারি না কাফর কিনে দিমু ক্যামনে। আল্লায় ক্যান যে আমগো গরিব বানাইছে। তারমধ্যে বানে এবার ঈদের আনন্দ মাটি কইরা দিছে।
হামেলা, চামেলী ও হাসেমের মতো বন্যা দুর্গত এলাকায় সন্তানদের ঈদে নতুন কাপড়ের বায়না মেটাতে না পেরে সকলেই একই কথা বললেন।
বন্যায় আক্রান্ত ইসলামপুরের পার্থশি ইউনিয়নের শেখ পাড়া, মন্ডলপাড়া, মোরাদাবাদ ও মরাডুবিসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে ঈদ আনন্দ নিরান্দনে পরিণত হয়েছে। ঈদে নতুন কাপড়ের বায়নায় শিশুদের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে ঘর ঘর থেকে। ঈদ আনন্দের বদলে জীবন বাঁচাতে ত্রানের সন্ধানে ছুটাছুটি আর মাথাগুজার ঠাঁই করে রনিতে বাড়িঘর মেরামতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে বন্যা দুর্গতরা।
বন্যা ও নদী ভাঙনে ফসল সম্পদহানীর সঙ্গে সঙ্গে জামালপুরের যমুনাপাড়ের মানুষের মুখ থেকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে আসন্ন ঈদুল আজহার আনন্দ। এ কারণে ঈদের আনন্দ নেই বন্যাদুর্গত মানুষের মাঝে। তাই ঘরে ঘরে ঈদ প্রস্তুতির লেশমাত্র নেই বললেই চলে।
বড় গৃহস্থ হিসেবে পরিচিত আব্দুল মজিদ (৬৬)। এই সময়টা তিনি কোরবানির জন্য গরু কেনা, ঘরের বাজার সদাই আর পরিবার পরিজনের নতুন কাপড় কেনার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পশু কুরবানি, দুস্থদের মধ্যে মাংস বিলানো, বাড়িতে মেহমানদারিতে আনন্দে কেটে যায় ঈদের দিন। ২০ বছর ধরে এভাবেই ঈদুল আজহা কেটেছে কৃষক আব্দুল মজিদের। কিন্তু এবার ছিঁটেফোটাও পর্শ্ব করবে না তাকে। কারণ ফসল হারিয়ে তিনি নিঃস্ব, নিজেই এখন ‘দুস্থ’। সম্মানের ভয়ে চক্ষু লজ্জায় ত্রাণও নিতে পারছেন না, হাত পাততেও পারছেন না মানুষের কাছে। সংসারে দু’বেলা ভাত যোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন। যমুনাপড়ের সর্বত্র দুর্গত মানুষের ধনী-গরিব সকলের ঈদ আনন্দ নিয়ে একই জীবনচিত্র বিরাজ করছে।
কেএসটি