প্রতিবছর ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে ব্যস্ত হয়ে ওঠে পাবনা ও সিরাজগঞ্জের তাঁতপল্লিগুলো তবে, এবার করোনা মহামারির কারণে দেশের বৃহত্তম এই তাঁত এলাকায় সেই দৃশ্য নেই।
গত বছরেও করোনা মহামারির কারণে কাঙ্ক্ষিত ব্যবসা করতে না পেরে পুঁজি হারিয়েছেন অনেকেই। লক্ষ্য ছিল চলতি বছরে সেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার। কিন্তু এবারও ঈদের ব্যবসা শুরু করার আগেই করোনার থাবায় হুমকির মধ্যে পড়েছে দেশের বৃহত্তম এই তাঁতশিল্প এলাকা। তাঁতশিল্পকে বাঁচাতে সংকট নিরসনে সরকারের প্রতি সহযোগিতার দাবি জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা।
সূত্র জানায়, প্রতিবছর রোজার দুই সপ্তাহ আগে থেকেই পাবনা ও সিরাজগঞ্জরে তাঁত কাপড়ের হাটে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকার ব্যবসায়ীরা কাপড় কিনতে আসেন। এ বছর করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করায় হাটে আসতে পারেনি ক্রেতারা। ২৫ এপ্রিল থেকে দোকান ও শপিং মল খুলে দেওয়া হলেও কিছু কিছু পাইকার হাটে এলেও এখনো ঈদের কাঙ্ক্ষিত ব্যবসা শুরু হয়নি বলে দাবি করেছেন তাঁতিরা।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের বৃহত্তম তাঁত কাপড়ের পাইকারি হাটের ব্যবসায়ী রহমত আলি জানান, স্বাভাবিক সময়ে প্রতি হাটবারে তার দোকান থেকে প্রায় ৫০০ থেকে ৮০০ পিস কাপড় পাইকাররা কিনতেন। তবে এ বছর করোনার কারণে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা আসতে না পারায় বিক্রির পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে।
বাংলাদেশ স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলস অ্যান্ড পাওয়ারলুম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসটিএমপিআইএ) পরিচালক মো. হায়দার আলি বলেন, “স্বাভাবিক সময়ে প্রতিবছর ঈদের সময় প্রতি হাটে প্রায় ২০০ কোটি টাকার বেশি তাঁত কাপড় বিক্রি হত শাহজাদপুর হাট থেকে। কিন্তু করোনার কারণে গত বছর অর্ধেক কাপড় বিক্রি করতে পারেনি তাঁতিরা। একই অবস্থা এ বছরেও। কয়েক সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর হাট শুরু হলেও আশানুরূপভাবে বিক্রির পরিমাণ বাড়েনি। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা না আসায় দেশের অন্যতম বৃহত্তম তাঁত কাপড়ের হাটের পাইকার ব্যবসায় ধ্বংস নেমেছে।”
তবে আবারও ঋণ করে হলেও তাঁতিরা উৎপাদন শুরু করেছে। গত বছরের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পারায় অধিকাংশ তাঁতির ঘরেই থরে থরে জমে আছে সেসব কাপড়। তারপরেও নতুন করে কাপড় তৈরি করতে শুরু করেছেন সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার তাঁতিরা।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার রূপপুর গ্রামের তাঁত কারখানার মালিক আল-আমিন হোসেন বলেন, “গত দুই বছরে টানা লোকসানে অর্থ সংকটে পড়েছে আমার কারখানা। আমার এখানে প্রায় ৩০টি তাঁত আছে। অর্থ সংকটের কারণে গত কয়েক মাস কারখানা বন্ধ ছিল। অবশেষে ব্যাংক থেকে ১০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে এ বছর ঈদে ব্যবসা করতে কারখানা চালু করি। কিন্তু, চালু করার উদ্যোগ নেওয়ার পরপরই শুরু হয় লকডাউন। এ অবস্থায় কারখানা চালু করলেও ব্যংক ঋণের কিস্তির টাকাও তুলতে পারব না।”
একই এলাকার তাঁত ব্যবসায়ী মো. আতিক বলেন, “আমার প্রায় ২০টি তাঁতের আটটি তাঁতই বন্ধ। গত বছরের অর্ধেক কাপড় এখনো পড়ে আছে। তবে ঈদের বাজার সামনে রেখে আবারও উৎপাদন শুরু হয়েছে। প্রতিদিন ৬০ থেকে ৮০টি কাপড় তৈরি হলেও বিক্রি না থাকায় বেশিরভাগ কাপড় জমে আছে ঘরে।”
সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন এখানকার দরিদ্র তাঁত শ্রমিকরা। বছরের এই সময়ে তারা উৎসবের আমেজে কাজ করে, সারা বছরের উপার্জনের বেশির ভাগ আসে রমজান মাসে। কিন্তু করোনার কারণে তাদের অনেকেই এখন কর্মহীন।
সিরাজগঞ্জের তাঁত শ্রমিক আব্দুল জলিল বলেন, “প্রতি বছর আমরা রোজার সময়ে বছরের সবচেয়ে বেশি আয় করি। এ বছর কাজ শুরু হলেও বিক্রি কমে যাওয়ায় কারখানার উৎপাদনও কমে গেছে। অন্যান্য বছর ঈদের এ সময় আমরা প্রতিদিন ১০ থেকে ১২টি শাড়ি তৈরি করি, এজন্য প্রায় এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ পর্যন্ত আয় হতো। এ বছর উৎপাদন কম হওয়ায় প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার বেশি আয় হচ্ছে না।”
এ অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের পৈতৃক পেশা ছেড়ে চলে যেতে হবে বলে জানান তিনি।
তাঁত ব্যবসায়ী সমিতির দেওয়া তথ্য মতে, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় প্রায় ছয় লক্ষাধিক তাঁত আছে। এর মধ্যে ৪ লাখ তাঁত এখন বন্ধ হয়ে গেছে। ক্রমাগত লোকসান আর করোনা মহামারিতে পুঁজি হারিয়েছেন বেশিরভাগ দরিদ্র তাঁতি।
বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম ও পাওয়ারলুম এসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ও সিরাজগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি হায়দার আলি বলেন, “ঋণ করে যারা উৎপাদন শুরু করছে তারাও পণ্য বিক্রি করতে না পারায় ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে চাইছে।”
হায়দার আলি আরও বলেন, “দেশের উৎপাদিত মোট তাঁত কাপড়ের প্রায় ৪৮ ভাগ কাপড় উৎপাদিত হয় পাবনা ও সিরাজগঞ্জে। এ দুই জেলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত।”
মহামারির এ সময়ে দেশের বৃহত্তম তাঁত শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে জরুরিভিত্তিতে সরকারি সহযোগিতার দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের উপমহাব্যবস্থাপক রতন চন্দ্র সাহা বলেন, “আমরা প্রান্তিক তাঁতিদের সহযোগিতা দিয়ে থাকি। ৩-৫টা তাঁত আছে যাদের তাদের প্রান্তিক তাঁতি বলা হয়ে থাকে। তাদের ব্যবসায়ের জন্য আমরা ৩০ হাজার থেকে তিন লাখ টাকা ঋণ দিয়ে থাকি। তবে করোনার কারণে বড় ধরনের ক্ষতির ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। হয়তো সরকার সময়োপযোগী কোনো উদ্যোগ নেবেন।”