মাসুম লুমেন, গাইবান্ধা
উত্তরাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ সহজ করতে গাইবান্ধার বালাসীঘাট থেকে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত ফেরি রুট চালু করতে নির্মাণ করা হয় নৌ-টার্মিনাল ও অন্যান্য অবকাঠামো। দুই দফায় প্রকল্পটির ব্যয় বাড়িয়ে গত জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। অপেক্ষা ছিল উদ্বোধনের। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ'র হঠাৎ এক প্রতিবেদনে জানানো হলো, এই পথ ফেরি চলাচলের উপযোগী নয়। ফলে গচ্চা গেল সরকার তথা জনগণের কষ্টার্জিত ১৪৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা!
একসময় উত্তরাঞ্চলের মানুষের ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র পথ ছিল বালাসীঘাট-বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট। নৌপথে যোগাযোগের জন্য এই ঘাটের নামডাক ছিল দেশজুড়েই। কিন্তু নাব্যসংকট ও যমুনা নদীর গতিপ্রকৃতি বদলে যাওয়াসহ বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর পর ২০০৫ সালের ১৫ জুন বন্ধ হয়ে যায় এই ফেরি ঘাটটি। এরপর থেকে যমুনা নদীর দুই পাড়ের মানুষের যোগাযোগের একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়ায় ইঞ্জিনচালিত ছোট বড় নৌকা। প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার মানুষ নৌকায় নদীপথে চলাচল করে আসছে। এতে পণ্য পরিবহনসহ যেকোনো প্রয়োজনে যাতায়াতে নৌকায় গুনতে হতো বেশি ভাড়া। যোগাযোগের সেতুবন্ধের এই ঘাটটি যমুনার দুই পাড়ের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল আবারও ফেরি চলাচল হবে।
যমুনা নদীর বঙ্গবন্ধু সেতুর বিকল্প পথ তৈরি করা হবে- এমন যুক্তি দেখিয়ে ২০১৪ সালে 'বালাসী ও বাহাদুরাবাদে ফেরিঘাটসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ' শীর্ষক এক প্রকল্পের ডিপিপি প্রস্তুত করা হয়। ডিপিপিতে বলা হয়, এ রুটে ফেরি চালু হলে বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর সৃষ্ট অতিরিক্ত চাপ কমবে এবং পণ্য ও যাত্রী পরিবহণে স্থানভেদে ১০০ থেকে ১৭০ কিলোমিটার কমে যাবে। এরপর ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে একনেকের এক সভায় বালাসীঘাট থেকে বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত নৌ রুটটি আবারও চালু করে ফেরি ঘাট নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পটির প্রথম ব্যয় ধরা হয়েছিল তখন ১২৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। পরবর্তী সময়ে দুবার সংশোধন করে প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ১৪৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা খরচ করে বাস টার্মিনাল, টোল আদায় বুথ, পুলিশ ব্যারাক, ফায়ার সার্ভিস ও আনছার ব্যারাকসহ বেশ কিছু স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএর কারিগরি কমিটি হঠাৎ করে নাব্যসংকট ও ২৬ কিলোমিটার বিশাল দূরত্বের নৌপথসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরে নৌ রুটটি চলাচলে অনুপযোগী বলে প্রতিবেদন দেয়। এতে এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দেয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই কাজ শুরু এবং শেষ পর্যায়ে এসে ফেরিঘাট প্রকল্পটি বাতিলের এমন সিদ্ধান্তে বিআইডব্লিউটিএর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গাইবান্ধার মানুষের উন্নয়নের স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। এই অঞ্চলের মানুষ এখন হতাশাগ্রস্ত। এ জন্য বিআইডব্লিউটিএকে দায়ী করেন তারা।
তারা আরও বলেন, ফেরি চলাচল হলে এই এলাকার মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন আসত। সরকারের ১৪৫ কোটি টাকা ব্যয় করার আগে ভালোভাবে সমীক্ষা করা দরকার ছিল। ফেরি চলাচল হলে এই এলাকায় শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটত। এতে বেকারত্ব ঘুচত। মূলত, গাইবান্ধার মানুষের সঙ্গে একপ্রকার প্রতারণা করা হলো। বিআইডব্লিউটিএর কারণে এই প্রকল্পে ক্ষতি হয়েছে। প্রকল্পটি পুনর্বিবেচনা করে এখানে যাতে ফেরি চলাচল হয়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি তাদের।
এদিকে ফেরি চালু করা সম্ভব নয় বলে প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে গাইবান্ধার নাগরিক সমাজ। নাগরিক মঞ্চের ব্যানারে গাইবান্ধার বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতারা বিআইডব্লিউটিএ'র কারিগরি কমিটির প্রতিবেদনের পর একের পর এক বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করছে। বিআইডব্লিউটিএ-র দায় সারা কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সামাজিক আন্দোলনের নেতারা। তারা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত হঠকারিতা ও সরকারের অর্থ লুটপাট এবং জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। লুটপাটের তদন্তসহ জড়িতদের বিচারের দাবিও জানান তারা।
এ ব্যাপারে গাইবান্ধা নাগরিক মঞ্চের সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু জাগরণকে বলেন, আমরা মনে করি রাষ্টীয় ১৪৫ কোটি টাকা বিআডব্লিউটিএ লুট করে বাংলাদেশ তথা গাইবান্ধার মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা করেছে। এই লুটপাটের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার হোক পাশাপাশি অবিলম্বে বালাসী-বাহাদুরাবাদ ফেরি সার্ভিস চালু করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে দাবি আদায় না হলে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে উর্ধ্বতন কতৃপক্ষকে স্মারকলিপি প্রদান করা হবে। তাতেও কাজ না হলে গাইবান্ধার সব নাগরিককে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলেও তিনি জানান।
সর্বশেষ চলতি বছরের জুনে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (সেক্টর-৮) এই প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষা প্রতিবেদনে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পর্কিত কিছু সমস্যা চিহ্নিত করে। সংস্থাটির ড্রেজিং বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রকিবুল ইসলাম তালুকদারকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি চলতি বছরের এপ্রিল ও মে মাসে সরেজমিনে দুটি বালাসিঘাট ও বাহাদুরাবাদ ঘাট পরিদর্শন করে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, নাব্যতা সংটের কারনে গাইবান্ধার বালাসিঘাট থেকে ফেরি চলাচল সম্ভব নয়।
নদী বেষ্টিত গাইবান্ধার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, আবারও সচল হবে ঐতিহ্যবাহী বালাসীঘাটের ফেরি চলাচল। কিন্তু ফেরি চালুর যে স্বপ্নের আশায় বুক বেঁধেছিল যমুনার দুই পাড়ের মানুষ, তা একটি প্রতিবেদনেই নস্যাৎ হয়ে গেছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ অধিকতর তদন্ত করে পূনরায় এই রুটে ফেরি সার্ভিস চালু করবে, এমনটা প্রত্যাশা করে গাইবান্ধার মানুষ।