ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে ঠান্ডায় রাশেদুল ইসলাম নামে নরসিংদীর আরও এক যুবকের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে পরিবার। দূতাবাসের মাধ্যমে পাসপোর্ট ও মরদেহের ছবি দেখে পরিবারের সদস্যরা তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। এই ঘটনায় একই এলাকার আরও দুই যুবক নিখোঁজ রয়েছে বলে জানায় স্থানীয়রা।
নিখোঁজ আরও দুজন হলেন, হাবিবুর রহমানের ছেলে শরীফুল ইসলাম (২২) ও ইউনুস মিয়ার ছেলে সালাহউদ্দিন (৩৫)। তারা তিনজনই পরস্পর আত্মীয়। রায়পুরা উপজেলার আদিয়াবাদ এলাকার মনির নামে এক দালালের মাধ্যমে সাড়ে ৮লাখ টাকা করে দিয়ে অবৈধভাবে ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন।
জানা যায়, রাশেদুল ইসলাম বেলাব উপজেলার সল্লাবাদ ইউনিয়নের ইব্রাহিমপুর গ্রামের কৃষক মো. আবদুর রউফ মিয়ার ছেলে। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে রাশেদুল দ্বিতীয়। রাশেদুল স্থানীয় একটি বিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালে এসএসসি পাস করার পর ভৈরবের হাজী আসমত আলী কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়। দীর্ঘদিনের চেষ্টায় কৃষক বাবাকে ইতালি যাওয়ার বিষয়ে রাজি করায় রাশেদুল। আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধারদেনা করে সাড়ে আট লাখ টাকা তার হাতে তুলে দেন বাবা।
পরিবারের সদস্যরা জানান, বৃহস্পতিবার (২৮জানুয়ারী) বাংলাদেশ সময় রাত ৩টার দিকে লিবিয়ার একটি সৈকত থেকে নৌকায় করে ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল তারা। এর তিন দিন পর রবিবার (৩১ জানুয়ারী) দুপুরে লিবিয়ার দূতাবাস থেকে মরদেহের সাথে থাকা একটি পাসপোর্টের সূত্রধরে রাশেদুলের মৃত্যুর খবর জানানো হয়। ওই সময় মরদেহের ছবি দেখতে চাইলে আরও দুদিন পর মঙ্গলবার (১ ফেব্রুয়ারী) রাতে তাদেরকে ছবি দেখানো হয়। এরপরই রাশেদুলের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হয় পরিবার। তবে একই সাথে থাকা নিখোঁজ বাকি দুজনের সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।
পরিবারের সদস্যরা আরও বলেন, ২০২১ সালের ৩ ডিসেম্বর ইতালির উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে রওনা হন একই এলাকার এই তিন যুবক। তারা প্রথমে পাড়ি জমায় লিবিয়ায়। সেখানে দেড় মাস থাকার পর দালালের লোকজন জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে নিয়ে যায় লিবিয়ার ত্রিপোলি শহরে। সেখানে ১৫ দিন অবস্থানের পর বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারী) রাত ৩টার দিকে ভূমধ্যসাগর দিয়ে নৌপথে পাড়ি জমান ইতালির উদ্দেশ্যে। রবিবার (৩১ জানুয়ারী) দুপুরে লিবিয়া দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা আমাদের ফোন করে জানান, অবৈধভাবে নৌকায় করে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে ঠান্ডায় জমে মারা গেছেন রাশেদুল। ওই যাত্রায় রাশেদুলের সাথে ছিলেন শরীফুল ইসলাম ও সালাহউদ্দিন। ঘটনার পর থেকে তারা দুজন নিখোঁজ।
নিহত রাশেদুলের বড়ভাই মো. আশিক মিয়া জানান, বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারী) রাতে ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে আমাদের সাথে তার সর্বশেষ কথা হয়। তখন তারা দোয়া কামনা করে বলেছিল, কিছুক্ষণ পরেই রওনা হব, একটু পরই মোবাইল বন্ধ করে দেব। এর তিন দিন পর রাশেদুলের পাসপোর্টের সূত্র ধরে দূতাবাস থেকে ফোন করে তার মৃত্যু খবর জানানো হয়। আমরা ভেবেছিলাম, পাসপোর্টটি তার কাছে না থেকে অন্য কারও কাছেও তো থাকতে পারে। তাই মরদেহের ছবি দেখতে চেয়েছিলাম। মঙ্গলবার (১ ফেব্রুয়ারী) রাতে আমাদের মরদেহের ছবি দেখানো হলে আমরা তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হই। সংসারের অভাব দূর করার জন্য ইতালি যেতে গিয়ে তাকেই হারিয়ে ফেললাম আমরা। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তার মরদেহ দেশে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
নিখোঁজ সালাহউদ্দিনের বড়ভাই মনিরুজ্জামান জানান, একটি সূত্রে জানতে পারেন, সালাহউদ্দিন ও শরীফুলসহ আরও অভিবাসনপ্রত্যাশীদের একটি কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। তবে তাদের সাথে ঠিক কি হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়ন। সালাহ উদ্দিন এলাকায় ফার্মেসির ব্যবসা করতো। তার স্ত্রী ও দুই বছরের একটি মেয়ে রয়েছে।
অন্যদিকে নিখোঁজ শরীফুল ইসলামের বাবা হাবিবুর রহমান জানান, মূলত সালাহ উদ্দিনের প্ররোচনায় শরীফুল ইতালি যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। সে ২০২০ সালে ভৈরবের হাজী আসমত আলী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে শরীফুল তৃতীয়। আমি আমার ছেলের খোঁজ চাই।
বেলাব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আক্তার হোসেন শাহীন জানান, এই ঘটনায় নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করা হলে আমি সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করবো। তার লাশ দেশে ফেরত আনার বিষয়ে একটি প্রত্যয়নপত্র দরকার হবে। আমি বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছি।
উল্লেখ্য, এর আগে গত ২৫ জানুয়ারি লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে অতিরিক্ত ঠান্ডায় সাত বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর জানা যায়। এরমধ্যে নরসিংদীর চারজনের খবর মেলে। এর আগে রায়পুরা উপজেলায় সাইফুল নামে আরেক যুবকের সন্ধান মেলে।
দৈনিক জাগরণ/আরকে