লক্ষ্মীপুর-ভোলা সড়ক নির্মাণে দিনে দুপুরে ডাকাতি

লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২২, ০১:৪৮ পিএম লক্ষ্মীপুর-ভোলা সড়ক নির্মাণে দিনে দুপুরে ডাকাতি

জামাল উদ্দিন বাবলু
ভোলা-বরিশাল মহাসড়কের লক্ষ্মীপুরের অংশের সাড়ে ১০ কিলোমিটার সংস্কার কাজে ঠিকাদার ইচ্ছেমতো কাজ করছেন। ১০৫ কোটি টাকার এ কাজে যেন নিয়ম শুধুই কাগজ-কলমে।

স্থানীয়রা অনিয়মের প্রতিবাদ অব্যাহত রাখলেও তা আমলে নিচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগ উঠেছে, তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলীর সঙ্গে ঠিকাদারের মধুর সম্পর্ক। এজন্য তিনি ঠিকাদারের পক্ষে কথা বলেন। লক্ষ্মীপুরসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের কষ্ট বেড়েছে কয়েকগুণ।

এদিকে মানুষের দুর্ভোগ আর অনিয়মের বিষয়টি একাধিক ব্যক্তি মাসিক জেলা আইন-শৃঙ্খলা ও সমন্বয় কমিটির সভায় বেশ কয়েকবার উপস্থাপন করেন। সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একাজে দিন-দুপুরে ‘ডাকাতি’ হচ্ছে জানিয়ে প্রতিকার চেয়েছেন। লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) তিনবার কাজটি বন্ধ করেছেন। তিনি অনিয়মের বিষয়টি লিখিতভাবে সড়ক সচিবকে জানিয়েছেন। এতেও কোনো প্রতিকার হয়নি।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) সূত্র জানিয়েছে, বরিশাল-ভোলা-লক্ষ্মীপুর জাতীয় মহাসড়কের বরিশালের চর কাউয়া থেকে ভোলার ইলিশা ফেরিঘাট হয়ে লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজ চলছে। এর আওতায় লক্ষ্মীপুর অংশে রয়েছে মজু চৌধুরীহাট ফেরিঘাট থেকে লক্ষ্মীপুর আন্তজেলা বাস টার্মিনাল পর্যন্ত সাড়ে ১০ কিলোমিটার সড়ক সংস্কার ও প্রশস্তকরণ। বাড়তি কাজসহ ১০৫ কোটি টাকা প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মো. মঈনউদ্দিন (বাঁশি) লিমিটেড কাজটি পেয়েছেন। কাজটি স্থানীয়ভাবে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাটের ইস্কান্দার মির্জা শামীম সমন্বয় করছেন। মির্জা শামীম সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কথিত ভাগিনা।

দুজন জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় ১৩ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সড়কের এ কাজে কার্যাদেশ মানা হচ্ছে না। প্রকৌশলী ছাড়াই ঠিকাদারের ইচ্ছেমতো রাতেও কার্পেটিং কাজ করা হয়। বালুভর্তি (ফিলিং) করে যানবাহন চলাচল নিশ্চিত করার কথা থাকলেও তা শুধু কাগজ-কলমে। পুরনো লেন মিলিয়ে কাজ করার কথা থাকলেও তা হয়নি। কয়েকটি অংশে পুরনো-পরিত্যক্ত পাথর ও খোয়া ব্যবহার করা হচ্ছে। খোয়া ও বালু দিয়ে সাববেইজ করার কথা থাকলেও আগের কার্পেটিং সিলকোট ফের ব্যবহার করা হচ্ছে প্রকাশ্যেই। সাববেইজে ৭০ ভাগ খোয়া, ৩০ ভাগ বালুর সংমিশ্রণের নিয়ম থাকলেও নির্ধারিত বালু না দিয়ে ভিটি বালু ও নিম্নমানের খোয়ার ব্যবহার হচ্ছে।

স্কুলশিক্ষক আলমগীর হোসেন ও পল্লী চিকিৎসক মো: ইসমাইল জানান, মেকাডমে আমদানি করা কালো পাথর ৮০ ভাগ ব্যবহারের কথা থাকলেও তা নামওয়াস্তে রাখা হয়েছে। স্টকইয়ার্ডে বেসিক প্ল্যান্ট বসিয়ে বেইজ ও ওয়ারিং কোর্স করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। মাটি বাইরে থেকে পরিবহন করে রাস্তার পাশ বাঁধাই করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। পাশের ক্ষেতের মাটি ও ময়লা-আবর্জনা ফেলে কাজটি করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সড়ক ও জনপথ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঠিকাদার মন্ত্রীর আত্মীয়। আর তদারকি কর্মকর্তার বাড়িও নোয়াখালীতে। তাদের সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। সঠিক তদারকি না থাকায় ঠিকাদারের লোকজন ইচ্ছেমতো কাজ করছেন। এছাড়া স্থানীয় প্রভাবশালী কয়েক ব্যক্তি কাজে নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ করায়ও এখানেও ঠিকাদার পাচ্ছেন বাড়তি সুবিধা।

চররমনী মোহন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু ইউছুফ ছৈয়াল বলেন, লক্ষ্মীপুরসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ এ সড়ক ব্যবহার করেন। এর চেয়ে নিম্মমানের কাজ আর হয় না। ঠিকাদার প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ায় আমাদেরও ভয়ে থাকতে হয়। প্রতিবাদ করলে আমাদের চাঁদাবাজ বলা হবে।

সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম সালাহ উদ্দিন টিপু বলেন, শতকোটি টাকার প্রকল্পে নামমাত্র কাজ করে সরকারের বদনাম করা হচ্ছে। অনেকস্থানে পুরনো রাস্তার ওপর কার্পেটিং দেয়া হচ্ছে। কয়েকমাস না যেতেই রাস্তাটির ভগ্নদশা হবে। তদারকি কর্মকর্তারা ঠিকাদারের কাছে ম্যানেজ থাকায় অভিযোগ করেও কোন লাভ নেই। ব্যস্ততম এ সড়কের কাজে চুরি নয়, দিন-দুপুরে ডাকাতি হচ্ছে।

ঠিকাদারের সমন্বয়ক ইস্কান্দার মির্জা শামীমের ভাষ্যমতে, নিয়মানুযায়ী ভালো পাথরসহ অন্যন্য সামগ্রী দিয়ে কাজটি করা হচ্ছে। কাজটি না পেয়ে স্থানীয় একটি মহল অপপ্রচার করছেন। লক্ষ্মীপুরে আরও অনেক কাজ চলছেও প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা কেন তাদের কাজটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন, তা বোধগম্য নয় বলেও জানান তিনি।

তদারকির দায়িত্বে থাকা লক্ষ্মীপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো: মোজাম্মেল হক বলেন, কাজের শুরুতে কিছুটা অনিয়ম হলেও এখন সঠিক নিয়মে হচ্ছে। ঠিকাদার ভালো করে কাজ করছেন। আমরাও নিয়মিত তদারকি করছি। কোন অনিয়ম হচ্ছে না। তিনি আশা করেন জুনের মধ্যে কাজটি শেষ হবে।

লক্ষ্মীপুর সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী তুহিন আল মামুন বলেন, আমি জানুয়ারিতে এখানে যোগদান করেছি। এরপর কাজের গুণগত মান ভালো দেখতেছি। অনিয়মের অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হবে।

জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো: আনোয়ার হোছাইন আকন্দ বলেন, অনিয়মের অভিযোগে তিনবার কাজটি বন্ধ করা হয়। বিষয়টি আমি লিখিতভাবে সড়ক সচিবকেও জানিয়েছি। সড়কের শতভাগ গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য ঠিকাদারকে বলা হয়েছে।

জাগরণ/আরকে