আলো জ্বালবে সংগ্রামী নারী ‘হাছনা‍‍`

মৌলভীবাজার প্রতিনিধি প্রকাশিত: মার্চ ১৬, ২০২২, ০৪:৩৯ পিএম আলো জ্বালবে সংগ্রামী নারী ‘হাছনা‍‍`

নির্যাতনের বিভিষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যোমে জীবনযুদ্ধে লড়াই করা সংগ্রামী এক নারী হাছনা হেনা। এখন তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আশায় বুক বেঁধে আছেন জীবনের আঁধার কেটে হয়তো একদিন আলো জ্বলবে।

সেই নারীকে শ্বশুর বাড়ির লোকজন শারীরিক নির্যাতন করে ফেলে দেয় হাওরের জলে। সেখান থেকে অচেতন অবস্থায় একজন জেলে উদ্ধার করেন। ফিরে যান বাবার বাড়ি।

মৃত্যু দুয়ার থেকে বেঁচে ফিরে এসে আবারো পড়ালেখা করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান ও সাহসিকতায় হয়েছেন জয়ি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে স্বীকৃতি স্বরুপ ক্রেস্ট, সনদ ও নগদ অর্থ পুরস্কার গ্রহণ করেন। ‘নির্যাতনের বিভিষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যোমে জীবন শুরুর’ ক্যাটাগরিতে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ হন তিনি।

মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার টেংরাবাজার ইউপির টেংরা গ্রামের মৃত কুটি মিয়ার মেয়ে হাছনা হেনা। বিয়ে হয়েছিল ২০০৭ সালে, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মুমিনপুর গ্রামের ইংল্যান্ড প্রবাসী শাহাব উদ্দীনের সঙ্গে। এসএসসি পাস করে এইচএসসিতে থাকা অবস্থায় তার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের কারণে আর এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারেননি এ নারী।

হাছনা হেনা জানান, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির নির্মম নির্যাতন মুখ বুজে সয়ে যান। এক পর্যায়ে নির্যাতনের মাত্রা বাড়ে। শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ মিলে মেরে রক্তাক্ত করে ফেলে দেয় বাড়ির পাশে বৃহৎ হাকালুকি হাওরে। অচেতন অবস্থায় রক্তাক্ত ও ক্ষত শরীরে এক জেলে হাওরের জলে তাকে দেখতে পান। প্রথমে মৃত ভাবলেও ওই জেলে দেখেন দেহে প্রাণ আছে। তিনি নিয়ে যান হাওরতীরের একটি বাড়িতে। সেখান থেকে হেনার ভাই এসে নিয়ে যান বাবার বাড়ি। আর কোনোদিন স্বামীর বাড়ি না ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে মামলা করেন স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির সবার বিরুদ্ধে, সেই মামলা এখনো চলমান।

তিনি জানান, এরপর শুরু হয় বেঁচে থাকা, ঘুরে দাঁড়ানোর যুদ্ধ। এসএসসি পাশ করা হাসনা হেনা প্রস্তুতি নেন এইচএসসি পরীক্ষার। টাকার অভাবে মায়ের শাড়ি বিক্রি করে পরীক্ষার খরচ যোগান। এইচএসসি শেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক শেষে পরে এমসি কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করেন ২০১৮ সালে।

হাসনা হেনা জানান, এইচএসসির দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত অবস্থায় এক প্রতারক ঘটকের প্রলোভনে পড়ে লন্ডন প্রবাসী পাত্রের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। লন্ডনে নেয়ার কাগজপত্র প্রসেস করার জন্য তার স্বামী চার লাখ টাকা বাড়ি থেকে আনার প্রস্তাব দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তার ভাইয়েরা জমি বিক্রি করে সাড়ে তিন লাখ টাকা তার স্বামী ও শ্বশুরের হাতে তুলে দেন। এর কিছুদিন পর জানতে পারেন, তার স্বামী প্রথম স্ত্রীকে লন্ডনে রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তার ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় তার লেখাপড়া। নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় স্বামী ও শাশুড়ি মিলে তার মাথার চুল কেটে দেন। এ অবস্থায় তাকে দুইদিন বাথরুমে আটকে রাখা হয়।

তিনি জানান, বিয়ের দুই মাস পর ইংল্যান্ডে স্বামী চলে যান। সেইসঙ্গে পাল্টে যায় সুখের স্বপ্নে ভাসতে থাকা জীবনও। বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে বিভিন্ন মালামাল দিলেও নতুন করে চাপ আসতে থাকে শ্বশুর বাড়ির কাছ থেকে। কিছু দিনের মধ্যে এই চাপ রূপ নেয় শারীরিক নির্যাতনে। যৌতুকের আশায় তাকে প্রায়ই মারধর করা হতো।

হেনা জানান, বিয়েতে যৌতুক হিসেবে দেয়া কাঠের ফার্নিচারগুলোও বিক্রি করে দেন শ্বশুর। তিনি এর প্রতিবাদ করেন। এতেই তার ওপর শুরু হয় লোমহর্ষক নির্যাতন। এক সময় তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। অজ্ঞান অবস্থায় তাকে ফেলে দেয়া হয় বাড়ির পিছনের হাওরে।

তিনি বলেন, পাঁচ ভাইবোনের ছোট এবং আদরের ছিলাম। ২০০৪ সালে বাবা ও ২০১১ সালে মাকে হারাই। এদিকে বিয়ের পর থেকে জীবনে নেমে এল বিপর্যয়। অনেকে সালিসির নামে করেছে প্রতারণা। আত্মসাৎ করেছে টাকা। কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও কাজ করেছি। সেখানেও দুর্নীতি। অনেক টাকা লোকসান ও ভর্তুকি দিতে হয়েছে আমাকে। আমি শিক্ষকতা পেশা পছন্দ করি। বর্তমানে টিউশনি করে জীবন কাটছে। ভালো চাকরি করলে ঘুরে দাঁড়াতে পারব।

রাজনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রিয়াঙ্কা পাল বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে হাসনা হেনাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।

জাগরণ/আরকে