মো.আকতার হোসেন, মানিকছড়ি
মানিকছড়ির ছয়টি গুচ্ছগ্রামে দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে মানবেতর জীবন-যাপনকারী দেড় সহস্রাধিক বাঙ্গালী পরিবার এখন নিজ ভূমিতে ফিরে যেতে অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছেন। দীর্ঘ সময় তাদের পরিত্যক্ত ভূমি বেদখল হতে শুরু করায় ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকিত হয়ে পড়েছে গুচ্ছগ্রামবাসী।
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, মানিকছড়ি উপজেলার ছয়টি গুচ্ছগ্রামে ১৬৬৪ কার্ডধারী পরিবার দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে বসবাস করছেন। ১৯৮৮ সালে পার্বত্যাঞ্চলের বিরজমান পরিস্থিতির কারনে এখানকার বাঙ্গালীদেরকে তিন পার্বত্য জেলা নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় আনতে সরকার গুচ্ছগ্রাম তৈরি করেন। ফলে ওই সময় থেকে এখন পর্যন্ত মানিকছড়ির ৬ টি গুচ্ছগ্রামে ১৬৬৮ কার্ডধারী পরিবারের আট সহস্রাধিক সদস্য বন্দিশালায় মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।
সরকার কর্তৃক প্রাপ্ত ৮৪ কেজি খাদ্যশস্য দিয়ে কার্ডধারী পরিবারগুলো ছেলে-মেয়েদের নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। দীর্ঘ এ সময়ে পরিবারে জন্ম নেওয়া প্রজন্মরা বেড়ে উঠছে অনাদর-অবহেলা ও অযত্মে। মৌলিক অধিকার থেকে ওরা পদে পদে বঞ্চিত, নিপীড়িত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সুবিধাবঞ্চিত এবং পুষ্টিহীনতায় বেড়ে উঠছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মরা। এ যেন তাদের জীবনে অভিশাপ। ফলে নতুন প্রজন্মসহ অনাগত সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকায় পড়েছে এখানকার বাঙ্গালীরা।
গত ৩৩ বছরে প্রতিটি গুচ্ছগ্রামে বেড়ে উঠা প্রজন্মরা তাদের পিতৃ সম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিতের আশংকাও করেছেন কেউ কেউ। গচ্ছাবিল গুচ্ছগ্রামের উদীয়মান যুবক মো.শাহিনুর আলম (২৯) জানান, আমার পিতাসহ এখানকার শত শত পরিবার ১৯৮৩ সালে তৎকালীন সরকারের সিদ্ধান্তনুযায়ী এখানে এসে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ভূমিতে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু ১৯৮৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বিরাজমান পরিস্থিতির কারনে ওইসব ভূমিতে সৃজিত ঘর-বাড়ি,বাগান-বাগিচা ফেলে সকলে গুচ্ছগ্রামে বন্ধীজীবন শুরু করে। মা-বাবার বন্ধী জীবনে আমার জন্ম হয়। গুচ্ছগ্রামে থাকার কারনে মা-বাবা ফেলে আসা ভূমিতে এখনো পর্যন্ত আমরা ফিরে যেতে পারিনি। জানি না পিতা-মাতা জীবিত থাকাকালে সেখানে যেতে পারব কি না? আর এ অবস্থায় (বন্দীশালায়) পিতা-মাতার মৃত্যু হলে আমার কিংবা সমবয়সী প্রজন্মদের কি হবে আমরা তা জানি না। আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ ভাবছে কি? এ ধরণের ক্ষোভ ও অভিমান শুধু শাহিনুরের নয়। প্রতিটি গুচ্ছগ্রামবাসীর মাঝে এখন অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকা বাড়ছে।
উপজেলার সদর গুচ্ছগ্রামে ২৭৪, তিনটহরী ৪৩৪, গচ্ছাবিল ৩২৫, হাতিমুরা ১৪৯, বাটনাতলী ৩৩৬ এবং ডাইনছড়ি গুচ্ছগ্রামে ১১৯ পরিবার রয়েছে। আর এসব পরিবারে জনসংখ্যা এখন প্রায় ৯ সহস্রাধিক। প্রতি মাসে সরকার কার্ড প্রতি ৩৫.৯৫ কেজি চাউল ও ৪৯.১০ কেজি গম বিতরণ করেই দায়িত্ব শেষ করেছেন। ওদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আদৌ কেউ ভাবছে কি না এ প্রশ্নের উত্তর মেলেনি গুচ্ছগ্রামবাসীর কাছে।
সময়ের বিবর্তনে সকল ক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধিত হলেও গুচ্চগ্রামবাসীর পরিবর্তন চোখ পড়েনি। মানিকছড়ি গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা আবদুল মালেক জানান, ১৯৮১ সালে তৎকালীন সরকার আমাকে উপজেলা মলঙ্গী পাড়ায় ৫ একর রেকর্ডিয় ভূমি প্রদান করেন। উক্ত ভূমিতে ৭ বছর বসবাস করার পর ১৯৮৮ সালে বিরাজমান পরিস্থিতি জন্য আমাকে মানিকছড়ি গুচ্ছগ্রাম নিয়ে আসে। দীর্ঘ ৩০ বছর গুচ্ছগ্রাম নামে বন্দিশালায় বসবাস করলেও আজো নিজের ভিটায় ফিরতে পারিনি। ফলে পরিত্যক্ত ভূমি দখল করে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ একটি গোষ্ঠী। দখল শর্তের অজুহাতে অন্যরা আমাদের ভূমি আবাদ করে খাচ্ছে। জানিনা এ বন্দিদশা থেকে আমাদের কবে মুক্তি মিলবে?
তিনটহরী গুচ্ছগ্রাম প্রধান মোহাম্মদ উল্যাহ পাটোয়ারী জানান, নানা প্রতিকুলতার মাঝে গুচ্ছগ্রামে বসবাস করছি। সরকার মাসিক রেশন প্রদানের মাধ্যমে আমাদের বাঁচিয়ে রাখলেও নিজের বসত ভিটায় ফিরে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা করছেন না। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক বলেন, পার্বত্যাঞ্চলের বিরাজমান পরিস্থিতির কারনে উপজেলার তৃণমূলে বসবাসরত বাঙ্গালীদের সরকার গুচ্ছগ্রামে এনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল। এতে তাদের সহায় সম্পদ পরিত্যক্ত থেকে যায়। সম্প্রতি ওইসব পরিত্যক্ত টিলা ভূমি জবর দখলের অভিযোগ উঠছে।
জাগরণ/আরকে