রেলসেতুতে নারীর বিবস্ত্র লাশ: যা ঘটেছিল সেদিন

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি প্রকাশিত: এপ্রিল ২১, ২০২২, ০৪:৫৯ পিএম রেলসেতুতে নারীর বিবস্ত্র লাশ: যা ঘটেছিল সেদিন

চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে রেলসেতু থেকে নারীর বিবস্ত্র লাশ উদ্ধারের ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। লাশ উদ্ধারের পরদিন বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে। রেলসেতুতে ঝুলন্ত অবস্থায় ঐ নারীর ছবি শেয়ার করে অনেকেই দাবি করেন, তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হয় সেতুতে। তবে এখন পর্যন্ত হত্যা ও ধর্ষণের পক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ পায়নি পুলিশ।

মীরসরাইয়ের হিঙ্গুলি ইউনিয়নের আজম নগর এলাকার চট্টগ্রামমুখী রেলসেতু থেকে পুলিশ ঐ নারীর লাশ উদ্ধার করে গত শুক্রবার সন্ধ্যায়। ঐদিন ঠিক কী ঘটেছিল?

মূলত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে ফেনী নদীর ওপর নির্মিত ধুমঘাট রেলসেতু। মহাসড়কের ওপর নির্মিত সেতু থেকে ধুমঘাট রেলসেতুর দূরত্ব ২০০ গজের মতো। তবে সড়কপথে দূরত্ব দ্বিগুণেরও বেশি।

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে ফেনী নদীর আগে ধুমঘাট বাজার। এ বাজার থেকে একটি কাঁচা রাস্তা পূর্ব-উত্তর দিক হয়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে বাঁক নিয়ে রেললাইনের সমান্তরালে রেলসেতুর নিচ দিয়ে ফের চলে গেছে পূর্ব-উত্তর দিকে। শুক্রবার ফেনী নদীর তীরে এ সড়কের পাশেই রেলসেতুতে ঝুলে ছিলেন ঐ নারী।

সরেজমিনে দেখা যায়, ঐএলাকায় পাশাপাশি দুটি রেলসেতু। একটি ঢাকামুখী এবং অন্যটি চট্টগ্রামমুখী। রেলসেতুর দুপাশেই বালুমহাল, নদীতে বালু উত্তোলনে কাজ করছেন বেশ কয়েকজন শ্রমিক। এর মধ্যে সেতুর উত্তর-পূর্ব পাশের বালুমহালের শ্রমিকরা ঘটনার দিন এক্সকেভেটর নষ্ট থাকায় কাজে ছিলেন না।

বিপরীত পাশে কাজ করা শ্রমিকদের কয়েকজন কাজে ছিলেন সেদিন। তাদের মধ্যে ইকবাল হোসেন নামে একজন বলেন, শুক্রবার জুমার নামাজ থেকে আসার পর একটা নারীকে সেতুতে ঝুলে থাকতে দেখেছিলাম। আমরা মনে করেছি হয়তো ট্রেনে কাটা পড়েছে। তবে তাকে কেউ চিনতে পারিনি। ঐ রাতে পুলিশ লাশটি ঘটনাস্থল থেকে নিয়ে গেছে।

সেই রেলসেতুর নিচে বালুমহালের শ্রমিকদের বিশ্রামের ছোট ছোট তিনটি খুপরি ঘর রয়েছে। সেসব ঘরের দুটি বন্ধ থাকলেও একটিতে পাওয়া যায় আবুল হোসেন ও নুরুল আলম নামে দুজন শ্রমিককে।

নুরুল আলম বলেন, ঘটনার দিন আমরা ছিলাম না, আমাদের এক্সকেভেটর নষ্ট ছিল। তবে ঘটনা শুনেছি। রেলসেতুর দুপাশে শ্রমিকরা কাজ করলেও সেতুটি নির্জন, মানুষজন কাজ ছাড়া খুব একটা আসে না। কিছু কিছু মানুষ রাস্তা দিয়ে ঘুরে না এসে রেলসেতু দিয়ে পার হয়ে যায়। সেই সংখ্যাটা অবশ্য খুব কম। সারাদিনে ১০ জন মানুষও পার হয় না।

তিনি আরো বলেন, ঐ নারীর ট্রেনে কাটা পড়ার আশঙ্কা নেই, কারণ ট্রেন যাওয়ার সময় তিনি সেতুর মূল রেললাইনের পাশের পাতে নির্বিঘ্নে দাঁড়াতে পারতেন। পাশে যথেষ্ট জায়গা আছে। হয়তো কেউ মেরে রেল থেকে ফেলে দিয়েছে।

হিঙ্গুলি ইউনিয়নের মেম্বার মো. আলতাফ হোসেন বলেন, রেললাইন পার হওয়ার সময় যদি ট্রেনে কাটা পড়ত তাহলে শরীরের বিভিন্ন অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। তবে শুক্রবার ছিল। শ্রমিকরা বলছে- জুম্মার পর থেকে দেখছে লাশটা, তাহলে জুম্মার সময় কেউ লাশ ফেলে যেতে পারে। তবে আমার মনে হয় কেউ ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েছে।

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, রেলসেতুর নিচ দিয়ে যে সড়কটা পূর্ব-উত্তর দিকে গেছে, ঐ সড়ক থেকে রেলসেতু ৭-সাড়ে ৭ ফুট উপরে। অর্থাৎ স্বাভাবিক উচ্চতার কোনো মানুষ সহজে নিচ থেকে কাউকে সেতুর পাতে রাখতে পারবে না। তবে সেতুর যে পাতে ঐ নারীর লাশ ঝুলে ছিল, সেটা রেললাইনের বাইরে। ট্রেন থেকে কেউ পড়ে গেলে বা ট্রেনে ধাক্কা খেলে ঐ পাতে পড়তে পারেন।

ঘটনাটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লেও এলাকায় খুব বেশি জানাজানি হয়নি। ঘটনাস্থলের আশপাশের একাধিক ব্যক্তি ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এমনকি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সোনা মিয়া ঘটনার দুদিন পর জানতে পারেন ঘটনাটি। ঘটনার চারদিন পেরিয়ে গেলেও ঐ নারীর স্বজনদের দেখা পায়নি পুলিশ। তবে চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার সীতাকুণ্ড ফাঁড়ির ইনচার্জ খোরশেদ আলমের সঙ্গে মোবাইলে নিহতের বড় ভাই মাইন উদ্দিনের একাধিকবার কথা হয়েছে বলে জানা গেছে।

মাইন উদ্দিনের বরাতে খোরশেদ আলম বলেন, নিহত নারীর নাম রাজিয়া খাতুন। তিনি গত ১৮-১৯ বছর পর্যন্ত মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। স্বজনরা আর্থিকভাবে অসচ্ছল হওয়ায় চিকিৎসা করাতে পারেননি। তারা এতটাই অসচ্ছল যে গাড়ি ভাড়া দিয়ে চট্টগ্রাম আসতে পারছেন না। মানসিকভাবে অসুস্থ রাজিয়া আড়াই বছর আগে স্বামীর ঘর থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। এরপর পরিবারের কেউ তার কোনো খোঁজ পায়নি।

এর আগে, রবিবার তিনি বলেছিলেন, শুক্রবার আমরা ইফতারের পর লাশটি উদ্ধার করি। লাশের শরীরে বেশ কিছু আঘাত ছিল। হাত-পা ভাঙা ও মাথায় ভারী আঘাত ছিল। এছাড়া শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ট্রেনে কাটার মতো দাগও ছিল। সাধারণত ট্রেনের ধাক্কায় মারা গেলে লাশের অবস্থা এমন হয়ে থাকে। তাই আমাদের ধারণা, তিনি ট্রেনের ধাক্কায় মারা গেছেন। এ রকম কোনো লাশ পাওয়া গেলে সবসময় সঙ্গে নারী পুলিশ সদস্যদের নিয়ে যাই। তারা পরীক্ষা করে প্রাথমিকভাবে কোনো সমস্যা পাননি। শুরুতে তার পরিচয় পাইনি। পরে পিবিআইয়ের সহযোগিতায় রবিবার বিকেলে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত হয়েছি।

পুলিশ ঐ নারীর লাশের ময়নাতদন্ত ছাড়াও ভ্যাজাইনাল সোয়াব সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠায়। আপতত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না বলেও জানান খোরশেদ আলম। নিহত রাজিয়ার পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

ইউএম