‘নামেই আধুনিক’ হবিগঞ্জ সদর হাসপাতাল !

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১৯, ১০:০২ এএম ‘নামেই আধুনিক’ হবিগঞ্জ সদর হাসপাতাল !
হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতাল -ফাইল ছবি

 

‘নামেই আধুনিক’ হবিগঞ্জ জেলার ২০ লক্ষাধিক মানুষের প্রধান সরকারি চিকিৎসালয় হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতাল। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, রোগীর শয্যা, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও প্রয়োজনীয় উপকরণ সংকটের বিষয়টি এখন চরম আকার ধারণ করেছে। এছাড়া হাসপাতালে অবিবেচক মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ, মাদকসেবী ও দালালদের দৌড়াত্ব লাগামহীন হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

ইটের তৈরী কৃত্রিম পায়ে দাঁড় করানো হয়েছে অকেজো বেড -ফাইল ছবি 

জানা যায়, জোড়া তালি দিয়েই চলছে ‘আধুনিক’ হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম! সরেজমিনে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন রোগী শুয়ে আছেন ভাঙ্গা বেডে। হাসপাতালের কিছু বেড এতোটাই অকেজো যে ইটের তৈরী কৃত্রিম পায়ে দাঁড় করানো হয়েছে। মহিলা মেডিসিন ও সার্জারি ওয়ার্ডে বাঁশের টুকরো দিয়ে তৈরি করা হয়েছে স্যালাইনস্ট্যান্ড। পুরো হাসপাতাল জুড়েই বিরাজ করছে বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট। অজ্ঞাত কারণে হাসপাতালের অভ্যন্তরে স্থাপিত একমাত্র নলকূপটিও তুলে নেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় অনিরাপদ পানিই পান করতে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনদের। সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য স্থাপিত পানির ফোয়ারাটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ পড়ে রয়েছে। বিভিন্ন ওয়ার্ডের টয়লেটের দরজাগুলো পুরনো হয়ে জরাজীর্ণ অবস্থা। এতে মহিলা রোগীদের বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। শয্যা সংকট থাকায় বহু রোগীকে দিনের পর দিন থাকতে হচ্ছে মেঝেতে। হাসপাতালের ড্রেনগুলো দীর্ঘদিন ধরে ময়লা-আবর্জনার স্তূপে ভর্তি হয়ে পড়ে আছে। যে কারণে হাসপাতালে দুর্গন্ধ এখন নিত্যদিনের সঙ্গী। একটি দালাল চক্রের সিন্ডিকেটের কারণে হাসপাতালে প্রায়ই রক্ত সংকট দেখা যায় বলে অভিযোগ রোগীদের। এতে প্রতারণা, হয়রানীসহ নানা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন রোগীরা। চিরাচরিত নিয়মে ঔষধের সংকট তো লেগেই আছে। 

মহিলা মেডিসিন ও সার্জারি ওয়ার্ডে বাঁশের টুকরো দিয়ে তৈরি করা হয়েছে স্যালাইনস্ট্যান্ড -ফাইল ছবি

হাসপাতাল সূত্র জানায়, নামে ২৫০ শয্যার হলেও বাস্তবে এ সংখ্যা মাত্র ২শ এর কিছু বেশি। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, প্যাথলজিস্ট ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংকটও প্রকট। বিশেষ করে এখানে দীর্ঘদিন ধরে মেডিসিন, কার্ডিওলজিস্ট ও গাইনি বিভাগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পদ শূন্য রয়েছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী এবং নার্সদের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ট রোগী ও স্বজনরা। যে কারণে প্রায়ই ঘটে বাকবিতণ্ডা ও হাতা হাতির ঘটনা। শুধু তাই নয়, হাসপাতাল থেকে সরবরাহকৃত খাবার খুবই নিন্মমানের বলে অভিযোগ করেছেন বহু রোগী। 

তারা জানান, অনেক সময় ডাক্তারের দেয়া ‘পথ্য’ অনুযায়ী খাবার সরবরাহ না করায় তাদের বিপাকে পড়তে হয়। দৈনিক হাজিরায় ভাড়াটে বহিরাগতদের দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করানো হয় বলে অনেক কর্মকর্তা কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতালের কতিপয় কর্মচারীরা মাঝে মাঝেই বিনা ছুটিতে অনুপস্থিত থাকছেন। এ ক্ষেত্রে তারা চিহ্নিত কিছু বহিরাগত ভাড়াটে ব্যক্তিদের দৈনিক হাজিরায় কাজ করিয়ে থাকেন। এমন স্পর্শকাতর ও ভয়াবহ কাজটিতে নাকি মৌন সম্মতি রয়েছে পদস্থ কর্মকর্তাদের।

স্থানীয়দের অভিযোগ, হাসপাতালে মাদকসেবী ব্যবসায়ী, দালাল ও অবিবেচক মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের উৎপাতের বিষয়টি এখন চরম আকার ধারন করেছে। সন্ধার পরপরই হাসপাতাল প্রাঙ্গণে বসে মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের মিলন মেলা। অনেক সময়ই এদের উৎপাতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় রোগী ও স্বজনদের। যে কারণে মাঝে মাঝে ঘটে ছিনতাইয়ের ঘটনা। শুধু তাই নয়, দালালদের দৌড়াত্ব যেন দিনদিন বেড়েই চলেছে। রোগীকে প্রাইভেট হাসপাতালে ভাগিয়ে নিতে টানা হেঁচড়ার ঘটনা যেন নিত্যদিনের চিত্র। এ কাজে দালালদের সহযোগিতা করে থাকেন খোদ কর্মকর্তা কর্মচারীরাই। এ ছাড়া  বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানির অবিবেচক মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিদের উৎপাতে চিকিৎসকরাই এখন বিব্রত। কাক ডাকা ভোর থেকেই হাসপাতাল প্রাঙ্গণে শুরু হয় তাদের উপচে পরা ভিড়। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে রোগীদের সাথে তাদের অশ্লীল কাড়া কাড়ির দৃশ্যটি নূন্যতম শিষ্টাচারকেও হার মানায়। 

সুত্র জানায়, হাসপাতালটিতে অনেকাংশেই ভেঙ্গে পড়েছে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা বা ‘চেইন অব কমান্ড’। দায়িত্ব পালনে ‘টপ টু বটম’ কেউই শুনছেন না কারো কথা। কোন্দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন কর্মকর্তা কর্মচারীরা। যে কারণে সেবা ও প্রশাসনিক কাজে সৃষ্টি হয়েছে মন্থরগতি, চরম হযবরল অবস্থা। ফলে কাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, হাসপাতালটিতে দীর্ঘদিন ধরে চলছে অবৈধ সার্টিফিকেট বাণিজ্য। জরুরি বিভাগের কর্মরত কয়েকজন কর্মচারী ও প্রশাসনিক শাখার জনৈক কর্মচারীর সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ সার্টিফিকেট বাণিজ্যের ‘প্রভাবশালী সিন্ডিকেট’। ভুয়া সার্টিফিকেট (এম.সি) সরবরাহ করে এরা হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ-লাখ টাকা। এ নিয়ে ইতোপূর্বে স্থানীয় পত্রিকায় একাধিক সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’ হলেও রহস্যজনক কারণে নীরব ভূমিকা পালন করছেন কর্তাবাবুরা। এতে করে একদিকে যেমন আইনি মোকাবেলায় হয়রানী ও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন নিরপরাধ মানুষ। অপরদিকে, সুবিধা নিচ্ছে অপরাধীরা।

এ বিষয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. রতিন্দ্র চন্দ্র দেবের সাথে যোগাযোগ করা হলে, তিনি ডাক্তার ও শয্যা সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘চলতি সালের জানুয়ারি থেকে ২৫০ শয্যার কার্যক্রম শুরু হলেও বাস্তবে তা নেই। দিনে দিনে বেড়েই চলেছে ডাক্তার সংকট। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বার বার লিখিত ভাবে জানানো হলেও এর সুরাহা হচ্ছে না। উপজেলা থেকে ডাক্তার এনে সংকট দূরীকরণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
 
মাদকসেবী ও দালালদের উৎপাতের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দালালদের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়েছে। প্রয়োজনে আবারও হবে। আমরা  নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আর মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের বিষয়ে তাদের সংগঠন ফারিয়া (ফার্মাসিউটিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ এসোসিয়েশন) কে লিখিত ভাবে জানানো হয়েছে। আশাকরি অচিরেই এর সমাধান হবে’।    

এএস/