হেফাজতের ভেতর ‘মানহাজি’ নামে সক্রিয় জঙ্গিরা

সুব্রত চন্দ প্রকাশিত: মে ১৬, ২০২১, ১১:৪২ পিএম হেফাজতের ভেতর ‘মানহাজি’ নামে সক্রিয় জঙ্গিরা

হেফাজতে ইসলামের অন্তরালে ‘মানহাজি’ নামে দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাত-উল-জিহাদ (হুজি)। পাশাপাশি আরেকটি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার-আল-ইসলামের সঙ্গেও যোগাযোগ আছে কাওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এই সংগঠনটির।

সম্প্রতি এই জঙ্গি সংগঠন দুটির সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের যোগাযোগের প্রমাণ পেয়েছে পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। এমনকি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে আসা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরকে ঘিরে দেশে যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, এতেও ‘মানহাজি’র উগ্রবাদীরাই ইন্ধন জুগিয়েছে বলে জানিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা।

গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, হরকাত-উল-জিহাদ ও আনসার আল ইসলামের মতো নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে হেফাজতে ইসলামের অন্তরালে সংগঠিত হচ্ছে। এর মধ্যে আফগান ফেরত যোদ্ধাও রয়েছে। মূলত সরকার পতন এবং বাংলাদেশকে পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো রাষ্ট্রে পরিণত করার উদ্দেশ্যে তারা বিভিন্ন তাণ্ডব চালিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতো।

‘মানহাজি’ কী?
জিহাদের ডাক দিয়ে যারা তথাকথিত ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠা করতে চায় যারা, তাদের বলা হয় ‘মানহাজি’। এই নামেই হেফাজতে ইসলামের অভ্যন্তরে রয়েছে একটি উপদল। যারা কাজ করতো হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী।

‘মানহাজি’ নামের এই উগ্রবাদী দলটির কাজ ছিল হেফাজতের যেকোনো কর্মসূচিকে আগ্রাসী করে তোলা। বিভিন্ন সময় দেশের মধ্যে নাশকতা, তাণ্ডব ও নৈরাজ্য সৃষ্টির পরিকল্পনা ছিল তাদের।

হেফাজতে ইসলামের মধ্যে এই দলটির নেতৃত্ব দেন হারুন ইজহার। তিনি হেফাজতের বিলুপ্ত কমিটির শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক। এছাড়া মানহাজি দলের অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন— হেফাজতে ইসলামের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব হাবিবুল্লাহ মিয়াজী, সহকারী মহাসচিব হাসান জামিল, প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমান ফয়েজী, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদরিস, সহকারী দাওয়াহ-বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাকুন্নবী কাসেমী, মারকাজুল হুদা আল ইসলামীর মহাপরিচালক আজহারুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর হেফাজতের সদস্য মুজিবুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন। এদের কয়েকজনই আবার আফগানিস্তান ফেরত যোদ্ধা।

কে এই হারুন ইজহার?
হারুন ইজহার হলেন বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরীর বড় ছেলে। গত ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম নগরীর লালখান বাজার জামিয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আগমণকে কেন্দ্র করে গত ২৬ ও ২৭ মার্চ দেশে যে তাণ্ডব চালানো হয়েছিল সেই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এর আগে ২০১৩ সালের ১০ জুলাই জামিয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসায় গ্রেনেড বিস্ফোরণে তিনজন নিহত হলে তাকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তখন হারুন ইজহার পরিচালিত মাদ্রাসা থেকে বিপুল পরিমাণ গ্রেনেড তৈরি সরঞ্জাম ও কয়েকটি তাজা গ্রেনেডও জব্দ করা হয়। কয়েক বছর কারাগার থাকার পর ছাড়া পান হারুন ইজহার।

২০০৯ সালেও একবার গ্রেপ্তার হন হারুন। ওই সময় মার্কিন দূতাবাস ও ভারতীয় হাইকমিশনে হামলার অভিযোগে লস্কর-ই-তৈয়বার কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে তাকেও আটক করে পুলিশ।

হারুন ইজহারের বাবা হেফাজত নেতা ইজহারুল ইসলাম জিহাদে অংশ নেওয়ার জন্য ১৯৮০ সালে আফগানিস্তানে যান। পরে দেশে ফিরে এসে তিনি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হুজির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। এই জন্য তাকে ২০১০ সালে আটক করে র‌্যাব।

হারুন ইজহার হুজি ও আফগান ফেরত যোদ্ধাদের হেফাজতের সঙ্গে যুক্ত করার কাজ করতেন বলে জানিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা।

আনসার-আল-ইসলামের সঙ্গে হেফাজতের সংশ্লিষ্টতা
সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার-আল-ইসলামের আধ্যাতিক গুরু আলী হাসান ওসামা। তাকে গ্রেপ্তারের পর হেফাজতের সঙ্গে আনসার-আল-ইসলামের যোগাযোগের বিষয়টি বেরিয়ে আসে। তবে এই বিষয়ে এখনো তদন্ত করছে পুলিশের কাউন্টার টেরিরিজ ইউনিট।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বক্তব্য
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক মো. আনোয়ার হোসেন একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে জানান, হারুন ইজহার এবং জাকারিয়া নোমান ফয়েজী দুজনেরেই মোদী বিরোধী সহিংসতার ঘটনায় করা দুটি মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এছাড়া এসব তাণ্ডবে যাদের ইন্ধন ছিল তাদের নাম প্রকাশ করেছে।

হেফজত ইসলাম ও আনসার-আল-ইসলামের সম্পর্কের বিষয়ে খুটিনাটি তদন্ত করা হচ্ছে বলে ওই বেসরকারি টেলিভিশনকে জানান কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান। তিনি জানান, সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতের ধ্বংসাত্মক ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে আনসার-আল-ইসলাম। পাশাপাশি নিজেদের সমর্থকদেরও হেফাজতের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে। এর থেকে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম একটি পরোক্ষ যোগসূত্র পায়।

এছাড়া সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া হেফাজতের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মামুনুল হকের সঙ্গে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার বিষয়েও খাতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম আরেকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে জানান, হেফাজতের সঙ্গে বেশকিছু জঙ্গিগোষ্ঠী ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। এই জঙ্গি সংগঠনগুলো চায় সরকার পতনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে। তাহলে তারা বাংলাদেশকে পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়।

হেফাজতে ইসলামির নেতাদের বক্তব্য
হেফাজতে ইসলামের বিলুপ্ত কমিটির নায়েবে আমির আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী জানান, সংগঠনের মধ্যে যাদের নামে অভিযোগ রয়েছে বা যাদের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তাদের বাদ দেওয়া হবে। এজন্য কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। তারা একটি বিতর্কমুক্ত কমিটি গঠন করতে চান।

এদিকে জঙ্গি সংগঠনগুলো যাতে অন্য কোনো দলের ছায়ায় নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে না পারে এই জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।