একটা সময় ছিল কারোর মুখ না দেখলে পেটের ভাত হজম হতো না কিংবা দূরন্ত-দুপুরে উচ্চ কলরবে হই-হুল্লোড় করে প্রতিবেশীর ‘ভাতঘুম’ হারাম কিংবা চুরি করে এক-দুইটা সিঙ্গাড়া বেশি খাওয়া আরও কত কী কাণ্ড।
নিত্য ঘটনা ছিল হেঁটে স্কুলে যাওয়া-ফেরা আর গপসপ করা। সেগুলো এখন সোনালী অতীত।
গেলো ২৬ বছরে তুরাগ নদের পানি অনেক গড়িয়েছে।পাল্টে গেছে সময়-কাল-প্রেক্ষাপট। বন্ধুত্বেরও ছেদ পড়েছে। কিন্তু উজ্জ্বল রয়ে গেছে ‘স্কুল-স্মৃতি’।
প্রিয় শিক্ষকের শাসন-বারণ-বেত্রাঘাত-বকুনি এখনও মধুর স্মৃতি হয়ে তাড়িয়ে বেড়ায়।
অনেকদিন পর আবার বন্ধুর সঙ্গে দেখা এবং ফেলে আসা স্মৃতিগুলো হুড়মুড় করে সব সামনে চলে আসা; বন্ধুত্বের এমন শাশ্বত কাহিনি রয়েছে উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী কবীর সুমনের একটি গানে।
কাজের চাপে অনেক কিছু ছেড়ে আসা, ভুলতে বসা মধ্য বয়সীদের কাছে ‘বন্ধু, কি খবর বল—’ গানটি হাজির হয় ফেলে আসা বন্ধ সময়ের গিট খুলে।
গানটির প্রথম কয়েকটি লাইন এমন— ‘হঠাৎ রাস্তায় আপিস অঞ্চলে/ হারিয়ে যাওয়া মুখ চমকে দিয়ে বলে/ বন্ধু, কী খবর বল?— কত দিন দেখা হয়নি’ গানটির গীতিকার, সুরকার ও গায়ক কবীর সুমন যথার্থই বলেছেন।
এনএইচএম৯৭ বন্ধুদের বেলায় গানটি বেশ মিল রয়েছে।
‘স্কুল বা আপিস অঞ্চলে’ নয়; বসন্তের শেষ শনিবার দুপুর বেলায় ঢাকার অদূরে তুরাগ নদের তীরে বোটক্লাবে অন্যরকম মিলনমেলায় এসে পুরোনো বন্ধুকে খুঁজে পেলেন শহিদুল ইসলাম মাসুদ, আসাদুজ্জামান আপেল, নীলুফার ইয়াসমিন পলি, মমতাজ সুলতানা, ফাতেমা খাতুন সোমা, কবির হোসেন, শারমিন আক্তার ছন্দা, আলেয়া বিলকিস, নাদিয়া সুলতানা সোমা, শাহনাজ বেগম, মৌসুমী, শওকত হোসেন, তাহমিনা নাসরিন নীলা, জোবায়ের হিরণ, বাবুরা।
যারা কিনা উত্তরা মডেল টাউনস্থ আজমপুরে অবস্থিত নওয়াব হাবিবুল্লাহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় (বর্তমানে নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল হাই স্কুল)-এর ৯৭ এসএসসি ব্যাচের কৃতী শিক্ষার্থী।
মিলনমেলায় এসে কেউ ১০ বছর কেউ ১৫ বছর আবার কেউ ২৬ বছর পর একে অন্যকে আবিষ্কার করল ভিন্ন চেহারায় ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ভিন্ন আবেগে। স্কুল বেলার বন্ধুকে কাছে পেয়ে অনেকেই হয়ে পড়ে আবেগে আপ্লুত। কেউ কেউ চোখের পানিটুকু ধরে রাখতে পারেনি।
হালের সেলফোন ও ফেসবুকের কল্যাণে প্রায় দুই বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসেবে জড়ো করা হয় এনএইচএম৯৭-এর বন্ধুদের। শুধু তাই নয়, এনএইচএম৯৭-এর বন্ধুদের বর্তমান সাফল্যের পেছনে পিতা-মাতার পর যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি তারা হলেন স্কুল বেলার প্রিয় শিক্ষকরা।
নওয়াব হাবিবুল্লাহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রথমবারের এই ধরনের মিলনমেলায় ওই সব শিক্ষকরা থাকবেন না তা কি হয়।
আমন্ত্রণ জানালে মিলনমেলায় অংশ নেন প্রিয় শিক্ষক আজিজুল হক, রফিকুল ইসলাম, আইয়ুব আলী, আফজাল হোসেন, মাহমুদা আক্তার ও সুরাইয়া আক্তার পারভীন।
অসুস্থতার জন্য আসতে পারেন নি ক্লাসশিক্ষক সুলতান আহমেদ ও আবদুল খালেক। নানা কারণে যেসব স্যারের সাথে যোগাযোগ করা যায়নি তাদেরও কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করা হয়।
প্রয়াত প্রধান শিক্ষক এ বি এম নূর আলী, এম এ বাতেন, এম এ ওয়াজেদ, আ স ম সোহরাব, খোদেজা সিদ্দিকীর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
মিলনমেলার আয়োজনে অগ্রভূমিকা পালন করেছে আদনান মোহাম্মদ ইকবাল, সাইফুল ইসলাম সুমন, ডি এম কামাল আহমেদ, আবুল বাশার, শেখ মনিরুজ্জামান শাওন, শহিদুল ইসলাম সজল ও কামরুল ইসলাম।
কয়েক পর্বে বিভক্ত মিলনমেলার শুরুতেই ছিল প্রিয় শিক্ষকদের সংবর্ধনা ও ফের আর্শীবাদ নেয়া।
এ সময় অনুভূতি প্রকাশ করেন প্রিয় শিক্ষকরা। প্রিয় শিক্ষক আজিজুল হক বলেন, ‘শিক্ষকতা জীবনে এ ধরনের আয়োজনে যোগ দিতে পেরে আমি আপ্লুত।’ এ সময় তিনি সবার কাছে দোয়া চান।
অন্যান্য শিক্ষকরাও ফেলে আসা দিনগুলোর নানা তথ্য তুলে ধরে করেন স্মৃতিচারণ। বললেন, ‘মন থেকে কাউকে বেত্রাঘাত করা হয় না। এটা যারা আর্শীবাদ হিসেবে নেয় তারাই সফল। আর যারা শাসন-বকুনি থেকে বঞ্চিত তাদের মতো হতভাগ্য কেউ নেই। এনএইচএম৯৭ শিক্ষার্থীরা আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত।এটাই পরম পাওয়া।
মিলনমেলার দ্বিতীয় পর্ব ছিল মধাহ্নআহার।
বহুদিন পর খুঁজে পাওয়া বন্ধুদের সাথে হই-হুল্লোড় করে আহার পর্বে অংশ নেয় তাদের পরিবারে সদস্যরাও। বলতে গেলে একটুকরো ‘এনএইচএম৯৭’ এ পরিণত হয় বোটক্লাবের হলরুমটি। আহারপর্বে খুঁনসুটি ্আর এর ওর পাত থেকে খাবার কেড়ে নিয়ে খাওয়া ছিল অন্যরকম ব্যঞ্জণা।
মিলনমেলায় আকর্ষণীয় পর্ব ছিল স্কুল বন্ধুদের পরিবারের সঙ্গে পরিচয় ও ফটোসেশন। ফটোজেনিক পরিবার হিসেবে সবার নজর কেড়েছে শহিদুল ইসলাম মাসুদ, শেখ মুনিরুজ্জামান শাওন, আদনান মোহাম্মদ ইকবাল, শহিদুল ইসলাম সজল, সাইফুল ইসলাম, এসএমএম আবদুল্লাহ আল জোবায়ের হিরণ, ডি এম কামাল আহমেদ, আবুল বাশার দম্পতি।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে ৪ নয় ৬ নয় একেবারে শতক হাঁকিয়ে সবার আগে এগিয়ে গেছে সেদিনকার ছটফটে বালিকা শারমিন আক্তার ছন্দা। তার চিলচিৎকার ছিল উপভোগ্য ও ছেলেমানুষী ভরা।
গল্পে গল্পে জানা গেলো শতক হাঁকানোর পথে রয়েছে আরও কয়েকজন মেয়ে বন্ধু।
এখনও স্কুলে ব্যাগ নিয়ে আসা-যাওয়া বন্ধ হয়নি নীলুফার ইয়াসমিন পলির। এনএইচএম৯৭-এর বেশ কয়েকজন রয়েছেন যারা এখন নিয়োজিত মানুষ গড়ার কাজে। এর মধ্যে রয়েছেন তাহমিনা নাসরিন নীলা, আলেয়া বিলকিস, মমতাজ সুলতানা, শাহিদা আক্তার ময়না, ফাতেমা খাতুন সোমা।
মিলনমেলায় অংশ নিতে পারে নি সাজ্জাদ খোশনবীশ সম্রাট, জিবরান খান, রাইয়ান খান। সস্ত্রীক অস্ট্রেলিয়া অবস্থান করছে সম্রাট। শিগগিরই মা-বাবা হতে চলেছেন সম্রাট-সারাহ দম্পতি। জিবরান খান, রাইয়ান খান অবস্থান করছে যুক্তরাষ্ট্রে।
শিক্ষয়ত্রী স্ত্রী ও দুই সন্তান ঢাকায় ফেলে রেখে পেটের তাগিদে বিপদশঙ্কুল আফগানিস্তানে অবস্থান করছেন শাখাওয়াত হোসেন। তবে হোয়াটসঅ্যাপে মাধ্যমে মিলনমেলায় সরাসরি যুক্ত হয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছে সে।
আসব আসব করে শেষ মুহূর্তে ছুটি না পাওয়ায় অংশ নিতে পারেনি জাকির হোসেন হাওলাদার। বেশ আমোদ ছিল এনএইচএম৯৭ সবচেয়ে আলাভোলা মোটাসোটা আসাদুজ্জামান আপেল। মিলনমেলা তাকে সঙ্গ দিয়েছে বাবু।
মিলনমেলায় ছিল শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। ছিল র্যাফেল ড্র। যেটি জিতে নিয়ে সবার হৃদয়ে রক্ত ঝরিয়েছে ডি এম কামাল আহমেদ।
মিলনমেলার সমাপ্তিটা ছিল বোটক্লাবের সদর দরজায় গ্রপ ফটোসেশনের মধ্য দিয়ে। সেখানে অংশ নেন সংবর্ধিত স্কুল শিক্ষকরাও।
সূর্য যখন পশ্চিমে অস্ত যাচ্ছে তখন সমাপ্তি ঘটে নওয়াব হাবিবুল্লাহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ইতিহাসের অবিস্মরণীয় এক মিলনমেলায়।
সঞ্চালকত্রয় আদনান মোহাম্মদ ইকবাল, সাইফুল ইসলাম ও শেখ মনিরুজ্জামান শাওনের কথায় এই মিলনমেলা শেষ নয় বরং শুরু। অটুট থাক এনএইচএম৯৭। জয় হোক বন্ধুত্বের। জয় হোক ভালোবাসার।