সিলেট বিভাগে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এ পরিস্থিতিতে বন্যার্তদের উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
এরই মধ্যে বন্যাকবলিত সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছে সেনাবাহিনী। দুই জেলার ৮ উপজেলায় সেনাবাহিনীর ১০ প্লাটুন এবং ৬টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।
নৌকা দিয়ে বাড়িঘর থেকে পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসছেন সেনা সদস্যরা। তবে দুর্গত মানুষের তুলনায় আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা কম।
সুরমাসহ জেলার সব নদ-নদীর পানি দ্রুত বাড়ছে। অনেক এলাকার সাথে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। পানিবন্দি হয়ে চরম দুর্ভোগে লাখ লাখ মানুষ।
রানওয়েতে পানি ওঠায়, বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ওসমানী বিমান বন্দরে ফ্লাইট ওঠানামা। ২৫ জুন পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও পরীক্ষা।
উজান থেকে আসা ঢলে সিলেট বিভাগের ৮০ শতাংশ এলাকা এখন পানির নিচে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের ৯০ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। এখন পর্যন্ত দুই জনের মৃত্যুর খবর এসেছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, শনিবার (১৮ জুন) সন্ধ্যা পর্যন্ত সুরমাসহ সেখানের সব নদ নদীর পানি সমতলে বৃদ্ধি পাবে। তাই নদী তীরবর্তী এলাকা এড়িয়ে চলা পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্য বলছে, সিলেট বিভাগের বন্যা দেশের আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে।১৯৯৮ সালের জুন মাসে সিলেট বিভাগে অনেকটা এমন বন্যা হয়েছিল।
কিন্তু এর পর বেশিরভাগ বন্যা মূলত হাওর ও সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৯ সালে সুনামগঞ্জ ও সিলেট শহরে দুই তিন দিনের জন্য হঠাৎ বন্যা হয়।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আরও জানাচ্ছেন, সোমবারের আগে এই পানি নামার সম্ভাবনা কম। কারণ, উজানে আগামী দুই দিন অতিভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে।
শুক্রবার (১৭ জুন) দুপুর থেকে সিলেট জেলার প্লাবিত এলাকায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান।
সিলেট সেনানিবাসের জিওসি মেজর জেনারেল হামিদুল হক জানান, সিলেটের ৩ উপজেলা ও সুনামগঞ্জের ৫ উপজেলায় পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার ও সহায়তা কার্যক্রম চালাবেন তারা।
সুরমা-কুশিয়ারার পানি বেড়ে সিলেট মহানগরীর পাশাপাশি জেলার ১৩টি উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে। সুনামগঞ্জের ৯৫ ভাগ এলাকা ডুবে গেছে।
সকাল থেকে সিলেটের রাস্তাঘাটে মানুষের ভিড়। প্রত্যেকের হাতেই টুকিটাকি ঘর গৃহাস্থলির জিনিসপত্র। যিনি হাতের কাছে যেটুকু পেয়েছেন সেটুকু হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন।
এদের সবাই সবাই আশ্রয়কেন্দ্র খুঁজছেন। কারণ, নিজেদের ঠিকানায় ফেরার আর কোন উপায় নেই। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে বসতভিটা ও ঘরবাড়ি।
সিলেট নগরীর তালতলা, জামতলা, সোবহানীঘাট, মেন্দিবাগ, উপশহর, কালীঘাটসহ বেশ কয়েকটি এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
এসব এলাকার রাস্তাঘাট, বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। এসব এলাকা দুই থেকে তিন ফুট পানিতে ডুবে গেছে। সময়ের সঙ্গে আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
সিলেটের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার কালীঘাটের দোকান তলিয়ে যাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবির হয়ে গেছে। অনেক এলাকায় যানবাহন চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে।
শুক্রবার সকালে সদর উপজেলার সোনাতলা এলাকায় পানির তোড়ে ভেসে মারা যান আব্দুল হাদি নামের এক এসএএসসি পরীক্ষার্থী। এছাড়া কাজীরগাঁও এলাকায় বিদ্যুতের তার বন্যার পানিতে পড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান এক প্রবীণ নারী।
বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সিলেট বিভাগের বেশিরভাগ এলাকার যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। টেলিফোন নেটওয়ার্ক অকার্যকর হয়ে গেছে।
অনেক স্থানে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র ও বৈদ্যুতিক খুঁটি তলিয়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভয়াবহ বন্যায় সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক তলিয়ে গেছে।
সারাদেশের সঙ্গে সুনামগঞ্জের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতে সিলেট ও সুনামগঞ্জের প্রায় পৌনে দুই লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎহীন রয়েছেন। দুর্ঘটনা এড়াতে লাইন বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে।
টানা বৃষ্টির কারণে আকস্মিকভাবে পানি বেড়েছে সিলেটের সবগুলো নদ নদীতে। সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার কমপক্ষে ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে।
এরই মধ্যে পানিতে সদর, কোম্পনিগঞ্জ গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট ও জৈন্তাপুরের গড়ে ৯৫ ভাগ এলাকা ডুবে গেছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে জেলা সদরের সঙ্গে।
বহু মানুষ আটকে পড়েছে এলাকায়। জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় তাদের উদ্ধারের চেষ্টা করছে প্রশাসন। তবে দুর্গতের সংখ্যার তুলনায় আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা কম থাকায় বিপদ বেড়েছে।
সিলেটের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষন কেন্দ্র জানিয়েছে, সুরমার মতোই কুশিয়ারার পানি ফেঞ্চুগঞ্জ, কাশিমপুর ও শেরপুর পয়েন্টে এবং সারি নদীর পানি সারিঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার অন্য নদ-নদীর পানিও ক্রমশ বাড়ছে।
কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও সদর উপজেলার পুরো এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি অফিসে পানি ঢুকে পড়ায় স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে।
সুনামগঞ্জে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ৬৭৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এরিমধ্যে ৬ উপজেলার শহর, গ্রাম, রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, সরকারি-বেসরকারি অবকাঠামো ডুবে গেছে।
ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সড়ক ও সেতুর। ১০৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২৫৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, শনিবার রাতের মধ্যে সুরমা নদীর পানিস্তর শুক্রবার সন্ধ্যায় যেমন ছিল তার তুলনায় ১০-৫০ সেমি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তাই সিলেট এবং আশপাশের অঞ্চলে বন্যা হওয়ার কম সম্ভাবনা রয়েছে। যেভাবেই হোক নদীর তীরবর্তী এলাকা এড়িয়ে চলতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বন্যা পূর্বাভাস সংস্থা জানাচ্ছে, শনিবার বাংলাদেশের উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হবে।
এর আগে গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে; যা ১২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টি। আর গত তিন দিনে সেখানে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এই অল্প কয়েক দিনে এত বৃষ্টির রেকর্ডও গত ১০০ বছরে নেই।
জাগরণ/বন্যাপরিস্থিতি/এসএসকে/এমএ/কেএপি