নীলক্ষেত কেবল ঢাকার একটি জায়গার নাম নয়, নীলক্ষেত শব্দটার অন্যরকম এক গভীর দ্যোতনা আছে, তাৎপর্য-মাধুর্য আছে, যা এ শহরের পডুয়ারা ঠিকই বোঝেন। নীলক্ষেত দিশি-বিদেশি পুরনো বইয়ের আড়ত, যা এক জ্ঞানপীঠের নাম। যে আড়তে ঢুঁ না-মারলে এ শহরের বইপ্রেমীর জীবনই বৃথা- এ অনিবার্য সত্যটি আজ যেন এক রকম অবধারিতভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
তবে কবে থেকে নীলক্ষেতে পুরাতন বইপত্তর বেচাকেনা শুরু তা বলতে পারি না। ১৯৮৫-৮৬ সালের দিকে ঢাকা সিটি কলেজে পড়ার সময় নীলক্ষেতে যাতায়াত শুরু করি। সেই সময় আমার ইংরেজি পেপারব্যাক পড়ার নেশা ছিল। পুরনো ইংরেজি পেপারব্যাক নীলক্ষেত ছাড়া আর কোথায় পাব। নীলক্ষেতের মোড়টি সিটি কলেজের কাছেই। তখনকার দিনে আজকের মতো এত বিচ্ছিরি জ্যাম-জট ছিল না। কলেজ থেকে নীলক্ষেতের পুরনো বইয়ের আড়তে হেঁটে যাওয়া প্রায় নেশার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
কলেজে পড়ার সময়ই মার্কিন ঔপন্যাসিক Harold Robbins -এর অনেক বই পড়ে ফেলেছিলাম। সহজ ভাষায় লিখতেন রবিন্স, উপন্যাসের প্লট আর চরিত্রগুলো ছিল আকর্ষণীয় আর নানা ঘটনায় পরিপূর্ণ। প্রথম রবিন্সের নেভার লাভ আ স্ট্রেঞ্জার পড়ে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ওটাই রবিন্সের প্রথম বই। সব বইই পড়ে ফেলব ঠিক করেছিলাম। নীলক্ষেতে রবিন্সের পুরনো বই পাওয়া যেত। প্রধানত সেই টানেই যেতাম। ১৯৮৫-৮৬ সালের দিকে ১০০ টাকায় হ্যারল্ড রবিন্সের তিনটা উপন্যাস পেতাম। নীলক্ষেত থেকে রবিন্সের প্রায় ১৫-২০টি বই কিনেছিলাম। পুরনো বইয়ের ঘ্রাণ শুঁকতে ভালো লাগত আমার। বিশেষ করে ইংরেজি পেপারব্যাকের। তবে রবিন্স ছাড়া অন্যান্য বইও যে কিনতাম না তা নয়। নীলক্ষেতের পুরনো বইয়ের দোকান থেকে অন্যসব বইও কিনতাম। জোসেফ কনরাডের ‘হার্ট অব ডার্কনেস’ বইটি আজও আমার বুকসেলফে আছে। বইটির দিকে তাকালে নীলক্ষেতের স্মৃতি ভেসে ওঠে। স্মৃতি বললাম এ জন্য যে, নীলক্ষেতে আজকাল তেমন একটা যাওয়া হয় না।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যে পরিমাণ বই পড়তাম আজকাল তেমন একটা পড়াও হয়ে ওঠে না। এর এক কারণ ইন্টারনেট। বই পড়ার চেয়ে ইন্টারনেটে ব্রাউজ করতে ভালো লাগে। তাছাড়া ইন্টারনেটে অনেক বইয়ের পিডিএফ পাওয়া যায়। এমন কী বাংলা বইয়েরও পিডিএফ ভার্সন পাওয়া যায়। যে বই ১৯৯৬ সালে নীলক্ষেত থেকে সতেরোশ’ টাকা দিয়ে কিনেছি, সেটির ফ্রি পিডিএফ ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা যায়! আশি-নব্বইয়ের দশকে নীলক্ষেতের পুরনো বইয়ের টংঘরগুলো আমাদের মতো পড়ুয়াদের জন্য ছিল এক তীর্থস্থান। সকাল-বিকেল পুরনো বইয়ের গলিতে ঘুরতে দিব্যি লাগত আমার। কেমন ঘোর লাগে যেন। আজকের দিনের মতোই তৎকালীন বেশরম সেলসম্যানরা ডাকাডাকি করত। আমার বিরক্ত লাগলেও মজাও পেতাম। টঙের সামনে দাঁড়ালে একগাদা বই ঢেলে দিত। যেন সবই কিনতে হবে। কোনো কোনো বইবিক্রেতা জাহির করত তার পাণ্ডিত্য। অনায়াসে বলে দিত কোন বই ভালো, আর কোন বই রদ্দি। অনেক গ্রন্থবিক্রেতার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল।
তারা আমার আকাক্সিক্ষত বইটি রেখে দিত। অনেকে আবার খানিকটা ব্ল্যাকমেইলও করত। কি আর করা! নজরুল তো লিখেই গেছেন …‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে…’ তবে আমি নীলক্ষেতের কাছে যে পরিমাণ ঋণী- সেই তুলনায় বইবিক্রেতাদের এসব হঠকারিতা তুচ্ছ। নীলক্ষেতে Encyclopidia of Western music সঁংরপ বইটি না পেলে প্রাশ্চাত্যে ধ্রুপদি সংগীতের ওপর জ্ঞান অসম্পূর্ণ থেকে যেত। ১৯৯৬ সালে সতেরোশ’ টাকা তো আর জলে যায়নি। অন্তত আমার জন্য নীলক্ষেতের প্রধান আকর্ষণ ছিল ‘দেশ’ পত্রিকা। দেশ পত্রিকার গল্প আর প্রবন্ধ পড়তে আমার ভালো লাগত। আজও লাগে। দেশ পত্রিকা মারফত কত না শক্তিমান কবি-লেখকের লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। মন্দক্রান্তা সেন- এর কবিতা সর্বপ্রথম মনে হয় দেশে-ই পড়ি। নীলক্ষেতের বইবিক্রেতার হাতে ১০০ টাকা ধরিয়ে দিলে অনেক দেশ পত্রিকা দিয়ে দিত। আমার তো সস্তাই মনে হতো। একশ’ টাকায় অত ‘অমূল্য’ পত্রিকা দিয়ে দিচ্ছে। মানে, ক’টা টাকার বিনিময়ে কি বিপুল আনন্দিত সম্ভার দিয়ে দিচ্ছে বোকা দোকানি!
পত্রিকার কথা যখন উঠল তখন আরেকটি পত্রিকার কথা না বললেই নয়। সেটি হচ্ছে ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকা’। ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকা’র ছবি আর ফিচার আমায় মুগ্ধ করত। বিচিত্র বিশ্বের নানা প্রপঞ্চের কথা ও ছবি কী আকর্ষণীয় ভাবেই না পত্রিকাটি উপস্থাপন করত! কখনো বলগা হরিণ জিরাফ কিংবা গঙাফড়িঙের জীবনবৃত্তান্ত, কখনো দূর আকাশের মহাবিস্ময়কর নক্ষত্রপুঞ্জের অভ্যন্তরীণ হালফিল সংবাদ, কখনো মিসরের কোনো ফারাও-এর নবআবিষ্কৃৃত গোপন সমাধি সৌধের ছবি। নব্বইয়ের দশকে টিভিতে ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল’ সুলভ হলে ওই পত্রিকাটি জোগাড় করার নেশা কমে আসে। এখন তো মুভি চ্যানেল এইচবিওর আকর্ষণে ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল’ তেমন দেখাই হয় না! জিরাফ কী গঙাফড়িঙের জীবনবৃত্তান্তের বদলে ‘ট্রান্সপোর্টার-৩’ দেখতে ভালো লাগে!
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও আমার নিয়মিত নীলক্ষেত যাওয়া অব্যাহত ছিল। তবে সে যাওয়ার ধরন অনেকটাই গিয়েছিল বদলে। কেবলই বই কিনতে আর যেতাম না। পরীক্ষায় পাস করার জন্য টেক্সট বইয়ের খোঁজখবরও নিতে হতো। তাছাড়া ফটোকপির জন্যও যেতাম নীলক্ষেত। সিলেবাস অনুযায়ী হিস্ট্রির বই খুঁজতাম। দরকারি এবং দুর্লভ বই পেয়েও যেতাম। যেমন R.C. Majumdar, H.C. Raychaudhuri এবং Kalikinkar Datta-i An Advanced History of India কিংবা ওIrfan Habib Gi The Agrarian Szstem of Mughal India 1556-1707. এ সব বই আজও আমার সংগ্রহে আছে। অথচ Harold Robbins -এর একটি বইও আজ আর আমার সংগ্রহে নেই! কেবল পুরনো বই-ম্যাগাজিনই নয়। নীলক্ষেত বরাবরই ছিল আনকোড়া খাতাপেন্সিল এবং টেক্সট বইয়ের সরগরম হাট। আশির দশকে ততটা না হলেও নব্বইয়ের দশকে নীলক্ষেতে পাঠ্যপুস্তকের বিক্রির পরিমাণ বেড়ে যায়। একুশ শতকের প্রারম্ভে যেমন আজিজ মার্কেটের বইপাড়া পাঞ্জাবিওয়ালাদের দখলে চলে যায়, ঠিক তেমনি নব্বইয়ের দশকে নীলক্ষেত পাইরেটেড টেক্সট বই বিক্রেতাদের দখলে চলে যায়। এর ওপর একুশ শতকের ছাত্রছাত্রীরা অনেকটা যান্ত্রিকভাবে নীলক্ষেতে এসে টেক্সট বই কিনে ফটোকপি করে চলে যায়। সম্ভবত তারা নীলক্ষেত উপভোগ করে না। আমি নীলক্ষেতের কাছে ঋণী বলেই প্রতিমুহূর্ত উপভোগ করতাম। তবে আজকালকার নতুন প্রজন্মের অনেককেই বাংলা ক্লাসিক সাহিত্যও কিনতে দেখি। শরৎ-মানিক-বিভূতিভূষণ। ওইটুকুনই আশা।
নীলক্ষেতের চা-শিঙাড়া এবং তেহারির কথা উল্লেখ না করলে এ লেখাটি অপূর্ণ থেকে যাবে। নীলক্ষেতের চা-শিঙাড়া এবং তেহারি স্বাদে এবং গুণে অতুলনীয়। এই কথাটি যত না বৈজ্ঞানিক তার চেয়েও বেশি মনস্তাত্ত্বিক। আমি বই কেনার জন্য যেমন বাজেট রাখতাম তেমনি বাজেট ছিল তেহারির জন্যও। কলেজ জীবনে তেমন না-হলেও নীলক্ষেতের তেহারি খাওয়ার অভ্যেস গড়ে উঠেছিল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। কলাভবন থেকে রিকশায় উঠে সদলবলে চলে যেতাম দুপুরের দিকে। তারপর … সেসব স্মৃতি এখনো হানা দেয়। কত কত দিন নীলক্ষেতের রেস্টুরেন্টে বসে থেকেছি। কখনো বৃষ্টির দিনে আটকে গেছি। চা-সিগারেট নিয়ে নীলক্ষেতের কোনো রেস্তরাঁয় বসে আছি দীর্ঘক্ষণ। বাইরে ঝুম বৃষ্টি … আমার আবার এ শহরের বৃষ্টিতে কেমন ঘোর লাগে … বিশেষ করে সন্ধ্যার বৃষ্টি …
আজও পাঠ্যপুস্তকের ব্যাপক চাহিদার পাশাপাশি নীলক্ষেতের পুরনো বইয়ের কোণটুকু স্বমহিমায় টিকে আছে এবং টিকে থাকবে এই আশাটিও আমার মনের মধ্যে ঠিকই জেগে রয়েছে। আমাদের মতো হিসেবি মধ্যবিত্তের মানসিক আনন্দের অপার উৎস নীলক্ষেতের পুরনো বইয়ের দোকান আমাদের জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। সে কারণে নীলক্ষেতকে পবিত্র গ্রন্থতীর্থ বলতেও দ্বিধা নেই আমাদের কারও কারও। আমাদের মতো যাদের পুরনো বইয়ের গন্ধ শুঁকতে ভালো লাগে, তারা চায় নীলক্ষেত তার পুরনো বইয়ের অমূল্য গ্রন্থসম্পদ নিয়ে চিরকাল এমনই থাকুক। তবে নীলক্ষেতের জমির ওপর এ শহরের ভূমিদস্যুর ঠিকই শ্যেনদৃষ্টি পড়ার কথা। হয়ত একদিন রাতারাতি নীলক্ষেতের জমিটুকু গরিব বইবিক্রেতাদের বেহাত হয়ে যাবে। নীলক্ষেতের যেখানে এখন পুরনো বইয়ের টংঘর, সেখানে হয়তো গড়ে উঠবে বহুতল বাণিজ্যিক ভবনসহ শপিংকমপ্লেক্স। ঢাকা শহরের রক্তবাহী শিরা-উপশিরা শুকিয়ে আরো সঙ্কুচিত হয়ে যাবে। তাইই হবে। কেননা, কড়িলোভী বণিকতন্ত্রের পুরনো বইয়ের ঘ্রাণ শোঁকার তো দায় পড়েনি?