দাবা খেলার মধ্যেও কি লুকিয়ে রয়েছে বর্ণবাদের ছায়া ৷ না হলে কেন দাবার চাল শুরু হবে শুধু সাদা ঘুঁটি দিয়ে?
দাবার এই নিয়ম নিয়ে প্রশ্নটা উঠেছিল অস্ট্রেলিয়ার একটি বাচ্চা মেয়ের মনে৷ সে তাঁর বাবাকে জিজ্ঞাসা করে, কেন দাবা খেলা সবসময় শুরু হয় সাদা গুটির চাল দিয়ে, কেন কালো ঘুঁটি দিয়ে হয় না? তাঁর বাবা টুইট করে প্রশ্নটা তুলে দেন সামাজিক মাধ্যমে৷ আর সেখান থেকেই আইডিয়া নিয়ে এবিসি রেডিওতে একটি শো হয়, দাবা কি বর্ণবাদী?
প্রখ্যাত রুশ দাবাড়ু কারপভ এবং কাসপারভ থেকে শুরু করে অনেকেই বলেছেন, এটা আবার কী ধরনের প্রশ্ন? সাদা গুটি দিয়ে খেলা শুরু হয় বলে তাকে কেন বর্ণবাদী বলা হবে? বর্ণবাদের মতো গুরুতর একটি বিষয়কে কেন এভাবে লঘু করা হবে?
অ্যামেরিকায় বর্ণবাদী পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর বিশ্বজুড়ে আন্দোলন হচ্ছে, বলা হচ্ছে, ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস’৷ মানে কালো মানুষের জীবনেরও দাম রয়েছে । বর্ণবাদীদের হাতে নির্বিচারে কালো মানুষের হত্যা হতে পারে না৷ কেন ফ্লয়েডকে বলতে হবে, ‘‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না৷’’ বর্ণবাদীদের অত্যাচারে কেন মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত হতে হবে কালো মানুষদের?
এই প্রসঙ্গেই উঠে এসেছে দাবা নিয়ে প্রশ্ন । অনেকের মনে হতে পারে, প্রশ্নটা অবান্তর, এর সঙ্গে বর্ণবিদ্বেষের যোগ নেই৷ তাঁদের একটু মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে, বিশ্বের অন্যতম সেরা বক্সার মহম্মদ আলির প্রশ্নটা কেন সবকিছু সাদা? ১৯৭১ সালে তিনি টিভির একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ছোটবেলা থেকে মাকে জিজ্ঞাসা করতাম, কেন সবকিছু সাদা? কেন পরীরা সকলে সাদা? কালো পরীদের কী হবে? কেন আফ্রিকার জঙ্গলের রাজা টারজান একজন সাদা চামড়ার লোক? আফ্রিকার কালো মানুষেরা শতকের পর শতক সেখানে থাকল, কিন্তু জন্তু-জানোয়ারদের ভাষা বুঝল না, কিন্তু টারজান বুঝে ফেলল? কেন সব মিস অ্যামেরিকা সাদা, মিস ওয়ার্ল্ড, মিস ইউনিভার্স সকলেই সাদা? প্রেসিডেন্ট যে বাড়িতে থাকেন, তার নামও হোয়াইট হাউস৷ পরীদের কেক হলো সাদা এবং শয়তানদের কেক হলে তা হবে চকোলেট কেক । আর যত বাজে জিনিস, সব কালো। কালো বেড়াল মানে খারাপ ভাগ্য, কাউকে ভয় দেখানো মানে ব্ল্যাকমেল করা। হাসতে হাসতে মহম্মদ আলি বলেছিলেন, কেন এর নাম হোয়াইটমেল হলো না?
এই মজা করে বলা কথার মধ্যে দিয়ে কি মহম্মদ আলির যন্ত্রণা চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়েনি?
মহম্মদ আলির এই মন্তব্যের পর ৫০ বছর কেটে গেছে । মিস ওয়ার্ল্ড, ইউনিভার্স কালো বা বাদামি সুন্দরীরাও হন৷ কিন্তু শ্বেতাঙ্গ অরণ্যদেব বা ফ্যানটম এখনও কালো মানুষদের রক্ষা করেন৷ টারজান এখনও দাপিয়ে বেড়ান আফ্রিকার জঙ্গলে৷ এখনও ফ্লয়েডদের নিঃশ্বাস নিতে দেয় না বর্ণবাদী পুলিশ৷ তাই প্রশ্ন তো উঠতেই পারে, সবটাই কি কাকতালীয়, একেবারে সাদা মনের পরিচয়? না কি ইউরোপের লোকেরা যেহেতু দাবা খেলাকে জনপ্রিয় করেছে, তাই সেখানে সাদা গুটিই সবসময় আগে চলে৷ এর মধ্যে কি অন্তর্লীন বর্ণবাদের ছায়া নেই? কালো গুটি চাললে কি মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে?
সাধারণত, এই ধরনের ক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হয় ঐতিহ্যের৷ এতদিন ধরে চলে আসা একটা নিয়মের৷ ঠিক এই যুক্তিটাই উইম্বলডন টেনিসে প্লেয়ারদের সাদা পোশাক নিয়েও দেওয়া হয়। ঐতিহ্য বদল করা যাবে না। তাই সেখানে প্লেয়ারদের পোশাক আপাদমস্তক সাদা। এমনকী জুতোর সোল পর্যন্ত সাদা হতে হবে৷ সাদার পক্ষে যুক্তি ছিল, রঙিন পোশাক হলে ঘামের দাগ লেগে খারাপ দেখাবে৷ সাদাতে তা বোঝা যাবে না। এই যুক্তির সঙ্গে টেনিস শু ও তার সোল কেন সাদা হতে হবে তা বোঝা যাচ্ছে না৷ ২০১৪ সালে সেখানে নতুন ড্রেস কোড চালু হয়৷ সেখানে বলে দেওয়া হয়, নেকলাইনে এক সেন্টিমিটার চওড়া রঙিন স্ট্রিপ থাকতে পারে৷ উইম্বলডন বাদ দিয়ে বাকি দেশে রঙিন পোশাক পরে খেলতে পারেন প্লেয়াররা৷ মহম্মদ আলির প্রশ্নটা তাই এখনও যুক্তিযুক্ত, সব সাদা কেন?
ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র- এভাবে ছোট থেকে খুব বড় পরিসরে বিভিন্ন রূপে থাকে বর্ণবাদ । মুখের কথায়ও তা ব্যাপকভাবে ছড়াতে পারে৷ ক্যানাডার অ্যালবার্টা সিভিল লিবার্টিজ রিসার্চ সেন্টার বলছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে ‘ব্যক্তিগত মতামত’ হিসেবে যা কিছু বলা বা লেখার মাধ্যমেও তা ব্যাপক হারে ছড়ায়৷ তাই ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির নামে পক্ষপাত বা ঘৃণা প্রকাশ পরিহার করুন৷
টেস্ট ক্রিকেটের দুনিয়ায় আগে সব সাদা ছিল৷ প্যান্ট, শার্ট, টুপি, জুতো সব। এখন ক্রিকেটের সব চেয়ে জনপ্রিয় টি ২০-তে শুধুই রঙের ছোঁয়া৷ এই ক্রিকেটও তো চালু করেছিলেন সাহেবরা। তাই কি সব সাদা?
তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া গেল, দাবায় সাদাই প্রথম চাল দেবে, তার মধ্যে কোনো বর্ণবাদ নেই। কিন্তু এখন যখন প্রশ্নটা উঠছে, তখন নিয়ম সামান্য বদল করলে তো মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। একবার সাদা ঘুঁটি দিয়ে আগে চাল হোক, পরের বার কালো। কোন ঘুঁটির চাল প্রথমে আসবে তা ঠিক করতে টসও করা যেতে পারে। গত মার্চেই অনীশ গিরির সঙ্গে ম্যাচ খেলতে গিয়ে ম্যাগনাস কার্লসেন কালো ঘুঁটি দিয়ে প্রথম চাল দিয়েছিলেন। কারণ, দিনটি ছিল বর্ণবাদী বৈষম্য শেষ করার জন্য জাতি সংঘের নির্ধারিত আন্তর্জাতিক দিবস। তখন যদি কালো দিয়ে চাল হতে পারে, ভবিষ্যতে হলেই বা অসুবিধা কোথায়? না হয় আরেকটি ঐতিহ্য ভাঙবে।