বাংলাদেশের কিছু কিছু মৌলবাদী রাজনৈতিক নেতাদের মুখে ‘বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা’ প্রসঙ্গ এলে তারা বলে ‘নাউযুবিল্লাহ্’। দেশের রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবাদ দিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিদন্দ্বিতা করা সকলের জন্য মঙ্গল। আসুন যাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ হলো তাঁকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করি। বঙ্গবন্ধু ও আওয়মীলীগের বিরোধে এ শ্রেণি বিষবাস্প যাই ছড়ায় না কেন, আসুন আমরা দেখি বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ দেশ ও ধর্মের জন্য কী কী কাজ করেছে। সে কাজে দেশ ও ধর্মের কী উপকার হয়েছে আর কী কাজ ধর্মের বিরোধে গিয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রেমের ফলে বাংলাদেশ দু’বার স্বাধীন হয়েছে। প্রথম বার পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠির হাত থেকে, দ্বিতীয় বার ভারতীয় মিত্র বাহিনীর উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশের মিত্র পক্ষ। মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যৌথ আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার আত্মসমর্থন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে মিত্র বাহিনী থেকে যায়। বঙ্গবন্ধু মিত্র বাহিনীর সৈন্য ঢাকা ত্যাগে বাধ্য করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ণতা পায়।
আমাদের মনে আছে, নব্বইয়ের দশকে ইরাক-কুয়েত যুদ্ধ শুরু হলে, কুয়েতের মিত্র পক্ষ সেখানে অবস্থান নেয় এবং আজও তারা কুয়েতে এবং আরব বিশ্বে উপনিবেশ গড়ে রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে আসছে। এ উপনিবেশের ফলেই ইরাক এবং আফগানিস্তান ধ্বংস করা ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর পক্ষে সহজ হয়। কেন না, প্রতিবেশি ইসলামি রাষ্ট্র থেকেই তারা আক্রমন করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের পরপরই ভারতীয় সৈন্যের ঢাকা ত্যাগ সে কারণে অবশ্যই তাৎপর্যবাহী এবং এর কৃতিত্ব একমাত্র বঙ্গবন্ধুর। তাছাড়া ১৯৭৪ সালে লাহোরে ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর যোগদান কয়েকটি রাষ্ট্র বাঁকা চোখে দেখলেও বঙ্গবন্ধু সে সম্মেলনে যোগদিয়েছিলেন। স্বাধীন দেশের রাষ্ট্র প্রধান, কারো রক্তচক্ষুকে পরোয়া করেননি। শুধু তাই নয় এ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ইসলামী বিশ্বে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। অমুসলিম মিত্র শক্তির দেখানো ভয়ে, বঙ্গবন্ধু’র ভয় না পাওয়ার মানে হলো সে একজন রাষ্ট্র প্রধান, কোনো দেশের তাঁবেদার নয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন আপসহীন নেতা, গ্রেট মুসলীম, মুসলমানের দাবিই ছিল তাঁর প্রধান দাবি। আর সে দাবিতেই তিনি লাহোরের সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। এই যদি হয় ধর্মীয় চেতনা, রাষ্ট্র পরিচালনার বহিঃপ্রকাশ, তাহলে কোথায় বঙ্গবন্ধুর নমনীয় মনোবৃত্তি? ধর্মান্ধ ব্যবসায়ীরা যে বঙ্গবন্ধুর কথা বলে তিনি কোন জন? আমরা তাকে দেখতে চাই, তার দালালি কার্যকলাপের সাথে পরিচিত হতে চাই, পারলে সেটার দালিলিক সত্য কেউ উপস্থাপন করুক। অথবা এমনতর ধৃষ্টাচরণ বন্ধ করুক।
সে সময় কথিত ধর্মনিরপেক্ষতার আরও একটি শিকার হতে গিয়েছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন। টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন যে, টেলিভিশন থেকে কোন প্রকার ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে না এবং নিয়মিত ভাবে কোরআন শরীফ তেলাওয়াত প্রচার করাও হবে না। এর পরিবর্তে তারা কিছু বাণী প্রচারের ব্যবস্থা করেন। এই ব্যবস্থাও শেখ সাহেবের হস্তক্ষেপের ফলে কার্যকর হয়নি। এ উপলক্ষে আমার একটি ঘটনার কথা মনে পরছে, বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ঢাকার চান খাঁর পুলের আওয়ামি লীগ কর্মীরা একটি উৎসবের আয়োজন করেন। সেখানে গান-বাজনা এবং বাজি পোড়ানো হবে, এই সিদ্ধান্ত হয়। কর্মীরা এ উৎসবের জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে কিছু অর্থসাহায্য চেয়েছিলেন। তিনি সাহার্য দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, গান-বাজনা এবং বাজি পোড়ানোর পরিবর্তে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করতে। বলেছিলেন, ‘মুসলমানদের উৎসব হচ্ছে মিলাদ। মুসলমানরা কোন কিছুতে সফলকাম হলে এবং খুশি হলে মিলাদ পড়ায়।’’ সৈয়দ আলী আহসানের এ উদ্ধৃতি থেকে আমরা জানতে পারি, সরকারী আমলারা বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার নাম করে ধর্মহীনতার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে ছিলেন ঠিকই কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হস্তক্ষেপে তারা তা পারেনি।
বঙ্গবন্ধু তাদের অনৈসলামিক কাজ মেনে নিতে পারেননি। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, বঙ্গবন্ধু একথা বার বার সকলকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভাষণে স্পষ্ট ভাষায় বলেন- “বাংলাদেশে মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা করা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না।” পবিত্র ধর্ম ইসলাম, এ ধর্মে অন্যায়-অত্যাচারের স্থান নেই। কোন প্রকার ধর্মীয় অনাচারের সমর্থন ইসলাম করে না। আমরা যদি মদিনা সনদের দিকে তাকাই, সেখানে দেখি নবী করিম (স.) মানুষের মর্যাদা দিয়েছেন ব্যবহৃত সকল ধর্মের ঊর্ধ্বে। মহানবী (স.) মদিনা সনদে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে, স্বাক্ষরকারী সকল ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক ও মুসলমান সম্প্রদায়সমূহ সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে এবং তারা একটি সাধারণ জাতি কমনওয়েথ করে। তাদের মাঝে পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় থাকবে। মুসলমান ও অমুসলমান সম্প্রদায় বিনাদ্বিদায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, কেউ কারো ধর্মে হস্থক্ষেপ করতে পারবে না। আল্লামা ছফিউল রহমান মোবারকপুরী বলেন, “হিজরতের পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের মধ্যে আকীদা-বিশ্বাস, রাজনীতি এবং একক শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি নতুন সমাজের ভিত্তি স্থাপন করে অমুসলিমদের সাথে নিজের সম্পর্ক সুবিন্যস্তকরণের উদ্যোগ নেন। তিনি চাচ্ছিলেন, সকল মানুষ সুখ শান্তি ও নিরাপত্তার সৌভাগ্য ও বরকতে পূর্ণ হোক। তিনি উদারতা ও মানসিক প্রশস্ততার এমন কানুন প্রণয়ন করলেন, গোঁড়ামি বাড়াবাড়ি এবং চরম পন্থায় ভরা বিশ্বে যায় কোনো ধারণা চিন্তাও ছিলো না।...মদীনার সবচেয়ে নিকটবর্তী প্রতিবেশী ছিলো ইহুদীরা। তারা পর্দার আড়ালে যদিও মুসলমানদের সাথে শত্রুতা করতো, তবু এ পর্যন্ত তারা বিরোধিতা ও ঝগড়াঝাটির প্রকাশ ঘটায়নি। এ কারণে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সাথে একটি চুক্তিতে উপনিত হন। সে চুক্তিতে তাদের দ্বীন ধর্ম পালন এবং জানমাল রক্ষার নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা দেয়া হয়।’’ বঙ্গবন্ধু ইসলামের এ শান্তি প্রতিষ্ঠায় মগ্ন ছিলেন। তাঁর সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় বাংলাদেশে যে পরিমান ইসলামী প্রচার-প্রচারণা এবং ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তি দৃঢ় করার প্রচেষ্ঠা চলেছে তা বঙ্গবন্ধু পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কোন সরকার করেনি।
লেখক: ইতিহাস গবেষক ও ভাষাতাত্ত্বীক।
সম্পাদনা : এস এম সাব্বির খান