আত্মা চলে গেলে মানুষ মরে যায়, আত্মা মরে গেলে মানুষ ক্ষয়ে যায়। "I am dead inside-Messi"...ফুটবল পায়ে মেসির কাছে প্রত্যাশার লাগাম সজোরে টেনে ধরি। এই উক্তির পর কোনো যুক্তিই খাটে না তারে দাও দাও বলে স্বার্থপরতায় ভালোবাসার। ক্লাব বা জাতীয় দল। বাছাই, ফ্রেন্ডলি বা বিশ্বকাপের মঞ্চ...'ভেতর মরা' মেসির কাছে আর কিছু প্রত্যাশা না করাই মনে হয় ভালো। বয়স, শ্রম, ব্যর্থতা যাকে ক্লান্ত করতে পারেনি সেই মেসিকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে বার্সা বিচ্ছেদ! এরপরেও শুধু চাইবোই! না। এবার দেবো। বিনিময়ে চাইবো না কিছু। তুমি একা নও, আমরা আছি। সুখের মতো শোকেও সমভাগী হতে প্রস্তুত, ভালোবাসি যে! এবার নীরবে ওকে নিজের মতো ক্যারিয়ারটা শেষ করতে দেই চলুন আর পাশে থেকে ভালোবেসে যাই। মেসি কি খেললো, কেমন খেললো...ভুলে যাই। তুমি শেষটা শেষের আগে উপভোগ করো, আমরা ছিলাম..আছি..থাকবো। মেসি মেসি বলে চিৎকার করবো বিপুল উল্লাসে, কারণে-অকারণে।
কদিন আগেও কোপা জয়ী উজ্জীবিত মেসির কাছে অনেক প্রত্যাশা আর আবদার জমেছিল। প্রত্যাশা ছিল, বার বার শিরোপার গা ঘেঁষে বেরিয়ে যাওয়া আক্ষেপ যখন ঘুচেছে, তখন নির্ঘাত ব্যাপক তাতিয়ে উঠবে লিও। খুব দরকার ছিল একটা শিরোপা উদযাপন...উজ্জীবিত লিও আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলে এবার কাতারও নাচাবে! সোনালী শ্রেষ্ঠত্ব দাও মেসি আর জন্মন্তরের ভালোবাসা নাও! হ্যা বলেছি, ক'দিন আগেই। এখন চাই না। শুধু চাই আমাদের ভালোবাসায় তুমি প্রশান্ত হও হারানোর শোক ভুলে।
এখন শুধু প্রত্যাশা করি, সামনের সময়টুকু শেষ করে শুধু তুমি তোমার মতো পার করে দাও। শেষটা হোক তোমার শ্রেষ্ঠত্বের অমর কীর্তিগাঁথার শেষ পৃষ্ঠার মতো। কিচ্ছু লাগবে না মেসি...বাকি সময়টুকু কোনো শিরোপা, শ্রেষ্ঠত্ব, মেডেল এমন কি গোলও চাই না তোমার কাছে। শুধু যতদিন আছো, তোমাকে নিরন্তর ভালোবেসে যেতে চাই। পিঠে ১০ থাক বা ১৯। বিনিময়ে একটা ড্রিবলিংও চাইবো না। অনেক দিয়েছো, ভালোবেসেছি। যত ভালোবেসেছি ততোই দিয়েছো উজাড় করে। এবার কোনো প্রত্যাশা ছাড়া নিঃস্বার্থ ভালোবাসা হবে। প্রাণবন্ত মেসি দিয়েছে আমরা ভালোবেসেছি আর প্রাণহীন মেসি কিচ্ছু দিতে না পারলে ভালোবাসা মুখ ফিরিয়ে নেবে...সে ভালোবাসিনি তোমাকে। যতদিন আছো শুধু ভালোবেসে যাবো।
প্রিয় মেসি, বিরহে বিবর্ণ মেসির জীবস্মৃত সত্তার উপর প্রত্যাশার পাহাড় চাপানো ফ্যান তো আমরা না! যদি পারো নিজের জন্য শেষলগ্নে কিছু অর্জন করে নাও। আমাদের দিতে হবে না। ফুটবলকে দিয়ে যাও। আমরা বিশ্বজয়ী মেসিকে দেখেছি...ফুটবলের মহামঞ্চে সোনালী ট্রফিজয়ী মেসিকে ভালোবেসেছি। এমন কিছু বলতেই হবে মোটেই তা নয়! তোমার হাতে ট্রফি চেয়েছি ট্রফির মাঝে তোমাকে চাইনি। তারচেয়ে অনেক বড় প্রাপ্তিতে আমাদের প্রাপ্তির পেয়ালা আরো আগেই ভরে টইটম্বুর। একটা ট্রফির মূল্যে তোমার মতো অমূল্য রত্নের শ্রেষ্ঠত্ব যাচবো!! মুর্খের কাজ সে, আমাদের না। হ্যা, কালজয়ী শ্রেষ্ঠজনেদের স্মরণে সেই সোনালী ট্রফির উচ্ছ্বাস উচ্চারিত হয়। কি ভাবছো? তোমার কথা বলতে গিয়ে আমরা কোন শ্রেষ্ঠত্বগাঁথা শোনাবো? বেশ তবে শোনো কিসে দেবো তোমার উদযাপন আর মহানায়কের পরিচায়কে দেবো তোমার নামের উচ্চারণ.....বলবো,"আমরা মেসিকে দেখেছি।
আর্জেন্টিনার ছোট্ট শহর রোজারিও থেকে ছেড়া টিস্যু পেপারে মুড়িয়ে সে এসেছিলো...ম্যারাডোনা, রাইকার্ড, শেভচেঙ্কো, রোনালদিনহোর উত্তরসূরী হয়ে ন্যু-ক্যাম্পের মাঠে এক রতি মুক্তার ছোট্ট আলোর কণা হয়ে। বার্সার সেই আলোক কণা ক্রমেই উদ্ভাসিত হলো, আর্জেন্টিনার নক্ষত্র হয়ে আরো উজ্জ্বল হলো...এরপর বিস্ফোরিত বিকিরণের বিপুল বিচ্ছুরণে প্রজ্জ্বলিত হলো ফুটবল জগতের মহাজাগতিক মহানক্ষত্র রূপে। ফুটবল ঈশ্বরের সম্মোখ বরপুষ্ট হয়ে, কালো মানিকের ছোয়ায় বিকশিত হয়ে সমহীমায় আবির্ভূত হলো সেই কালজয়ী ফুটবলের মহাতান্ত্রিক। যার শ্রেষ্ঠত্বের আধিপত্য সমস্বরে উচ্চারিত গ্রহ-গ্রহান্তরে; যার অদ্বিতীয় কায়া প্রতিফলিত ফুটবল টার্ফের প্রতিটি তৃণের ডগায় জমা স্বচ্ছ শিশিরের মাঝে। আমরা এক খুদে ফুটবল যাদুকরকে দেখেছি...যার পায়ের যাদুতে মোহগ্রস্ত হয়েছি, আজো ঘোর কাটেনি...যার মানবিক প্রাচুর্য আর ব্যক্তিত্বের ঔজ্জ্বল্যে ছিল পবিত্র যীশুর চ্ছটা...নিষ্পাপ হাসিতে ছিল ভালোবাসা আর পতিত-অবহেলিত-অসহায়ের তরে যে ছিল মাসীহা।
আমরা খুদে যাদুকর লিও মেসিকে দেখেছি। সেই ছেড়া টিস্যু পেপার থেকে যে ছুয়ে দিয়ে গেছে আইফেল টাওয়ারের অনন্য উচ্চতা; অনবদ্য কীর্তিতে। কালে কালে ফুটবল পায়ে সার্থক হয়েছে বহু কালজয়ী মহারথী, মহাতারকা। আমরা দেখেছি সেই মেসিকে-যার পায়ের স্পর্শে সার্থক হয়েছে স্বয়ং ফুটবল। সযত্নে সে নাম হৃদয়ে পুষে রেখেছি নাম তার লিওনাল আলেহেন্দ্রো কুচিত্তিনি মেসি।
হয়তো লোকে বলবে, এখনো সময় বাকি, এখনই একেবারে বিদায় বিরহের বিবাগী আবেগে কাতর কেন? কারণ তো আছে। হ্যা এখনো খানিকটা সময় বাকি ফুটবল থেকে পা সরিয়ে নেয়ার, এখনো তো আছে কিছুক্ষণ। হ্যা আছে তো, এখন ফুটবল মাঠে মেসির দেহ আছে মেসি নেই। তোমাদের হিসেবে বয়সের কোটা ফুরাবে যেদিন সেদিন মাঠ থেকে বিদায় নেবে মেসির শরীরটা। মেসি তো ফুটবল থেকে বিদায় নিয়ে গেছে ন্যু-ক্যাম্পের কনফারেন্স হলের এক কোনায় বসে বলা সেই কথাটির সঙ্গে সঙ্গেই..."আমি ভেঙে গেছি। মরে গেছি। আমার ভেতর মরে গেছে।"
বার্সেলোনা-লিওনাল মেসি...একে অন্যের হয়ে তোমরা গোটা ফুটবল বিশ্বকে দিয়েছো কালজয়ী বহু মাহেন্দ্রক্ষণ, উপলক্ষ, উচ্ছ্বাস আর উদযাপন। অনেক অনেক ভালোবাসা। যাহ! শেষটায় কি বলবো? বিদায় বার্সেলোনা নাকি বিদায় লিওনেল মেসি? সবিশেষ কোনটা বলবো, তাই তো বুঝতে পারছি না!
লেখক || সাংবাদিক, দৈনিক জাগরণ.