একটি জাতীয় গণমাধ্যমের কর্মী হারুনুর রশিদের মেয়ের ডেঙ্গুজ্বর ধরা পড়ে গত ২৭ জুলাই। তিনি থাকেন মিরপুর ৬০ ফিট এলাকায়। ১০ বছর বয়সী মেয়ে রাইসার জ্বর ধরা পড়ার পর তাকে হাসপাতালে ভর্তি জরুরি হয়ে পড়ে। তিনি চেষ্টা করেন বাসার কাছে ইবনে সিনা মিরপুর শাখা, ডেল্টা হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে শয্যা নেই। পরে একে-তাকে ধরে বহু কষ্টে একটি শয্যা ব্যবস্থা করেন ঢাকা শিশু হাসপাতালে। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। ওইদিন রাতে মেয়ের অবস্থার অবনতি হতে থাকে। চিকিৎসক পরামর্শ দেন আইসিইউতে ভর্তি করাতে, ওদিকে আবার শিশু হাসপাতালের আইসিইউতে শয্যা ফাঁকা নেই। মেয়েকে নিয়ে মহাবিপদে পড়েন হারুনুর রশিদ। ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে খবর নেন আইসিইউর একটি ফাঁকা শয্যার জন্য। কিন্তু সিট পাননি। পরে লালমাটিয়ার সিটি হাসপাতালে আইসিইউর শয্যা পান তিনি। সেখানেই মেয়েকে ভর্তি করান হারুনুর রশিদ।
হারুনুর রশিদ দৈনিক জাগরণকে বলেন, শুনেছিলাম হাসপাতালে শয্যা খালি নেই। কিন্তু পরিস্থিতি যে এতোটা খারাপ তা নিজে সম্মুখীন না হলে বুঝতাম না। হাসপাতালে একটি সাধারণ শয্যা, আইসিইউর শয্যার জন্য কতটা যে দুর্ভোগ ও উদ্বেগের মধ্যে সময়গুলো গেছে তা বলে বুঝাতে পারব না।
এটা শুধু হারুনুর রশিদের ক্ষেত্রেই নয়, বহু ডেঙ্গু রোগীই শয্যার অভাবে ভর্তি হতে পারছেন না হাসপাতালে। আর এ কারণে কোনও কোনও রোগীর অবস্থা হয়ে যাচ্ছে সঙ্কটাপন্ন। বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। প্রতিদিনই ঢাকায় বৃদ্ধি পাচ্ছে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা। বাড়ছে ঢাকার বাইরেও। গত ২৭ জুলাই রাত ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ৮২৪জন ডেঙ্গু রোগী ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। ১৯ বছরের মধ্যে একদিনে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির সংখ্যা এটাই সবচেয়ে বেশি। ২৬ জুলাই রাত ৮টা পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ৬৮৩ জন, ২৫ জুলাই সকাল ৮টা পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ৩৯০ জন, গত ২৪ জুলাই সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ৫৪৭ জন, ২৩ জুলাই সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ৫৬০ জন, ২২ জুলাই সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ৪৭৩ জন, গত ২১ জুলাই সকাল ৮টা পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ৪০৩ জন, ২০ জুলাই সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার ২৮৫জন এবং ১৯ জুলাই সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ২৩৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়েছে বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর।
এ বছর (২৯ জুলাই, সোমবার পর্যন্ত) ডেঙ্গু রোগাক্রান্তের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ফলে ঢাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় ভয়াবহ চাপ বেড়েছে রোগীর। নিশ্চিত ডেঙ্গুরোগীর বাইরেও যাদের জ্বর, শরীরে ব্যথা বা চোখে-দেহে লালচেভাব দেখা দিচ্ছে, তারাও ডেঙ্গু সন্দেহে হাসপাতালগুলোয় হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন।
সেন্ট্রাল হাসপাতালে কথা হয় ডেঙ্গুজ্বরাক্রান্ত এক রোগীর স্বজন পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারের বাসিন্দা আসমতের সাথে। তিনি বললেন, ভাতিজার ডেঙ্গুজ্বর হয়েছে চার দিন হলো। পুরান ঢাকার সালাউদ্দিন হাসপাতাল, আজগর আলী হাসপাতালসহ আরও কিছু হাসপাতালে সিট খুঁজলাম, কিন্তু পেলাম না। পরে সেন্ট্রালে এলাম। এখানেও দেখি সিট নেই। বের হয়ে যাবার সময় একজন নার্স বললেন, একজন রোগী ছুটি পাচ্ছেন এখনই একটি সিট পেতে পারেন। কপাল গুণে এভাবে সিট পেয়ে গেলাম।
সোমবার (২৯ জুলাই) ঢাকা শিশু হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবদুল হাকিম দৈনিক জাগরণকে জানান, ঢাকা শিশু হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে ১২৭টি শিশু। এর মধ্যে আইসিইউতে আছে ১৪ জন। বহু মা-বাবাকে ফেরত যাচ্ছেন আইসিইউর শয্যা না পেয়ে।
শুধু শিশু হাসপাতালই নয়। ঢাকার সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিত্র একই। সরকারি হাসপাতালে মেঝেতে শুয়ে অনেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালে এমন সুযোগ না থাকায় বিপুলসংখ্যক রোগী আছেন মহাবিপদে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ দৈনিক জাগরণকে বলেন, রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ সমস্যা হয়েছে। তবে কোনও রোগী যেন চিকিৎসার অভাবে কষ্ট না পায়, সেজন্য আমরা সজাগ। এ সম্পর্কে প্রত্যেকে হাসপাতালকে অবহিত করা হয়েছে। আমাদের মনিটরিং টিম মাঠে সক্রিয়।
আরএম/এসএমএম