মন্ত্রী বা এমপি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, রাজনীতির এই শিবির বা ওই শিবির বলে কিছু নেই, আক্রান্ত হচ্ছে শহর থেকে শুরু করে গ্রামের মানুষ- সবখানেই ডেঙ্গুআতঙ্ক। এরই মধ্যে এসেছে খুশির ঈদ। কিন্তু ঈদআনন্দ গ্রাস করছে ডেঙ্গুআতঙ্ক।
বিশেষ করে ঈদুল আযহায় সাধারণের আলোচনার প্রধান বিষয় থাকে কুরবানী নিয়ে। কে কি পশু কুরবানী দেবেন? এবার পশুর দাম কেমন হবে? শেষ দিকে পশুর দাম বেড়ে যাবে, নাকি কমে যাবে? কোথায় ঈদ করবেন, শহরে (কর্মস্থল) নাকি গ্রামে? গণমাধ্যমেও ঈদের আগে এই সময়ে প্রধান সংবাদ বা সম্পাদকীয়ও লেখা হতো সেভাবে। প্রধান সংবাদে থাকতো এবার কুরবানীর পশু যোগান কেমন, আর চাহিদা কেমন? চাহিদার কতখানি যোগান দিতে পারবে দেশীয় খামারীরা, প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত হয়ে কী পরিমাণ গরু আসছে? পশুর চামড়ার দাম কেমন হবে এবার? মশলার বাজারের কী অবস্থা? ঈদ কেন্দ্রিক বর্জ ব্যবস্থাপনা কেমন হবে ইত্যাদি। একইভাবে ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কুরবানীর জন্য পশু কেনা, পশুর হাটে যাওয়াসহ এ সংক্রান্ত স্ট্যাটাস বা ছবি পোস্ট দিতো সাধারণ মানুষ।
কিন্তু এবার প্রধান্য পাচ্ছে ডেঙ্গুআতঙ্ক। অফিসে বা চায়ের দোকানে সাধারণ মানুষের আলোচনার প্রধান বিষয় ডেঙ্গুজ্বর। প্রায় সবগুলো সংবাদপত্রের প্রধান সংবাদ অব্যাহত ভাবে ডেঙ্গুজ্বর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তাই।
শহরের তুলনায় গ্রামে এখনো ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাব কম হলেও এবারের ঈদে গ্রামে যাওয়ার বিষয়ে খুব করে ভাবতে হচ্ছে নগরবাসীকে। কারণ গ্রামে থাকাকালীন ডেঙ্গুজ্বর সনাক্ত হলে চিকিৎসার কী হবে? চিকিৎসা ব্যবস্থা মন্দের ভালো যা আছে, তা তো শহরেই। আবার শহরে থেকে গেলেও যে নিশ্চিন্ত থাকা যাবে তা নয়। কারণ ঈদের পর শহর স্বরূপে ফিরতে সময় লেগে যাবে অন্তত দুই সপ্তাহ। এই সময় শহরে মানুষ কম থাকার কারণে রক্তদাতার সংখ্যাও কমবে ভীষণ ভাবে। আর রক্তদাতার সংখ্যা কমে গেলে গুরুতর ডেঙ্গু জ্বরাক্রান্ত রোগীর জীবন বাঁচানো দুরূহ হয়ে যাবে।
সব মিলে হঠাৎ করে পরিবারের বা কাছের কেউ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়লে কী হবে- এই আতঙ্কই প্রধান্য পাচ্ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। যা রীতিমত ঈদ আনন্দকে গ্রাস করছে।
প্রসঙ্গত, গত জানুয়ারি থেকে আজ ৭ আগস্ট পর্যন্ত চলতি বছরে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ২৩ জনের মারা যাওয়ার তথ্য সরকারিভাবে বলা হলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ নানা সূত্র বলছে মৃত্যুর সংখ্যা ৭০ জন ছাড়িয়ে গেছে। এই সময়ে ঢাকা শহর ব্যতীত সারাদেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮ হাজার ৮৬৩ জন। বর্তমানে ৩৩১৮ জন ঢাকার বাইরে স্থানীয় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন দুই হাজার ৪২৮ জন। রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গুজ্বর। দিন দিন বেড়েই চলছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে রোগীর চাপ। গত ২৪ ঘণ্টায় (৬ আগস্ট সকাল ৮টা থেকে ৭ আগস্ট সকাল ৮টা পর্যন্ত) রাজধানীসহ দেশের ৬৩ জেলায় (রাজশাহী বাদে) ২৪২৮ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
এর আগে গত ৫ আগস্ট সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা শহরসহ দেশের ৬৩ জেলায় (রাজশাহী বাদে) ২৩৪৮ জন, গত ৪ আগস্ট সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা শহরসহ দেশের ৬৩ জেলায় (রাজশাহী বাদে) ২০৬৫, ৩ আগস্ট সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ঢাকাসহ দেশের ৬৩ জেলায় (রাজশাহী বাদে) ১৮৭০, ২ আগস্ট সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ঢাকাসহ দেশের ৬৩ জেলায় (রাজশাহী বাদে) ১৬৪৯, ১ আগস্ট সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা শহরসহ দেশের ৬৩ জেলায় (রাজশাহী বাদে) ১৬৮৭, ৩১ জুলাই সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ১৭১২জন, ৩০ জুলাই সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৪৭৭, ২৯ জুলাই সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা শহরসহ দেশের ৬০টি জেলার হাসপাতালগুলোতে ১ হাজার ৩৫, ২৮ জুলাই সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ৫০ জেলায় ১ হাজার ৯৬ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরাধীন হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম জানায়, নতুন আক্রান্ত ২৪২৮ জন নিয়ে এ বছর (৭ আগস্ট পর্যন্ত) সারাদেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৩২ হাজার ৩৪০ জনে। এর মধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৮ হাজার ৭০৭ জন।
তথ্যমতে, নতুন আক্রান্ত ২৪২৮ জনের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৬২ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ১৩৮, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৪৪, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯৭, বারডেম হাসপাতালে ২৪, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ৪২, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৩৯, পিলখানাস্থ বিজিবি হাসপাতালে ৮, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ৪৫, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ১১০ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন।
অন্যদিকে, ওই ২৪ ঘণ্টায় হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ২৭, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৮, ইবনে সিনা হাসপাতালে ১৫, স্কয়ার হাসপাতালে ১৬, ধানমণ্ডির কমফোর্ট নার্সিংয়ে ১৩, শমরিতা হাসপাতালে ৯, ডেল্টা মেডিকেল কলেজে ২৪, ল্যাবএইডে ৪, সেন্ট্রাল হাসপাতালে ২৫, হাই কেয়ার হাসপাতালে ৮, হেলথ এন্ড হোপে ৫, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৬, ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে ২২, ইউনাইটেড হাসপাতালে ৩০, খিদমাহ হাসপাতালে ২, শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৯, সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৯ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন।
এছাড়াও অ্যাপোলো হাসপাতালে ১৬ জন, আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০, ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯, বিআরবি হাসপাতালে ১০, আজগর আলী হাসপাতালে ১৭, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ৮, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৬, সালাউদ্দিন হাসপাতালে ১০, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৮, উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৯ ও আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৪ এবং কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে ৭ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন বলে দৈনিক জাগরণকে জানান হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ও চিকিৎসক আয়েশা আক্তার।
গত ২৪ ঘণ্টাতে ঢাকা বিভাগে (শহর ব্যতীত) ২৯৯ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৮৭, খুলনা বিভাগে ১৮৬, রংপুর বিভাগে ৯১, রাজশাহী বিভাগে ১২৮, বরিশাল বিভাগে ১৫৯, সিলেট বিভাগে ৩৪ ও ময়মনসিংহ বিভাগে ৬৯ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত দেশজুড়ে (ঢাকা শহর ব্যতীত) ডেঙ্গুজ্বরে রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮ হাজার ৮৬৩ জন। বর্তমানে ৩৩১৮ জন ঢাকার বাইরে স্থানীয় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এমএ/টিএফ