থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে— কাজী নজরুল ইসলামের সংকল্প কবিতার এই পঙতি দুটি যেন বর্তমান সময়ে এসে হোঁচট খেয়েছে। করোনা পরিস্থিতি ডানপিটে শৈশবকে বদ্ধ ঘরে আবদ্ধ করে রেখেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার জেরে দেশে ঘরবন্দি প্রায় চার কোটি শিশু-কিশোর।
করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কয়েক ধাপে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। তাই ঘরে থাকা শিশুদের দৈনন্দিন জীবনে যুক্ত হয়েছে লেখাপড়ার বাড়তি সময়সূচি। টেলিভিশন কিংবা ইন্টারনেটের সাহায্যে অনলাইনে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই শিশুদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দিচ্ছেন অভিভাবকরা। খাবার আর গোসলের বিরতি ছাড়া রাত পর্যন্ত চলে পড়াশোনা। মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিতে না পারায় মানসিক বিকাশে পিছিয়ে পড়ছে চার দেয়ালের মাঝে আটকে থাকা শিশুরা। অভিভাবকরা বিষয়টি জানলেও শিশুদের ছাড় দিতে নারাজ। সবাই চান, জোর করেও হলেও স্কুলের পড়াগুলো বাড়িতে বসে শেষ করে নিতে। এতে করে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকবে না। কিন্তু লেখাপড়ার এই বাড়তি চাপে যে, শিশুরা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হচ্ছে সেটা তারা আমলে নেন না। শিশুর সামগ্রিক বিকাশের সঙ্গে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা নিবিড়ভাবে জড়িত।
রাজধানীর রায়ের বাজারবাসী ঝুমকি বসু জাগরণকে বলেন, “আমার ছেলে গদ্য’র দীর্ঘদিন ধরে স্কুল বন্ধ আছে। তাই বন্ধুদের সঙ্গে খেলা, হৈ-হুল্লোড়ের কোনো অবকাশ নেই তার। বাইরে বের হওয়ার সুযোগ নেই, বিনোদন কেন্দ্র বা পার্কে গিয়ে সে ছোটাছুটি করতে পারছে না। একই অবস্থা তাদের বন্ধুদেরও। ঘরে বন্দি থাকতে থাকতে ওদের মনটাও সংকীর্ণ হয়ে গেছে। সারাক্ষণ টিভিতে বা কম্পিউটারে কার্টুন দেখা, নয়তো মোবাইলে ইউটিউব ভিডিও এবং ভিডিও গেম খেলে খেলে তাদের মগজে বেশ প্রভাব ফেলছে। তাই কথায় কথায় মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। নয়তো অল্প কথাতেই মান-অভিমান, বা রাগারাগি দেখাচ্ছে।”
এই অভিভাবক আরো বলেন, “জীবন থেকে হারিয়ে গেছে নিয়মতান্ত্রিকতা। তাই বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে তারা। সকালে ওঠার তাড়া না থাকায় তৈরি হয়েছে রাত জাগার অভ্যাস। আর এর প্রভাব পড়ছে তাদের শরীর এবং মনে। অন্যদিকে ডিভাইসের প্রতি মারাত্মক আসক্ত হয়ে পড়ছে। সবকিছু মিলিয়ে এক জটিল সময় পার করছে করোনাকালের এই ঘরবন্দি শিশুরা।”
ঘরের মধ্যে লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি আনন্দদায়ক খেলায় সময় দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন শিশু বিশেষজ্ঞরা। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মুজিবুর রহমান বলেন, “ঘরবন্দি অবস্থায় থাকতে গিয়ে শিশুদের মধ্যে মানসিক অবসাদ তৈরি করতে পারে। যা তাদের মনোজগতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। ভয় যেন শিশুদের মনকে ঘিরে ধরতে না পারে সেদিকে বেশি খেয়াল রাখতে হবে।”
এই শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, “ঘরবন্দি সময়ে শিশুদের মানসিক বিকাশে ইনডোর গেমের আয়োজন করতে হবে। ক্যারামবোর্ড, লুডু, আইকিউ কিংবা লুকোচুরি খেলা যেতে পারে। এতে বাচ্চাদের ফিজিক্যাল এক্টিভিটি বেড়ে যাবে। ফলে মানসিক বিকাশ ঘটবে।”
এই সময়ে শিশুদের প্রতি বাড়তি খেয়াল রাখার পরামর্শ দিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মো. তাজুল ইসলাম বলেন, “করোনাভাইরাসের খবরগুলোও তাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে। চার বছর বয়সী থেকে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এর প্রভাবটা সবচাইতে বেশি। যারা মানসিকভাবে দুর্বল প্রকৃতির, আতঙ্কগ্রস্ত তাদের মধ্যে এর প্রভাবটা বেশি। যাদের মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা কম, তারাই বেশি মানসিকভাবে আক্রান্ত হবে। শিশুরা যেন ব্যায়াম, মেডিটেশন, বই পড়ার পাশাপাশি পরিমিত খাবার গ্রহণ করে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।”
এদিকে পুষ্টিবিদরা বলছেন, ঘরবন্দি শিশুদের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের বাড়তি নজর দিতে হবে। চিনি জাতীয় ও বেশি তেলে রান্না করা খাবার খেতে দেওয়া যাবে না। দুধ, ডিম, কলার মতো পুষ্টিকর খাবার খেতে দিতে হবে। এসব খাবার শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করে। মানসিকভাবেও চাঙা করে তোলে।
পুষ্টিবিদ উম্মে ফাতেমা চৌধুরী বলেন, “শিশুর পুষ্টির অভাব হলে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকবে। করোনার কারণে শিশুরা বাইরে যেতে পারছে না। খেলাধুলা করতে পারছে না। ঘরের মধ্যে যখন শিশুরা থাকছে তখন অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার, যেমন—ভাত, রুটি, জাঙ্ক ফুড (অস্বাস্থ্যকর খাবার) দেওয়া যাবে না। এগুলো বাদ দিয়ে প্রোটিন জাতীয় খাবার এবং শাক-সবজি, ফল বেশি বেশি খেলে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে।”
অদৃশ্য ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে দেশের ক্ষুদে নাগরিকরাও একেকজন যোদ্ধা। জীবন জগতের কঠোর বাস্তবতা শিশুরা বোঝে না। ফলে বাস্তবতার চাপে অভিভাবকদের মনের অবস্থা বুঝতে পারে না শিশুরা। তাই অভিভাবকদের আরো সচেতন ও যত্নশীল হওয়ার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।