বীরগঞ্জের নরমাল ডেলিভারি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে দেশ-বিদেশে

জাগরণ প্রতিবেদক প্রকাশিত: জানুয়ারি ১, ২০২২, ০৫:২৩ পিএম বীরগঞ্জের নরমাল ডেলিভারি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে  দেশ-বিদেশে
ছবি- জাগরণ।

প্রদীপ রায় জিতু, বীরগঞ্জ (দিনাজপুর) প্রতিনিধি// 

দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর কবীর এবং চিকিৎসা কর্মকর্তা আফরোজ সুলতানা ২০১৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর চাকাই গ্রামের প্রসূতি মাতা আনজু আরার হাতে নবজাতকের জন্য উপহার তুলে দিয়ে গল্পটা শুরু করেন। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

সেই গল্প ছড়িয়ে পড়লো দেশের সীমানা পেরিয়ে চীন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও থাইল্যান্ডে। বীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও থাইল্যান্ড স্বাভাবিক সন্তান প্রসব উৎসাহিত করছে তাদের দেশে।

বীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর কবীর এবং চিকিৎসা কর্মকর্তা আফরোজ সুলতানা এখন নেই। কিন্তু তাদের সহযোগিতায় এখনও নরমাল ডেলিভারি চলমান রয়েছে বীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।

মিডওয়াইফারি ডিপ্লোমা করা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাত নার্সের সহযোগিতায় প্রসূতিদের নরমাল ডেলিভারি করিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছেন বীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরা। দলগত কার্যক্রম এবং জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় কমপ্লেক্সে উন্নতমানের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন তারা। বদলে দিয়েছেন চিকিৎসাসেবার চিত্র। ২০ ডিসেম্বর সকালেও ছয় প্রসূতির স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব হয়েছে বীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার চালুর মাধ্যমে কমপ্লেক্সটিকে শিশুবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। বিশেষ করে স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসবের উদ্যোগটি সফলতা পাওয়ায় কমপ্লেক্সটি দিনাজপুরে একটি মডেল হিসেবে আবির্ভাব।

সিজারের নামে বাণিজ্য, দালালচক্র ও অদক্ষ ধাত্রীর হাত থেকে প্রসূতিদের রক্ষায় এবং নিরাপদে স্বাভাবিক সন্তান প্রসব করাতেই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. জাহাঙ্গীর কবীরের নেতৃত্বে বীরগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কয়েকজন চিকিৎসক টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে স্বাভাবিক সন্তান প্রসব কাজ শুরু করেন ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে। স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসবে প্রসূতিদের উদ্বুদ্ধকরণ প্রচারে বিভিন্ন কৌশলও কাজে লাগান তারা। এজন্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পক্ষ থেকে প্রসূতিদের বিনা মূল্যে ‘প্রসূতি কার্ড’ দেওয়া হয়। এরপর সন্তান  প্রসব না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে কাউন্সেলিং আর ফ্রি চেকআপ। প্রসূতি কার্ড ও স্বাভাবিক সন্তান প্রসব করাতে মাঠপর্যায়ে শিক্ষক, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার ও অনান্য জনপ্রতিনিধি, ইমাম ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে বার্তা পৌঁছনো হয় প্রসূতিদের কাছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরাও বিভিন্ন স্থানে গিয়ে কাউন্সেলিং করেন।

সে সময় বীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওই টিমওয়ার্কে ছিলেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর কবীর (বর্তমান সিভিল সার্জন নীলফামারী জেলা), আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. মাহমুদুল হাসান পলাশ, মেডিকেল অফিসার আফরোজ সুলতানা, ডা. তাহমিনা ফেরদৌস ও ডা. মাধবী দাস। তাদের সব ধরনের সমর্থন ও সহযোগিতা দেন হাসাপাতাল পরিচালনা কমিটির সভাপতি সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল। প্রথম দিকে খুব একটা সাড়া না পেলেও টিমওয়ার্কের মাধ্যমে ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে ব্যাপক সাড়া পড়তে শুরু করে। পরিসংখ্যাটা দিন দিন বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালে নরমাল ডেলিভারি হয় মাত্র ১৩১টি, ২০১৬ সালে তা কমে হয় ৯৪টি, আর ২০১৭ সাড়ে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৯৬ এ। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১৮ সালে ৭৭১, ২০১৯ সালে ৮০২, ২০২০ সালে ৫৪৪ এবং ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬২৬ নরমাল ডেলিভারি হয়েছে এ হাসপাতালে।

২০ ডিসেম্বর সকালে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিজার ছাড়াই ছেলে সন্তান জন্ম দেওয়া মা রহিমা বেগম বলেন, বয়সের কারণে এবং দেরি করে সন্তান নেওয়ায় এলাকার কিছু লোকের কথায় ভয় পেয়েছিলাম। অনেকে ক্লিনিকে সিজারের পরামর্শ দেন। কিন্তু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাঠকর্মী এবং চিকিৎসকরা অভয় দিয়ে দায়িত্ব নিলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হই। এখানে স্বাভাবিকভাবে ছেলে সন্তান হয়েছে। আমি ও আমার ছেলে সুস্থ আছি। প্রথমে ভয় পেলেও এখন খুব খুশি।

মিডওয়াইফারি ডিপ্লোমা করা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সিনিয়র নার্স রেহানা পারভীন রানু বলেন, এখনও যারা সিজার করছেন তারা দালালদের খপ্পরে পড়ে করছেন। অনেকে আবার সিজার করানোর মধ্যে বড়লোকি ভাব খুঁজে পান। প্রসুতিরা ধৈর্য ধরলে ও দালাল এবং গ্রামগঞ্জের দাইদের প্রতিরোধ করা গেলে নরমাল ডেলিভারি আরও বাড়বে।

জানতে চাইলে তৎকালীন বীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ও নীলফামারী জেলার সিভিল সার্জন মো. জাহাঙ্গীর কবীর বলেন, নরমাল ডেলিভারি করানোর খবর গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স দেশসেরা হাসাপাতালের পুরস্কার পায়। নরমাল ডেলিভারির বিষয়টি জানার পর, চীন ও থাইল্যান্ডের কনকেইন ইউনিভার্সিটি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল উপজেলা হাসাপাতালে এটা কী করে সম্ভব তা আমার কাছ থেকে সরাসরি শোনার জন্য। আমি চীনের বেইজিং এবং থাইল্যান্ড গিয়ে তাদের কর্মশালায় বক্তব্য রেখেছিলাম। অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের প্রতিনিধি দল সেসময় অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য বীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরিদর্শন করে। তারা এখন আমাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নরমাল ডেলিভারিতে উৎসাহিত করছে। এভাবে চলতে থাকলে এসডিজি অর্জন সম্ভব হবে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ মহসীন বলেন, একসময় বীরগঞ্জ হাসপাতালে প্রসূতিরা না আসায় নরমাল ডেলিভারি করানো প্রায় বন্ধ ছিল। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া টিমওয়ার্ক এখনও অব্যাহত রয়েছে। ফলে প্রতিদিনই নরমাল ডেলিভারি হয় এ হাসাপাতালে। বীরগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালে প্রসব নিরাপদ করতে সাতজন দক্ষ মিডওয়াইফ (ধাত্রী) রয়েছেন। স্বাভাবিক প্রসবে প্রসূতিদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। এভাবে স্বাভাবিক প্রসব হলে মানুষের অর্থ সাশ্রয় এবং স্বাস্থ্যসেবা ও নিচ্ছেন।

 

 

এসকেএইচ//