চীন আরোপিত প্রত্যর্পন বিলটি বাতিলের দাবিতে উত্তাল পুরো হংকং। সম্প্রতি এক গণবিক্ষোভের মুখে বিলটি নিয়ে আলোচনা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছেন হংকংয়ের প্রধান রাজনৈতিক নেতা ক্যারি ল্যাম। কিন্তু বিলটি সম্পূর্ণভাবে বাতিল করার স্থায়ী সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত নিজের ধ্যান ভাঙবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, এই বিক্ষোভের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠা 'বর্ম-বালিকা' (দ্য সিল্ড গার্ল) খ্যাত ২৬ বছর বয়সী এক তরুণী। নাম তার ল্যাম কা লো।
যখন অন্ধকার বাড়তে থাকে, তখন বিক্ষোভ সমাবেশে মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে। কিন্তু একমাত্র এই তরুণী দাঙ্গা পুলিশের ঢালের সারির সামনে অটলভাবে বসে অব্যাহত ধ্যান করতে থাকেন কা লো, আর সন্ধ্যার আলো-আঁধারের মাঝে তার মুখে থাকে বুদ্ধার অহিংস মন্ত্রের যপ।
'শিল্ড গার্ল' বা 'বর্ম-বালিকা' নামে পরিচিতি পাওয়া এই তরুণী বিবিসিকে বলেছেন, বিলটির অনির্দিষ্টকালীন স্থগিতাদেশ সত্ত্বেও তিনি তার লড়াই চালিয়ে যাবেন। কারণ তাদের দাবি বিলের কার্যক্রম স্থায়ীভাবে বাতিল ঘোষণা করা। এভাবেই রাতারাতি হংকং বিক্ষোভের একটি প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠেন এই নারী। যা নিয়ে আলোচনার স্রোত বয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জুড়ে।
হংকংয়ে কর্তব্যরত আইরিশ সাংবাদিক আইরিন ম্যাক নিকোলাস এক টুইটার পোস্টে কা লো'র সম্পর্কে মন্তব্য করোতে গিয়ে লিখেছেন, "উজ্জীবিত তারুণ্যের পক্ষে এবং কর্তৃপক্ষের দাঙ্গার বিরুদ্ধে এক দুর্ভেদ্য বর্ম কা লো"। এমনকি চীনের ভিন্ন মতাবলম্বী শীর্ষশিল্পী বুদিউকাও- এই বর্ম-বালিকায় অনুপ্রাণিত হয়ে তার ছবি এঁকেছেন বিপ্লবের ক্যানভাসে।
প্রত্যর্পণ বিল নিয়ে শুরু হওয়া বিক্ষোভে অংশ নিতে এই ২৬ বছর বয়সী কা লো নিজ থেকেই অ্যাডমিরালটি শহরে আসেন। এখানেই হংকংয়ের সব গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তর অবস্থিত। ল্যাম কা লো সেখানে পৌঁছান মঙ্গলবার (১৮ জুন) রাতে। অর্থাৎ সিভিল হিউম্যান রাইটস ফ্রন্ট আয়োজিত একটি সমাবেশের ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগে। এ সময় এক প্রতিবাদকারী হংকংয়ের আইনপরিষদের বাইরে দাঙ্গা পুলিশের সামনে অবস্থান নেন। সঙ্গে ছিল শত শত বিক্ষোভকারী, কিন্তু আরও বেশিসংখ্যক পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়ে পুরো সমাবেশস্থল ঘিরে ফেলে।
এই পরিস্থিতিতে হার্ড লাইনে থাকা পুলিশের কর্মকর্তাদের লাইনের কাছাকাছি দাঁড়ানোর সাহস কারো ছিল না। তবে পুলিশকে ভয় পাননি মিস কা লো। তিনি আশঙ্কায় ছিলেন যে অন্যান্য প্রতিবাদকারীরা আহত হতে পারে। এমন এক থমথমে পরিস্থিতির মধ্যে তিনি ওম মন্ত্র যপে ধ্যান করতে থাকেন।
মিস কা লো বলেন, 'আমি শুধুমাত্র একটি ইতিবাচক আবেশ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা পুলিশের ব্যাপারে উদ্ধত হয়ে উঠছিল। সেই মুহূর্তে, আমি শুধু চেয়েছি প্রতিবাদকারীরা যেন আমার পাশে বসেন এবং কারও প্রতি যেন তারা উদ্ধত না হন।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি কারও মনোযোগের কেন্দ্র হতে চাই না। কিন্তু যদি মানুষ আমাকে পুলিশের সামনে বসতে দেখে, আমি আশা করি সেটা তাদেরকে সাহসী হতে এবং নিজেদের প্রকাশ করতে সাহায্য করবে।'
একটি বিক্ষোভ সমাবেশের মধ্যেও কা লো'র এতোটা শান্ত থাকার পেছনের মূল শক্তি হল তার ধ্যানের অনুশীলন। কা লো, ব্যক্তিগতভাবে একজন ভ্রমণ পিপাসু। এর মধ্যে তিনি এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। চার বছর আগে নেপালে সফরে গিয়ে তিনি ধ্যানের দিকে ধাবিত হন - যখন দেশটি একটি মারাত্মক ভূমিকম্পের কারণে জর্জরিত হয়ে পড়েছিল। তার ভাষ্য মতে, তিনি স্বভাবত একজন আবেগ প্রবণ মানুষ, কিন্তু ধ্যান তাকে তার অনুভূতির প্রতি আরও বেশি মনোযোগী হতে এবং মনের শান্তি অর্জনে সহায়তা করেছে।
২০১৪ সালে ৭৯ দিনের আমব্রেলা মুভমেন্টের প্রতিটা দিন তিনি রাস্তায় কাটিয়েছেন কা লো। তবে বুধবার বিকেলে হংকং পুলিশ কর্মকর্তা ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে যে নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল সেটার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না।
তিনি বলেন, 'আমি দেখেছি মানুষে মানুষে কতো ঘৃণা কাজ করছে। কারণ পুলিশ কিছু ছাত্রকে পিটিয়ে আহত করেছিল। বুধবারের ওই সহিংতার সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন না কা লো ল্যাম।'
তার মতে 'আমরা শুধুই মানুষ। যাদের অনুভূতি আছে।' তিনি বলেন, প্রতিবাদ আন্দোলনে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিচ্ছিন্ন করা ঠিক নয়। আমি বিশ্বাস করি যে অহিংসা হচ্ছে প্রতিবাদকারীদের লক্ষ্য অর্জনের প্রধান উপায়।'
কা লোও চান এই বিলের প্রত্যাহার, বুধবারের (১৯ জুন) সহিংসতাকে যেন দাঙ্গা হিসাবে শ্রেণীকরণ করা না হয় এবং যেসব বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের যেন মুক্তি দেয়া হয়। একই সঙ্গে তিনি তার সহ-প্রতিবাদকারীদের প্রতি এই বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়ারও আহ্বান জানান।
মিস কা লো বলেন, 'আপনারা আপনাদের বন্ধুবান্ধব-পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দিন। দলে দলে আসুন। নিজেকে নিজের মতো প্রকাশ করুন। আমি ধ্যানের মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, এটিই একমাত্র উপায়। প্রত্যেকে চাইলে আরও সৃজনশীল এবং অর্থপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করতে পারে।'
হংকং-এ কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে সহিংস প্রতিবাদের মুখে শনিবার (১৫ জুন) বেইজিং সমর্থিত হংকং এর প্রধান নির্বাহী ক্যারি ল্যাম বহিঃ-সমর্পণ আইন স্থগিত করতে বাধ্য হন। তবে কবে নাগাদ নতুন আইন প্রণয়ন করা হবে বা আইনটি সংস্কার করা হবে- সে বিষয়ে হংকং কর্তৃপক্ষ কিছুই জানায় নি। তবে বিক্ষোভকারীদের দাবি, আইনটি রদ না করা পর্যন্ত তারা তাদের বিক্ষোভ চালিয়ে যাবে।
সূত্র : বিবিসি