এশিয়ার বৃহত্তম ধারাভি বস্তিতে করোনা প্রতিষেধকের পরীক্ষায় ভারত

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: এপ্রিল ২০, ২০২০, ১১:১১ পিএম এশিয়ার বৃহত্তম ধারাভি বস্তিতে করোনা প্রতিষেধকের পরীক্ষায় ভারত

ভারতের মুম্বাই শহরবর্তী এশিয়ার বৃহত্তম ধারাভি বস্তির হাজারও মানুষের মাঝে করোনা চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাউড্রোক্সিক্লোরোকুইনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেদেশের সরকার।বিশ্বে করোনার চিকিৎসার জন্য এখনও এই ওষুধটি চূড়ান্ত অনুমোদন না পেলেও ভারতই প্রথম দেশ হিসাবে গণহারে প্রয়োগ করে পরীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এশিয়ার বৃহত্তম মুম্বাইয়ের ধারাভি বস্তিতে ১০ লাখের বেশি মানুষের বসবাস। এই বস্তির প্রতি বর্গকিলোমিটারে মানুষের ঘনত্ব ২ লাখ ৮০ হাজার; যা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের চেয়ে তিনগুণ বেশি।

গ্রেটার মুম্বাই পৌর করপোরেশনের অতিরিক্ত কমিশনার সুরেশ কাকানি বলেছেন, শহরের কর্মকর্তারা বস্তির নির্দিষ্টসংখ্যক মানুষকে বাছাই করছেন; যারা হাউড্রোক্সিক্লোরোকুইন নেবেন। তবে ওষুধের মাত্রার ব্যাপারে মেডিক্যাল বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ করছেন। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

বিশ্বজুড়ে প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ২৪ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এক লাখ ৬৫ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া এই ভাইরাস প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। যা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা প্রচণ্ড চাপের মুখে আছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের ৭০টির বেশি ভ্যাকসিন এবং ওষুধ তৈরি নিয়ে কাজ করছেন। তবে এসব ওষুধের চূড়ান্ত ফল এবং অনুমোদনের জন্য অন্তত এক থেকে দেড় বছর অপেক্ষা করতে হবে।

কিন্তু তার আগেই চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রে ম্যালেরিয়ানিরোধী ওষুধ হাউড্রোক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহার করা হয়েছে। কয়েকটি দেশ করোনার চিকিৎসায় হাউড্রোক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহার করে ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে। এক দশকের পুরনো এই ওষুধটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছুসংখ্যক রোগীকে দেয়া হচ্ছে জানিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, করোনার চিকিৎসায় এই ওষুধটি হতে পারে গেইম চেঞ্জার। তবে বেশ কিছু গবেষণায় ওষুধটি করোনা রোগীদের প্রয়োগের পর নেতিবাচক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে বলেও জানানো হয়েছে।

মুম্বাইয়ের অতিরিক্ত কমিশনার সুরেশ কাকানি বলেছেন, আমাদের কাছে একমাত্র সহজলভ্য বিষয় এটি; বিশ্ব মহামারির লড়াইয়ের কিছু জবাব এখান থেকে পাওয়া যেতে পারে। আমরা এই ওষুধটি প্রয়োগের আগে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো বোঝার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।

ভারতে এখন পর্যন্ত ১৭ হাজারের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন; যাদের এক দশমাংশ মুম্বাইয়ের। এছাড়া দেশটিতে পাঁচ শতাধিক মানুষের প্রাণ কেড়েছে করোনা। যাদের এক চুতর্থাংশ এই মুম্বাইয়ের। দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত মুম্বাই করোনার হটস্পটে পরিণত হয়েছে। সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হলেও সোমবার থেকে মুম্বাইয়ের বেশ কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও কল-কারখানা চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এশিয়ার বৃহত্তম এবং অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ ধারাভি বস্তি মুম্বাইয়ে। এই বস্তিতে সবচেয়ে বেশি করোনার সংক্রমণ ঘটেছে। বস্তির দুটি অংশের মানুষের মাঝে করোনা প্রতিরোধের জন্য হাউড্রোক্সিক্লোরোকুইন প্রয়োগের পরিকল্পনা করেছেন কর্মকর্তারা। করোনা আক্রান্ত নন; এমন মানুষকেও এই ওষুধটি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

যদিও পূর্ব-প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কিংবা করোনা আক্রান্ত রোগীর শরীরে এই ওষুধটি পুরোপুরি কাজ করে কিনা সেব্যাপারে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত বৈজ্ঞানিক মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্সের অ্যাকটিভিস্ট নয়াদিল্লির চিকিৎসক লীনা মেংহানি বলেন, হটস্পটগুলোতে করোনার সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য হাউড্রোক্সিক্লোরোকুইনের প্রয়োগের ব্যাপারে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক নথি নেই। এই পদ্ধতি মানুষকে সুরক্ষা দেয় বলে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণাও প্রকাশিত হয়নি। রোগ ছাড়াই কারো শরীরে এটি প্রয়োগ করা হলে তা উপকারের চেয়ে সম্ভাব্য ঝুঁকির সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে।

অনেক বেশি অনিশ্চয়তা

লীনা মেংহানি বলেন, ফ্রান্সে এই ওষুধটি প্রয়োগের পর অনেক রোগীর হৃদযন্ত্রের সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে এই ওষুধটি যদি দীর্ঘ ডোজে প্রয়োগ করা হয় অথবা অন্য ওষুধের পাশাপাশি এটি দেয়া হয়; সেই সময় হার্টের সমস্যা হচ্ছে। করেনোভাইরাস প্রাদুর্ভাবের লড়াইয়ে জনস্বাস্থ্যের জন্য এই ওষুধটি সহায়ক অথবা ফলপ্রসূ হবে কিনা- সেটি নিয়ে প্রচুর অনিশ্চয়তা রয়েছে।

চীনের একটি গবেষণা বলছে, এই ভাইরাসটি একেবারে নির্মূল করার জন্য ম্যালেরিয়ারোধী হাউড্রোক্সিক্লোরোকুইন কাজ করেনি। এমনকি ওষুধটি প্রয়োগের পর তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

এতে আরও বলা হয়েছে, হাউড্রোক্সিক্লোরোকুইনের গ্রহণের পর চীনের ওই রোগীদের মাঝে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি ছিল। যদিও তাদের মাঝে করোনার উপসর্গ ছিল মৃদু। তবে হাউড্রোক্সিক্লোরোকুইন প্রয়োগের কারণে অধিকাংশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যে সমস্যাটি হয়েছিল; সেটি হলো ডায়রিয়া।

হাউড্রোক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে যখন এমন উদ্বেগজনক ও মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে; তখন মুম্বাইয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা সতর্কতার সঙ্গে বিষয়টি পর্যালোচনা করছেন।

মুম্বাইয়ের কমিশনার সুরেশ কাকানি সেখানকার বস্তিবাসীদের শরীরে ওষুধটির প্রয়োগ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি বলেন, মূল পরিকল্পনা হচ্ছে ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়সী মানুষ; যাদের আগে থেকে লিভার অথবা হার্টের সমস্যা নেই তাদের মাঝে হাউড্রোক্সিক্লোরোকুইনের ৫০ হাজার ডোজ প্রয়োগ করা হবে। কিন্তু এত বিশালসংখ্যক ডোজ প্রয়োগ এবং নজরদারি করা চ্যালেঞ্জিং হবে জেনে বর্তমানে সংখ্যাটি কমিয়ে আনা হয়েছে। শুধুমাত্র যারা ওষুধটি নিতে আগ্রহী তাদেরকেই প্রয়োগ করা হবে।

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া শনাক্তকরণ

সরকারের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য মুম্বাইয়ের সাড়ে চার হাজার স্বাস্থ্য কর্মীকে সেখানে মোতায়েন করা হবে। ওষধুটি প্রয়োগের মেয়াদকালে বস্তির ২৫ থেকে ৩০টি বাড়িতে প্রত্যেকদিন ট্র্যাকিং কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। সেখানে কারও শরীরে ওষুধটি প্রয়োগের পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায় কিনা সেটি নজরদারি করবেন স্বাস্থ্য কর্মীরা।

ধারাভি এবং ওরলি বস্তিতে উচ্চ-ঝুঁকিসম্পন্ন রোগীদের জন্য কোয়ারেন্টাইন জোন তৈরি করা হয়েছে। আমরা এই রোগীদের ১৪ দিনের জন্য পর্যবেক্ষণ করবো।

সূত্র: ব্লুমবার্গ

এসকে

আরও সংবাদ