ভয়াবহ ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্টি বিপর্যয়ে এশিয়া-ইউরোপের মিলনভূমি তুরস্ক যেন মৃত্যুপুরী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। আহতদের যন্ত্রনা আর স্বজন হারানোর আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠছে দেশটির সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল।
সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) ভোরে হওয়া ভয়াবহ ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত শুধু তুরস্কেই মৃতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আহতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার। তাদের অনেকেরই অবস্থা গুরুতর। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছেন অনেকে। ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। সর্বশেষ মৃতের সংখ্যা ২৩০০ ছাড়িয়ে গেছে জানিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
সিরিয়া মৃতের সংখ্যা চারশ’ ছাড়িয়েছে। এই সংখ্যা সিরিয়ার সরকার নিয়ন্ত্রিত অংশ আর বিদ্রোহীদের হাতে থাকা অংশে মৃতের সংখ্যা এক করে দেয়া হচ্ছে কিনা, সেটি এখনও স্পষ্ট নয়। ফলে তুরস্ক ও সিরিয়ায় মৃতের মোট সংখ্যা নিয়ে একটি ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে।
ভোররাতের ভয়াবহ ভূমিকম্পে তুরস্ক-সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অংশ কার্যত ধ্বংসপুরীতে পরিণত হয়েছে। মাটিতে গুড়িয়ে গেছে অসংখ্য বহুতল ভবন। ঘুমের মধ্যেই ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়েছেন বেশিরভাগ মানুষ। কম্পনের সময় নিরাপদ স্থানে বেরিয়ে আসার সময়টুকু পাননি তারা।
স্থানীয় সময় সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে এই ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল সিরিয়া সীমান্তবর্তী তুরস্কের গাজিয়ানতেপ শহরে। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮। প্রায় ৮৪ বছর পর এমন শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে তুরস্ক। দুই দেশেই হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রথম কম্পনের ১১ থেকে ১৫ মিনিটের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার কেঁপে ওঠে লেবানন, সিরিয়া এবং সাইপ্রাসের বিভিন্ন অংশ। ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস)-র মতে, এই কম্পনের তীব্রতা ছিল ৬.৭। প্রায় দেড় মিনিট পর্যন্ত তার কম্পন অনুভূত হয়।
কম্পনের জেরে হুড়মুড়িয়ে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে থাকে একের পর এক বহুতল এবং বাড়ি। সেই বাড়িগুলোর নীচে চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছে বহু মানুষের। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তুরস্ক ও সিরিয়ার বহু শহর এখন শুধুই ধ্বংসপুরী।
ভূমিকম্প বিধ্বস্ত দুই দেশের হাসপাতালগুলোতে উপচে পড়ছে মৃতদেহ। চারিদিকে শুধু কান্নার রব উঠেছে। শোকের মাতমে ভারি হচ্ছে আকাম। এক দিন আগেও যেগুলো বহুতল ছিলো, সোমবারের ভূমিকম্পের পর তা কংক্রিট এবং স্টিলের রডের ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
ভূকম্পের পরে বিপর্যয় মোকাবিলা সংস্থার কর্মী এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছাতে শুরু করেন। শুরু হয় বিরামহীন উদ্ধার অভিযান। এ কাজে যোগ দেয় তুর্কি সেনাদলও। ধ্বংসস্তূপ সরানো শুরু হতেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।
এবার ভূমিকম্প ফিরিয়ে আনছে ১৯৯৯ সালের স্মৃতি। সেবার ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল তুরস্ক। মৃতের সংখ্যা ১৭ হাজার ছুঁয়েছিলো। এবারের বিপর্যয়ে শেষ পর্যন্ত হতাহতের সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না।
ধ্বংসস্তূপের নীচে কত মানুষ চাপা পড়ে রয়েছেন, এখনও তার হিসেব নেই। ফলে হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়বে, এমন আশঙ্কা প্রবল। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে ধ্বংসস্তূপের নিচ থাকা জীবত ও হতাহতের উদ্ধার করা।
ভূমিকম্পের ফলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তুরস্ক এবং সিরিয়া। উদ্ধার হচ্ছে একের পর এক মৃতদেহ। কোনও কোনও পরিবারে সকল সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। শোকপালন করবেন বলেও আত্মীয়-পরিজন নেই অনেকের। ধ্বংসস্তূপের নিচে বহু মানুষ আটকে রয়েছেন বলে আশঙ্কা।
গাজিয়ানতেপ প্রদেশের গভর্নর দাভুট গুল টুইটারে শোকপ্রকাশ করে লিখেছেন, আমাদের শহরে তীব্র ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। আপনারা শান্ত থাকুন। বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করুন। এই পরিস্থিতিতে গাড়ি চালাবেন না। দয়া করে রাস্তায় ভিড় করবেন না।
ইস্তানবুলের গভর্নর আলি ইয়েরলিকায়া জানিয়েছেন, উদ্ধারকার্যের জন্য এখনও পর্যন্ত এক হাজার কর্মীকে কাজে লাগানো হয়েছে। প্রয়োজনে তাঁদের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন সেনা ইউনিটকেও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
উদ্ধার কাজে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আবহাওয়া পরিস্থিতিও। একদিকে ঠান্ডা আবহাওয়া। তার উপর মাঝেমধ্যেই বৃষ্টি পড়ছে। চাষবাসের ক্ষয়ক্ষতি তো হচ্ছেই। এই পরিস্থিতিতে শহরের লোকেরা কী ভাবে দিনযাপন করবেন, তা নিয়েই চিন্তার ভাঁজ পড়ছে স্থানীয় প্রশাসকদের।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, তুরস্কে ৯১২ জন নিহত, পাঁচ হাজার ৩৮৩ জন আহত এবং দুই হাজার ৮১৮টি ভবন ধসে পড়েছে। অনুসন্ধান ও উদ্ধারকাজ চলতে থাকায় নিহতের সংখ্যা কত বাড়বে তা অনুমান করতে পারছি না।
তুরস্কের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতায় বলেছেন, চরম বিরূপ আবহাওয়ার কারণে কর্তৃপক্ষ হিমশিম খাচ্ছে। তীব্র শীতল আবহাওয়ার কারণে পরিস্থিতি খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। চারদিকে তুষার ও বৃষ্টি, সঙ্গে তীব্র শীত। আবহাওয়ার পরিস্থিতি ও জলবায়ু উদ্ধারকর্মী ও বেসামরিকদের জন্য পরিস্থিতি কঠিন করে তুলেছে। এই বিরূপ আবহাওয়াই সবার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
ভূমিকম্পের পর হতে শীতের মধ্যে অনেক মানুষ বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। তারা অপেক্ষায় আছেন মসজিদের দরজা খুললে তারা হিমশীতল আবহাওয়া থেকে ভেতরে আশ্রয় নেবেন। অনেক মানুষ ভবনের ভেতরেও নিরাপদবোধ করছেন না। পুরো রাস্তা গাড়িতে ভরে গেছে। মানুষ গাড়ির ভেতর বসে আছেন। এমন দৃশ্যপটতে দুঃস্বপ্নের মতো উল্লেখ করেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
ভূম্পিকম্পটি রাজধানী আঙ্কারা এবং তুরস্কের অন্যান্য শহরেও অনুভূত হয়েছে। এছাড়া, সংশ্লিষ্ট পুরো অঞ্চল জুড়েই কম্পন অনুভূত হয়েছে। তুরস্কের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সুলেইমন সইলু বলেন, ১০টি শহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে গাজিয়ানতেপ, কাহরামানমারাস, হাতায়, ওসমানিয়ে, আদিয়ামান, মালাতিয়া, সানলিউরফা, আদানা, দিয়ারবাকির এবং কিলিস।
প্রতিবেশি দেশ সিরিয়া, লেবানন, ফিলিন্তিন, ইসরাইল এবং সাইপ্রাসেও কম্পন অনুভূত হয়েছে। সিরিয়ার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হচ্ছে আলেপ্পো, লাতাকিয়া, হামা ও তারতুস প্রদেশ। এসবের মধ্যে আবার কিছু কিছু এলাকা বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণেও রয়েছে।
সিরিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলীয় শহর লাতাকিয়া থেকে শুরু করে ভূমিকম্পটি দক্ষিণে রাজধানী দামেস্ক পর্যন্ত অনুভূত হয়েছে। তুরস্ক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে উদ্ধারকারীদের পরস্পরের মধ্যে সমন্বয়ে সহায়তা করতে জনসাধারণকে মোবাইল ফোন ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়েছে।
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক, লেবাননের রাজধানী বৈরুত এবং বন্দর শহর ত্রিপোলিতে ভূমিকম্পের কারণে লোকজন দৌঁড়ে রাস্তায় বের হয়ে যায়, তাদের ভবনগুলো ধসে পড়তে পারে আশঙ্কায় কেউ কেউ নিজেদের গাড়ি সেখান থেকে সরিয়ে নেয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
তুরস্কের মানুষ ভূমিকম্পের সঙ্গে বেশ পরিচিত। মূলত ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে তুরস্ক এতটা ভূমিকম্পপ্রবণ। এর পিছনে রয়েছে টেকটোনিক প্লেট। তুরস্কের মূল অবস্থান আনাতোলিয়ান টেকটোনিক প্লেটের ওপর।
এছাড়াও দেশটির কিছুটা অংশ রয়েছে ইউরেশিয়ান আর আফ্রিকান টেকটোনিক প্লেটের উপর। পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে অ্যারাবিয়ান প্লেট।
তবে সব থেকে ভয়ের হল, টেকটোনিক প্লেটের সংযোগ স্থল উত্তর আনাতোলিয়ান ফল্ট লাইন। যেখানে রয়েছে তুরস্কের উত্তরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। যত বার তুরস্ক ভয়াবহ ভূমিকম্পের মুখোমুখি হয়েছে তার পিছনে অন্যতম কারণ হলো এই ফল্ট লাইনের বিচ্যুতি।এপি, বিবিসি, রয়টার্স, গার্ডিয়ান, আল জাজিরা ও সিএনএন।
জাগরণ/আন্তর্জাতিক/কেএপি/এসএসকে