হামাসের সাম্প্রতিক চতুর্মুখী আক্রমণ ইসরায়েলকে তো বটেই, পুরো বিশ্বকে হতবিহ্বল করে দিয়েছে। ড্রোন দিয়ে সীমান্ত নজরদারি অকেজো করা এবং ঝাঁকে ঝাঁকে রকেট ছোড়ার পাশাপাশি প্যারাগ্লাইডারে আকাশপথে ও সীমান্ত ডিঙিয়ে ইসরায়েলে ঢুকে সাঁড়াশি হামলা চালায় হামাস যোদ্ধারা। এরপর থেকেই আলোচনা চলছে ইসরায়েলের মতো বিপুল সামরিক শক্তিধর একটি দেশের কড়া নজরদারি এড়িয়ে তারা কীভাবে এতটা পরিকল্পিত হামলা চালাল। তা ছাড়া সংগঠনটি এত অস্ত্র, গোলাবারুদই বা পেল কোথায়– তা নিয়েও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিজেদের বুদ্ধিমত্তা, কৌশল ও বিদেশি বন্ধুর সহায়তায় এটি সম্ভব হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইরান তাদের পরামর্শদাতা ছিল।
হামাসের হামলায় ইসরায়েলে ১২শর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। দেড় শতাধিক সামরিক-বেসামরিক মানুষকে জিম্মি করেছে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। এর প্রতিক্রিয়ায় গাজায় লাগাতার বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত ৩৬০ বর্গকিলোমিটার দীর্ঘ গাজা উপত্যকা থেকেই মূলত এ হামলা চালানো হয়। গাজার দু’পাশে ইসরায়েল ও অন্যপাশে মিসরের সীমান্ত। তা ছাড়া প্রায় ১৭ বছর ধরে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে গাজা। আকাশ ও নৌপথ অবরুদ্ধ করে রেখেছে ইসরায়েল। তা সত্ত্বেও হামাসের হামলায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুকের বরাত দিয়ে সিএনএন জানায়, হামাস স্থানীয়ভাবে অস্ত্র উৎপাদন করে ও বাইরে থেকে নিয়ে আসে। তারা ইরানের কাছ থেকেও কিছু সামরিক সহায়তা পায়। তবে সর্বশেষ হামলার সঙ্গে ইরানের সরাসরি সংযোগ থাকার কোনো প্রমাণ পায়নি ইসরায়েল ও মার্কিন সরকার। ইরানও এ ধরনের দাবি অস্বীকার করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হামাসের বড় আকারের সুড়ঙ্গ অবকাঠামো রয়েছে। ইরান দীর্ঘদিন ধরেই হামাসের মূল সামরিক সহায়তাদানকারী। দেশটি থেকে আন্তঃসীমান্ত গোপন সুড়ঙ্গ ও ভূমধ্যসাগরের অবরোধ এড়িয়ে যেতে সক্ষম নৌযানের মাধ্যমে হামাস অস্ত্র নিয়ে আসে। এর মধ্যে দূরপাল্লার অস্ত্রও থাকে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক চার্লস লিসটার বলেন, ইরান হামাসকে সমুদ্রপথে আরও আধুনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পাঠায়। এ ছাড়া গাজায় অস্ত্র উৎপাদনের জন্য উপকরণও পাঠায় তারা। দেশটির ইসলামিক বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী প্রায় দুই বছর ধরে হামাসের প্রকৌশলীদের অস্ত্রবিষয়ক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ফলে হামাসের প্রকৌশলীরা তাদের অস্ত্র উৎপাদনকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যেতে পেরেছেন।
ইসরায়েলে হামলার এক দিন পর লেবাননে হামাসের একজন শীর্ষ নেতা আরটিঅ্যারাবিক নিউজ চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্থানীয়ভাবে অস্ত্র উৎপাদনের তথ্য নিশ্চিত করেন। বিদেশে হামাসের জাতীয় সম্পর্ক বিভাগের প্রধান আলি বারাকা বলেন, আমরা প্রচুর গোলাবারুদ তৈরি করেছি। স্থানীয়ভাবে আমাদের সবকিছুর কারখানাই আছে। এসব কারখানায় ১০ থেকে ২৫০ কিলোমিটার পাল্লার রকেট ছাড়াও মর্টার ও মর্টারশেল তৈরি করা হয়। এ ছাড়া কারখানাগুলোয় বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রও তৈরি হচ্ছে।
আলি বারাকা বলেন, আমাদের কালাশনিকভ রাইফেল ও এর বুলেট তৈরির কারখানা আছে। রাশিয়ার অনুমোদন নিয়েই আমরা এসব বুলেট তৈরি করছি।
গাজায় এমন কোনো ভারী শিল্পকারখানা নেই, যা অস্ত্র উৎপাদনে সহায়তা করবে। এ অঞ্চলের মূল শিল্প হলো পোশাক, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও আসবাব। তবে এ অঞ্চলের প্রধান রপ্তানি পণ্য স্ক্র্যাপ লোহা। এটি থেকেই সুড়ঙ্গ অবকাঠামোর নিচে অস্ত্র উৎপাদন করা সম্ভব। এ ছাড়া ইসরায়েলের বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবন থেকে পাওয়া লোহা, ইস্পাত, ধাতব পাইপ, বৈদ্যুতিক তার ও অন্যান্য উপকরণ হামাসের অস্ত্র নির্মাণের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এভাবে রিসাইকেল করে অস্ত্রের মজুত গড়ে তুলছে হামাস।
জাগরণ/আন্তর্জাতিক/ফিলিস্তিনইসরায়েলযুদ্ধ/এসএসকে