‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মানসম্মত চর্চা দেখি না’: মহিউদ্দিন আহমদ

শাওন আখতার সৌরভ প্রকাশিত: মার্চ ১৭, ২০২১, ০৩:০৬ পিএম ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মানসম্মত চর্চা দেখি না’: মহিউদ্দিন আহমদ

লেখক, গবেষক, মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন আহমদ। তাঁর লেখা বইগুলো বিষয়ভিত্তিক গবেষণাগ্রন্থ, যেগুলোতে লেখক নিজের বিশ্লেষণী জ্ঞান কাজে লাগিয়ে কোনো একটি বিষয়ের গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান করেছেন, তার সাথে জড়িতদের থেকে তথ্য নিয়েছেন, মিডিয়া গবেষণা করেছেন এবং বিস্তর তথ্য ঘেঁটে সবচেয়ে প্রামাণ্য তথ্যটুকুই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ‘জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি’, ‘বিএনপি: সময়-অসময়’, ‘আওয়ামী লীগের উত্থানপর্ব: ১৯৪৮-১৯৭০’, ‘আওয়ামী লীগ : যুদ্ধদিনের কথা’, ‘এই দেশে একদিন যুদ্ধ হয়েছিল’,‘এক এগারো (বাংলাদেশ ২০০৭-২০০৮)’, ‘বেলা-অবেলা : বাংলাদেশ ১৯৭২-১৯৭৫’, ‘৩২ নম্বর পাশের বাড়ি: ২৫ মার্চ ১৫ আগস্ট’, ‘প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান’ তাঁর লেখা আলোচিত বই। 

১৯৫২ সালে ঢাকায় মহিউদ্দিন আহমদের জন্ম। শিক্ষাজীবনে জড়িত ছিলেন ছাত্ররাজনীতির সঙ্গেও। ১৯৭০ সালের ডাকসু নির্বাচনে মুহসীন হল থেকে সহসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরের বছর মুক্তিযুদ্ধে তিনি ‘বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট’-এর হয়ে যুদ্ধে অংশ নেন। বঙ্গবন্ধু ও সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে জাগরণ অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেন এই রাজনৈতিক গবেষক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাওন আখতার সৌরভ


জাগরণ : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজ জন্মশতবর্ষ পালিত হচ্ছে। তাঁকে নিয়ে কি কোনো স্মৃতি আছে আপনার?

মহিউদ্দিন আহমদ : না, ওনাকে নিয়ে আমার স্মৃতি খুব কম। আমি ওনাকে প্রথম দেখি যখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। এটা সিক্সটি ফোরে। তখন ইউনিয়ন পরিষদ ইলেকশন হবে, ইউনিয়ন কাউন্সিল পরিষদ হবে, প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে ভোট দেবে বিডি মেম্বাররা তখন ওই সময় লালমাটিয়াতে খোলা জায়গায় মধ্যে তখন এত বাড়িঘর হয়নি। মিটিং ডাকলেন, পাবলিক মিটিং। উনি ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ আর ফরিদ আহমেদ ছিলেন। সেখানে আমি তাঁকে প্রথম দেখি, সন্ধ্যার পরে হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে মিটিংটা হয়েছিল। এই প্রথম তাঁকে দেখা। এরপরে সামনাসামনি অনেকবার দেখেছি, সেটা হচ্ছে আওয়ামী লীগ অফিসে। তখন ওই ’৭১-এর শুরুর দিকে সন্ধ্যার পরে আওয়ামী লীগ অফিসে পুরানা পল্টনে আমি নিয়মিত যেতাম। এবং সেখানে ঘরের আমাদের বন্ধু ছিল রায়হান শিকদার শাহেদিন। উনি ছিলেন আমিনুল হক বাদশা যে সেক্টরে, সেই সেক্টরের সহকারী। বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিতে যেতাম। সেখানে সিনিয়র ভাই মণি ভাই, কে এম ওবায়দুর রহমান ও আমিনুল হক বাদশা ছিলেন, তারা একই ঘরে আড্ডা দিতেন। সেখানে মাঝে মাঝে যেতাম, তখন বঙ্গবন্ধুকে অনেকবার দেখেছি। তিনি একটা কামরায় আসতেন, যে কামরাটায় চৌকাঠে একটা ছাপানো টাইপের একটা লেখা ছিল ‘নেতার ঘর’ আমার স্পষ্ট মনে আছে। তো এই ঘরটাতে যেতে হতো, যে ঘরের ভেতর বসতেন তাজউদ্দীন আহমদ। ওখান দিয়ে এত কড়াকড়ি ছিল না, ওখান দিয়ে অনেকে যেত, মাঝে মাঝে আমরাও যেতাম। খুব ইনফরমাল টাইপের ছিলেন উনি। দেখলে গাল টিপে দেওয়া এগুলো উনি করতেন। যাহোক, তারপরে ওই নির্বাচন ৭ ডিসেম্বর ’৭০-এর নির্বাচন হবে। সন্ধ্যার পর উনি বসে বসে রেডিওতে শুনছিলেন যে আওয়ামী লীগ অফিসে তখন অনেকেই এসছিলেন, ভিড় ছিল। ওর মধ্যে ওকে দিয়ে আমিও দেখলাম বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, কে কী বলছে। এই কথাগুলো আমি আমার ‘এই দেশে একদিন যুদ্ধ হয়েছিল’ এই বইয়ে আমি লিখেছি। ওভাবে দেখেছি আরকি। এর পরে তো আর দেখা হয়নি। বাংলাদশ স্বাধীন হওয়ার পর কয়েকবার দেখেছি। তাকে খুব কাছে থেকে দেখলাম ’৭১-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রমনার বটমূলে ওখানে একটি পুনর্মিলনী ছিল ছাত্রলীগের। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বিশেষ অতিথি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামাল হোসেন আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মুজাফফর আহমেদ। তো, এঁরা বক্তৃতা দিলেন, বঙ্গবন্ধুও বক্তৃতা দিলেন। ওই দিন আমরা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ শোডাউন করলাম। একদল বলে, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/বাংলাদেশ স্বাধীন করো। আরেক দল স্লোগান দেয়, বঙ্গবন্ধুর মন্ত্র গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এগুলো। মানে বোঝা গেল যে একটা খুব নরম স্লোগান আরেকটা খুব গরম স্লোগান। স্লোগান প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণটি দিলেন তিনি ওই প্রসঙ্গটি একেবারে এড়িয়ে যান। এবং আমার মনে আছে, এর আগে রেসকোর্সের দুইটা পাবলিক মিটিং ৭ জুন ১৯৭০ এবং ৩ জানুয়ারি ১৯৭১। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শপথ করাবেন। এই দুইটা মিটিংয়েই উনি জয় বাংলা, জয় পাঞ্জাব, জয় পাকিস্তান এগুলো বলেছেন। কিন্তু একাত্তরের ৪ জানুয়ারি রমনার বটমূলে ওই দিন উনি জয় পাকিস্তান বলেননি জয় বাংলা বলে বক্তৃতা শেষ করেন। এটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। এরপরই পরের দিনের পত্রিকাতে এটা পাওয়া যায়। উনি খুব ডেলিবারেটলি জয় পাকিস্তান বলেন। এবং আমার জানামতে এরপর আর কোনো দিনই বলেননি। 

জাগরণ : ষাট ও সত্তরের দশকে রাজনীতির অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। এই সময়ের ভেতর বঙ্গবন্ধুর কোনো চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন দেখেছেন কি?

মহিউদ্দিন : ’৬৪ সালে আমি গেছি কৌতূহল থেকে। সন্ধ্যার পরে যখন আমার কোনো কাজ ছিল না, পাড়ার কিছু ছেলেপেলে আমরা তখন মোহাম্মদপুরে থাকতাম। ঘুরতে ঘুরতে গেলাম, আমরা তখন চিনতামও না তাদের। তো পত্রিকায় শেখ মুজিবের ছবিটবি দেখতাম, তখন তো ইত্তেফাক পড়তাম। বাসায় রাখত। ছবি দেখে চেনা যায়। তাজউদ্দীন আহমদ ও মৌলভি ফরিদ আহমেদ তাদেরকে চেনা তো দূরের কথা, নামও আমি জানতাম না। ওই প্রথম দেখি, ওই সময় কোনো ইনফ্লুয়েন্স হয়নি। এবং আমি যে স্কুলে পড়তাম ল্যাবরেটির স্কুলে ওখানে কোনো পলিটিকস ছিল না। সুতরাং ওই সময় ওই অ্যাওয়্যারনেসটাই ছিল না।

জাগরণ : ষাটের দশক তো খুব উত্তাল ছিল, কিন্তু আপনাদের তখন রাজনৈতিক সচেতনতা সেভাবে ছিল না, বয়সের কারণে। 

মহিউদ্দিন : বক্তৃতা শুনেছি, শেখ মুজিব খুব সংক্ষেপে বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং তাঁর বক্তৃতার প্যাটার্নটা ছিল খুবই নির্ভার, কোনো চিন্তা নেই। আমার মনে আছে, উনি বলছেন যে আগামীকাল বা পরশু ভোট আছে। আপনারা কোনো চিন্তাভাবনা করেবেন না। আপনার সবাই যাবেন, গিয়ে ভোট দিয়ে চলে আসবেন। আমাদের ক্যান্ডিডেট জিতবে। চিন্তার কোনো কারণ নেই। এই কথাটা আমার মনে আছে। এটাই হয়েছিল। বিডি মেম্বার ইলেকশনে ঢাকা ডিভিশন এবং চিটাগাং ডিভিশন দুইটা ডিভিশনে বিরোধী দলের সমর্থকরা বেশি জিতেছিলেন। এবং ফাতিমা জিন্নাহও পরে প্রেসিডেনশিয়াল ইলেকশনে আইয়ুব খানের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিলেন এটা মনে আছে আর ঢাকা কলেজে পড়ার সময় আমি আস্তে আস্তে পলিটিকসের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছি, তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার খবর প্রতিদিন আসত পত্রিকায়। তারপর উনসত্তরের আন্দোলনে...তখন অন্য রকম। ওটা আর আগের মতো নয়। আগেরটা ছিল একেবারে জাস্ট একটা অবজারভার বলতে পারেন। এর মধ্যে অবশ্যই অনেক ডিফারেন্স, এর মধ্যে একটা রাজনৈতিক মত কিছুটা তৈরি হয়ে গেছে এটুকু বলা যায় আরকি, তখনো ততটা ক্রিস্টালাইজড না। ক্রিস্টালাইজড হওয়া শুরু হলো ৬৯-এর আন্দোলনের সময় এবং তারপর। যখন আমি ছাত্রলীগ করা শুরু করলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। 

আরও মনে আছে, সত্তর সালের মার্চের। সম্ভবত ২০-২১ মার্চ, ইকবাল হলের মাঠে ছাত্রলীগের কাউন্সিল মিটিং হচ্ছিল প্যান্ডেল করে। প্রধান অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উনি বক্তৃতা দিতে উঠলেন। দুই তিন লাইন বলার পরে হইচই শুরু হলো ডেলিগেটদের মধ্যে। কী ব্যাপার? কয় না না না, বন্ধ করতে হবে কুরআন তেলাওয়াত হয় নাই। কুরআন তেলাওয়াতের জন্য বন্ধ করতে হবে? বঙ্গবন্ধু বুঝলেন, তিনি চুপচাপ বসে গেলেন। একজনকে ধরে এনে সূরা পড়ানো হলো। কুরআন তেলাওয়াত হলো। এরপর উনি আবার বক্তৃতা শুরু করলেন। 

জাগরণ : আপনি তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে এখন একটি বই লিখেছেন। এই বইতে আপনি কোন বিষয়টির ওপর জোর দিচ্ছেন?

মহিউদ্দিন : লিখিনি। আমি লিখব, এই মুজিব বর্ষের ডামাডোল শেষ হলে। এখনো কোনো কিছু ঠিক করিনি। অন্যরা যা লিখছে আমি এগুলো লিখব না। আর আমি ক্রোড়পত্রও লিখব না। এখন শত শত বই লেখা হচ্ছে, আমার ধারণা এগুলো টিকবে না। আমি এমন বই লিখব যেটা সবাই পড়বে।

জাগরণ : সবাই পড়বে মানে কোন দিকটাকে ফোকাস করতে চাইছেন?

মহিউদ্দিন : যে শেখ মুজিবকে দেশের মানুষ জানে না, চিনে না। যে জিনিসটা তার দলের লোকরা হাইলাইট করে না এই জিনিসগুলো। মানবিক শেখ মুজিব বা বলতে পারেন যে, তার পলিটিক্যাল ওয়েট। প্রেস নোটের ভাষায় যেগুলো আসে এগুলো না আরকি।

জাগরণ : কবে নাগাদ এটা শুরু করতে চান?

মহিউদ্দিন : আমি এটা শুরু করতে করতে আরও কয়েক মাস লাগবে। আমি চিন্তাভাবনা করছি। মনের মধ্যে একটা ফ্রেম তৈরি হতে হয়। মৌমাছি যেমন ফ্রেম ছাড়াই মৌচাক বানানো শুরু করে না। আর্কিটেক্ট যখন বিল্ডিংয়ের ডিজাইন করে সে কিন্তু অনেক আঁকাআঁকি করে। তারপরে একটা জায়গায় যায়, তারপরে সেটা দেন তখন তার ওপরে ইট বালু সিমেন্ট ছড়ায়। তো, আমি এখন কীভাবে লিখব সেটা চিন্তাভাবনা করছি। এটা যখন একটা কগনিটিভ স্টেজে আসবে তখন লেখা শুরু করে দেব। 

জাগরণ : এই যে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ বা স্বাধীনতার দর্শন—বর্তমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কি এটা ধারণ করতে পারছে বলে আপনি মনে করেন?

মহিউদ্দিন : এটা তো একেবারে সরাসরি হ্যাঁ অথবা না বলতে হবে। আমি ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করব না। আওয়ামী লীগ যারা করেন তারা একভাবে বলবেন আর যারা আওয়ামী লীগবিরোধী তারা আরেকভাবে বলবেন। আমার কাছে এটা খুব প্রাসঙ্গিক বিষয় মনেই হয় না। এতে বঙ্গবন্ধুর কিছুই যায় আসে না।

জাগরণ : সে ক্ষেত্রে যদি বলি, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ আপনার কাছে কী মনে হয়েছে?

মহিউদ্দিন : একটা জিনিস নিয়ে আমার মাথার মধ্যে খুব ঘুরপাক খাচ্ছে। এটা যদি লিখতে পারেন তো লেখেন। সেটা হলো, বঙ্গবন্ধুর সৈনিকে দেশ এখন গিজগিজ করছে তাই না? তো আমি জানি যে আপনারাও হয়তো জানেন যে আমাদের এখানে যে নায়ক ছিল সালমান শাহ উনি মারা যাওয়ার পরে তিনজন লোক আত্মহত্যা করছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর এত সৈনিক, ১৫ আগস্ট এরা গেল কোথায়? আত্মহত্যা তো দূরের কথা। একজনকেও তো চেঁচিয়ে রাস্তায় স্লোগান দিতেও শোনা গেল না। তো এই সৈনিকেরা গেল কোথায়? আওয়ামী লীগ যখন সরকারে থাকে তখন বঙ্গবন্ধুর সৈনিকের বিশাল বিশাল বাহিনী তৈরি হয়ে যায় মানে প্রচুর। আর যখন আওয়ামী লীগ থাকে না সরকারে, তখন খুব খুব খারাপ অবস্থা, করুণ থাকে। শেখ হাসিনা যখন বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন ২০০১-২০০৬ পিরিয়ডটা। ওই সময়টাতে আমি তিনবার টুঙ্গিপাড়ায় গেছি। ওখানে আমার কাছে জয় বাংলার জায়গা মনে হতো। এখানে শ্যাওলা পড়া, এখানে যত্ন নেই। ঝাড়ু দেওয়া হয় না। এই সেই লোকজন যায় না। পাশে একটা পর্যটনের মোটেল আছে, ওটা সব সময় খালিই পড়ে থাকে। গেলেই সিট পাওয়া যায়। এই ছিল তখনকার অবস্থা। এখন দেখেন ভিড়ের ঠেলায় আপনি জায়গাই পাবেন না। এটা দিয়েই আপনি বোঝেন- হোয়াট ইজ আওয়ামী লীগ টুডে।

জাগরণ : সে হিসেবে যদি বলতে চাই যে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার দর্শনটা আপনার কাছে কেমন ছিল?

মহিউদ্দিন : এটা তো আপনাদের শেখানো কথা। স্বাধীনতার দর্শন নিয়ে উনি কথা বলেন নাই কোনো, যে এই আমার স্বাধীনতার দর্শন। এগুলো এখন আমরা ইচ্ছেমতো যার যার মনের মাধুরী মিশিয়ে বলছি, তাই না। এই সব দর্শন-টর্শন না, ব্যাপার হলো ওনার একটা ৬ দফা ছিল, এটা ছিল একটা স্বায়ত্তশাসনের এগ্রেসিভ ফর্মুলা। এ রকম তীক্ষ্ণ ফর্মুলা এর আগে ছিল না এবং ছোট। কথার পলিটিকসে আমরা করি কি, পৃথিবীর যত সমস্যা আছে সব নিয়ে আসি, ফলে আসলটা হারিয়ে যায়। ছয় দফায় মূল ফোকাসটাই ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, শুধু স্বায়ত্তশাসন না। এটা ছিল একটা কনফেডারেশনের ফর্মুলা। কনফেডারেশন হয় কিন্তু দুইটা স্বাধীন রাষ্ট্রের মাঝে। ছয় দফার মধ্যে সোভরিনিটির শর্তগুলো ছিল। এটা নিয়ে উনি এগিয়েছেন এবং যেহেতু এটা নিয়ে নির্বাচনের পরে তিনি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর কথা অনুযায়ী সংশোধন করতে রাজি হননি তখন উনি বলল যে, ক্রাইসিসটা ডেভেলপ করল এবং পাকিস্তান ভাঙল। ৬ দফাটা এমন একটা জিনিস যেটা পাকিস্তানের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। আর উনি যদি এটা কম্প্রোমাইজ করতেন তাহলে উনি আর নেতা থাকতে পারতেন না। উনি যে তার পয়েন্টে ঠিক থেকেছেন শেষ পর্যন্ত, এটাই আমি বলব। এখানে অনেকে ভালনারেবল হয়ে যান। এটার আরেকটা কারণও আছে, সত্তর সালে যে উনি যে ভোটে ম্যাচিউর ম্যান্ডেট হয়েছিলেন, এটা তাকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী করেছিল। এত ভোট যদি উনি না পেতেন তাহলে হয়তো উনি অনেক শান্ত থাকতেন। উনি অনেক আত্মবিশ্বাস দেখাতে পেরেছেন, কারণ জানেন যে ওনার পেছনে মানুষ আছে।

জাগরণ : আপনার ‘বেলা অবেলা’ বইতে বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করা আছে। এই সময়টাতে ’৭২-এর থেকে পঁচাত্তরের আগ পর্যন্ত বাকশাল কিংবা রক্ষীবাহিনী নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

মহিউদ্দিন : না, রক্ষীবাহিনীর কথা আমি বলব যে, রক্ষীবাহিনী নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। অনেক কথাবার্তা আছে। যেহেতু এখন রক্ষীবাহিনী নেই, সুতরাং এটা নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। রক্ষীবাহিনী অনেক জায়গায় বাড়াবাড়ি করেছে। অনেক কিছু করেছে। এদেরকে আওয়ামী লীগের লোকাল নেতারা নানাভাবে মিস ইউজ করেছে। তাদের দিয়ে তাদের স্বার্থ হাসিল করেছে। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট রক্ষীবাহিনীর প্রত্যেক সদস্যকে জিয়াউর রহমান আর্মিতে এডজাস্ট করে তাদের একধরনের সুরক্ষা দিয়ে দেয়।

জাগরণ : তাহলে কি বলা যায় ১৫ আগস্টের পর রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা পনুর্বাসিত হয়েছিলেন?

মহিউদ্দিন : পুনর্বাসন না। রক্ষীবাহিনী তো অবলুপ্ত হলো। তাদের সদস্যদের আর্মিতে নিয়ে নেওয়া হলো সবাইকে। রক্ষীবাহিনী করার অপরাধে কেউ চাকরি হারিয়েছে এমনটা আমি বলব না। এর ব্যাখ্যা দিতে পারবে ওই সময়ের জিয়াউর রহমানের সরকারে যারা ছিলেন তারা। আমি যত দূর জানি তাদের সেনাবাহিনীতে নিয়ে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছিল। এবং তারা অনেকেই পরবর্তী জেনারেলও হয়েছেন কেউ কেউ। এক নম্বর।
আর দুই নম্বর হচ্ছে, বাকশাল নিয়ে আমার এটা মাথায় আসে না ৩০০ আসনের পার্লামেন্টে ২৯৩ জন হচ্ছেন আওয়ামী লীগের। তারপরও কেন একদল করতে হলো, এইটার ব্যাখ্যা আমি আওয়ামী লীগের কাছে পাইনি।

জাগরণ : আমাদের বঙ্গবন্ধু নিয়ে এখন যে চর্চা হচ্ছে, যেভাবে হচ্ছে, সেখান থেকে প্রশ্ন জাগে অতিচর্চা কি মহৎ কোনো মানুষকে ছোট করে দেয় কি?

মহিউদ্দিন : না, চর্চা তো হচ্ছে না। যেগুলো হচ্ছে এটাকে চর্চা বলা যায় না। সেই হিসেবে তো বঙ্গবন্ধুকে তারা ছোট করছে অপপচর্চার কারণে। তাই না? সুতরাং মানসম্মত চর্চা তো আমি তেমন দেখি না।

জাগরণ : মানসম্মত চর্চার বিষয়টি যদি খুলে বলতেন।

মহিউদ্দিন : একটা কথা বলি আপনাকে, মনে করেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এখন যত বইটই লেখা হচ্ছে শেখ হাসিনা সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে সরকারি টাকায় এর একটা কপিও কেনা হবে না তাহলে এগুলো সের ধরে বিক্রি করতে হবে। ব্যস, এটুকুই, আমি আর কিছু বলব না।

জাগরণ : শেষ প্রশ্ন, বর্তমান আওয়ামী লীগের যে কৌশল, বর্তমান আওয়ামী লীগ যে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় আছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতিফলনটা তাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কতটুকু এসেছে বলে আপনার মনে হয়।

মহিউদ্দিন : না বঙ্গবন্ধুর প্রতিফলন বলতে গেলে বলতে হয় এখন তো সময়টা ডিফারেন্ট। এখন ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। ’৭২ সালের বা ’৭০ সালের বাস্তবতা এখন আর নেই। পরিবর্তন হতেই হবে। পরিবর্তনটাকে ভালোর দিকে যাচ্ছে না খারাপ দিকে যাচ্ছে, সেটা ভাবার বিষয়। যারা বলে যে ওই বাহাত্তর সালের ওই বিষয়টা ফিরিয়ে আনতে চাই্, ওইটা চাই। একসময় যারা আওয়ামী লীগের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সমালোচক ছিলেন, একসময় আওয়ামী লীগ করতেন। পরে শেখ মুজিবের বিরোধিতা করেছেন, তারা একই কথা বলতেন যে আমরা সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগ চাই। এগুলো হচ্ছে সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগ চাই মানে হচ্ছে শেখ মুজিব, তোমাকে আমরা চাই না। এটা ছিল এই যে আবুল মনসুর আহমদ, আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম খান, তাঁদের ভাষা। ৭২, ৭৩, ৭৪ সালে এ রকম অনেক কথা হয়েছে আরকি। এখন যারা বলে যে আমরা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ চাই। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ এখন হবে না। কারণ বঙ্গবন্ধুর সহকর্মীদের অনেকেরই ঢাকা শহরে একটা বাড়ি ছিল না। তো সে আওয়ামী লীগকে আপনি কই পাবেন, প্রশ্নই ওঠে না।