সংস্কৃতি বাধার মুখে পড়লে আন্দোলনের প্রয়োজন হয়

শাহাদাত হোসেন তৌহিদ প্রকাশিত: এপ্রিল ১৭, ২০২১, ০৮:১৩ পিএম সংস্কৃতি বাধার মুখে পড়লে আন্দোলনের প্রয়োজন হয়

খায়রুল আনাম শাকিল। সাংস্কৃতিক অঙ্গণের পরিচিত মুখ। সংগীতশিল্পী ও শিক্ষক। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। সংগীতে অবদানের জন্য ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলন, পহেলা বৈশাখ, চৈত্রসংক্রান্তিসহ নানা দিক নিয়ে জাগরণের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহাদাত হোসেন তৌহিদ


জাগরণ : চৈত্রসংক্রান্তি বা বৈশাখ নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন এটি নাকি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উৎসব। এ নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?

খায়রুল আনাম : পহেলা বৈশাখ মোঘল আমল থেকে হয়ে আসছে। এটার সঙ্গে ধর্মীয় কোনো বিষয় নেই। চৈত্রসংক্রান্তি হলো বাঙালির উৎসব। পহেলা বৈশাখে নতুন বছরকে সংগীতের মধ্য দিয়ে আমরা বরণ করে নিই। যেটা ছায়ানটে শুরু হয়েছে। পহেলা বৈশাখের ইউরোপিয়ান ভার্সন তো নিউইয়ার। নিউইয়ার আমরা উদযাপন করি। সেটা নিয়ে তো কেউ বলে না, খ্রিষ্টানদের একটা ধর্মীয় জিনিস আমরা কেন করতে যাবো? ইউরোপীয়দের নিজের নতুন বছর উদযাপনের ভঙ্গি আছে, চাইনিজদের নতুন বছর উদযাপনের একটা ভঙ্গি আছে, তেমন আমাদের বাঙালিদেরও একটা অসাধারণ ভঙ্গি রয়েছে। এটা এমন একটা রূপ নিয়েছে যে, আমরা গর্ব করে বলতে পারি—আমাদেরও একটা ভঙ্গি আছে নতুন বছর বরণ করে নেওয়ার।

পহেলা বৈশাখ উদযাপন এটা অসাধারণ ভঙ্গি। অর্থাৎ, একটা সময় হালখাতা, ছোটোখাটো কুটিরশিল্পের প্রদর্শনী, ছোটোখাটো মেলা— এগুলোর মধ্য দিয়ে উদযাপিত হতো। গ্রামগঞ্জে বহু বছর ধরে এভাবে উদযাপিত হয়ে আসছে। এটা শহরকেন্দ্রিক ছিল না একেবারে। 

৬৭ সাল থেকেও যদি আমরা ধরি, যখন আমরা ছায়ানট থেকে সংগীতের মধ্য দিয়ে এবং সকল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পহেলা বৈশাখটা উদযাপন করা শুরু করলাম। এটা বাংলাদেশে ধর্মীয় দু’য়েকটা উৎসব ছাড়া সর্ববৃহৎ একটা উৎসবে পরিণত হয়েছে। এটার লক্ষ্য হলো, শুধু বাঙালি পরিচয়। খুব জরুরি বিষয় এটা। বাঙালি পরিচয়ে একত্রিত হয়ে একে অপরকে আলিঙ্গণ করছে। বিশ্বকে বলে দিচ্ছে যে, বাঙালি হিসেবে আমি গর্ববোধ করি। আমার নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। সে সংস্কৃতি আমি তোমাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। এই ভাবনা নিয়ে কিন্তু মানুষ পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে হাজির হয়। এভাবে উদযাপন করার মধ্য দিয়ে আমাদের শহরকেন্দ্রিক লোকেরাও যারা গ্রামের উৎসবটাকে ভীষণভাবে হৃদয়ে অভাববোধ করে, সেই অভাবটা পূরণ করেছে ঢাকা শহর এবং অন্য শহরগুলো। এবং বিশ্বের বিভিন্ন শহরে যেখানে বাঙালিরা অবস্থান করছে তারাও কিন্তু প্রকৃৃতির কাছাকাছি থেকে, অর্থাৎ উন্মুক্ত জায়গায় মঞ্চ করে গাছের নিচে বা কোনো একটি ছায়ায় নতুন বছরকে বরণ করে নিচ্ছে। আমরা জানি, অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে এরকম উদযাপন হয়েছিল কয়েকবার।


যারা নিজেদের সংস্কৃতির ব্যাপারে সচেতন তারা জানে তাদের সংস্কৃতিটা কী? সেখানে কোনো সংঘাত নেই। কিন্তু আমাদের দেশে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে সংস্কৃতিকে দেখে। সেজন্যই আমাদের আসল যে সংস্কৃতি, সেটাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য এ আন্দোলনের প্রয়োজন হয়। 


জাগরণ : আপনি একজন সাংস্কৃতিকর্মী, দীর্ঘ সময় ধরে আপনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন, কোন দিকে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি?

খায়রুল আনাম : একটা বিষয় বুঝতে হবে, আমাদের রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার মহান ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র আন্দোলনের পাশাপাশি একটা সাংস্কৃতিক যুদ্ধও আমরা করেছি। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে সাংস্কৃতিক যে আন্দোলন— এই সবটা মিলেই কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবস্থাটাকে সৃষ্টি করে দিয়েছে। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনটি আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কারণ, সংস্কৃতি আমাদের দেশের বা কোনো জাতির নিজ পরিচয়ের জায়গা। আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চাটা বেগবান হয়েছে আমাদের পহেলা বৈশাখ উদযাপনের মধ্য দিয়ে। এর বর্তমান অবস্থা একটু মিলেমিশে গেছে। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যেহেতু বিশ্বায়নের যুগে বাস করছে, তাই সারা বিশ্বের সঙ্গে তাদের যে যোগাযোগ সেটির সঙ্গে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে।

জাগরণ : এই দেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলনটা কেন প্রাসঙ্গিক বা জরুরি বলে আপনি মনে করেন?

খায়রুল আনাম : কেন সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রয়োজন রয়েছে? সংস্কৃতি যখন তার নিজ জায়গা থেকে অন্যদিকে ঝুঁকতে থাকে তখনই আন্দোলনের প্রয়োজন পড়ে। সমাজে বিভিন্ন ধরনের চিন্তা ভাবনা আছে যারা ভুলভাবে সংস্কৃতিকে প্রচার প্রসার করে বা সংস্কৃতির চর্চা যেখানে বাধা পায়, সেখানেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রয়োজন। সব দেশে তো সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয় না। যারা নিজেদের সংস্কৃতির ব্যাপারে সচেতন  তারা জানে তাদের সংস্কৃতিটা কী? সেখানে কোনো সংঘাত নেই। কিন্তু আমাদের দেশে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে সংস্কৃতিকে দেখে। সেজন্যই আমাদের আসল যে সংস্কৃতি, সেটাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য এ আন্দোলনের প্রয়োজন হয়। এটা তো আজকের থেকে না, পাকিস্তান আমল থেকে যখন নতুন পাকিস্তান হয়। তখন বাঙালি সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি কী হবে এটা নিয়ে নানা ধরনের অপপ্রচার শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথকে বাদ দেওয়ার পরে, নজরুলকে ভিন্নখাতে পরিচিত করার কারণে এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রয়োজন হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে আমরা সেই আন্দোলনটা করে যাচ্ছি। কারণ, আমাদের এই দেশে কিছুসংখ্যক লোক আছে, যারা ভিন্ন ভাবনা নিয়ে চলে। আমাদের যে ভাবনা থেকে এই দেশটি স্বাধীন করেছিলাম, সে ভাবনা থেকে তাদের ভাবনাটা ভিন্ন। সেজন্যই আমাদের এ আন্দোলনটা এখনো চালিয়ে যাচ্ছি।