“বছরের পর বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের জেরুজালেমের পবিত্র শহর থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা করে আসছে ইসরায়েল সরকার। গাজায় ইসরায়েলের সর্বশেষ হামলাও এই পরিকল্পনারই অংশ। তবে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক এসব হামলার মূল উদ্দেশ্য বুঝতে হলে তাদের যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত এই ‘অগ্রাসন ও উচ্ছেদের’ কৌশলটি আমাদের বুঝতে হবে। কিভাবে ফিলিস্তিনিদের ওপর একের পর এক হামলা চালিয়ে তাদের আতঙ্কিত করে বাস্তুচ্যুত করার চেষ্টা করা হচ্ছে—সেটিও জানতে হবে।”
সংবাদমাধ্যম ট্রুথআউটকে দেয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে ফিলিস্তিন ইস্যুতে এভাবেই নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন বিশ্বখ্যাত ভাষাবিদ, রাজনীতি বিশ্লেষক ও ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলোজি, এমআইটির ইমেরিটাস অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি।
ট্রুথআউট: শুরুতেই জানতে চাইবো, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের অগ্রাসনের পটভূমি, আল-আকসায় সাম্প্রতিক সহিংসতা ও গাজায় ইসরায়েলি হামলার বর্তমান প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার মতামত। আর এসবের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঠিক কী ভূমিকা রাখছে?
চমস্কি: ...নতুন মোড় থাকলেও ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের গল্পটা কিন্তু বেশ পুরোনো। তবে ১৯৬৭ সালে আরব যুদ্ধে ইসরায়েলের বিজয় আর ৫০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমে গল্পটি নতুন রূপ নেয়।
আজ যে ইহুদী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আমরা দেখছি সেটিও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয়েছে। সোজাসুজি বলতে গেলে, এই পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল, ফিলিস্তিনিদের নিজ জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করা এবং ইসরায়েলিদের জবরদখলের পথ প্রশস্ত করা।
এই নীতি অনুযায়ী ইহুদী জাতীয়তাবাদ ভাল-খারাপ, অন্যায় বা ন্যায় যাই হোক না কেন সেটা ঐ ভূখণ্ডের সাত লাখ বাসিন্দার জীবন আর ভবিষ্যতের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শুরুতে ব্রিটিশরাও এই পরিকল্পনাকে সমর্থন দিয়েছে। ফিলিস্তিনে ইহুদিদের স্থানান্তরের ঘোষণাপত্র যিনি লিখেছেন, সেই লর্ড বেলফোরও পশ্চিমাদের নীতি সঠিকভাবে অনুসরণ করেছেন।
ইহুদী জাতীয়তাবাদীরা সবসময়য়েই সুযোগসন্ধানী। তারা যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই হামলা আর উৎখাতের চেষ্টা চালিয়েছে। যখন তারা সেটি পারেনি তখন অগ্রাসনের সুর নরম করেছে।
প্রায় এক শতাব্দী আগে যেখানে শুধুমাত্র একটা ওয়াচটাওয়ার ছিল, আজ সেখানে সীমান্ত স্থাপন করেছে ইসরায়েল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূখণ্ড থেকে উৎখাত করছে তারা। যেটা কেবল আইনের লঙ্ঘনই না, পুরোপুরি বর্ণবাদী আচরণ। ফিলিস্তিনিরা কেবল তাদের বাসস্থান ফেরত পাওয়ারই অধিকার রাখে না, এই ভূখণ্ডে যা কিছু আছে সবকিছু ভোগদখল করার অধিকার তাদের আছে।
১৯৬৭ সালে আরবদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ের পর এ অঞ্চল দখলের মাধ্যমে ইসরায়েল বিশ্বনেতাদের চোখের সামনে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। ১৯৬৭ সালের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের কেবল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ছিল। তবে যুদ্ধের পর ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়িক অংশীদার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইসরায়েলের বিজয় ছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জন্য উপহারস্বরূপ। এদিকে, আরব ইসরায়েলের মধ্যে বিরোধটা ছিল উগ্র ইসলামপন্থীদের সঙ্গে ইহুদী জাতীয়তাবাদের। নিজেদের সাম্রাজ্যবাদের চাইতে যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু এই মৌলবাদকেই বিশ্বের জন্য বড় হুমকি মনে করে।
৬৭’র যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের বড় খরিদদার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ইসরায়েল। সেসময় মধ্যপ্রাচ্যের তিন দেশ ইসরায়েল, সৌদি আরব ও ইরানকে যুক্তরাষ্ট্র প্রভাব বিস্তারের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করতো। যদিও এরা প্রত্যেকেই একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তারপরেও যুক্তরাষ্ট্র তাদের একত্রিত করতে চেষ্টা করেছে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আইন লঙ্ঘন করে গোলান উপত্যকা দখলে নিয়েছে ইসরায়েল। এরপর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘আব্রাহাম একর্ড’ চুক্তির মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত আর ইসরায়েলের মধ্যে নতুন সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এই পুরো প্রক্রিয়ায় ইসরায়েলের অগ্রাসন নিয়ে আরবদের বিরোধিতা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে গেছে। আব্রাহাম একর্ডের মাধ্যমে ট্রাম্প দুটি স্বৈরশাসক দেশকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছে। আর ট্রাম্প যেসব প্রকল্প অসম্পূর্ণ রেখে গেছেন, বাইডেন সেগুলোই বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন।
ট্রুথআউট: ইসরায়েলের বসতি স্থাপনের যেহেতু কোন আইনি বৈধতা নেই, সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে কেন নিজের দেশের আইন ভঙ্গ করে তাদের সহায়তা করছে? প্রগতিশীলরা কেন এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড নিয়ে কিছু বলছে না?
চমস্কি: ১৯৬৭ সালের সহিংসতার মাধ্যমে ইসরায়েল প্রমাণ করেছে যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের প্রধান ভোক্তা। আর যুক্তরাষ্ট্র প্রমাণ করেছে যে, আইন তাদের জন্য কোনো প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করতে পারে না।
উদাহরণস্বরূপ, জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বিষয়ে অন্য দেশের ওপর বল প্রয়োগ সম্পূর্ণ অবৈধ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এমন কোন সরকার আছে যে এই আইন লঙ্ঘন করেনি? আমরা যদি কেবল ইরাকে মার্কিন অভিযানের কথাই চিন্তা করি তাহলে সেটাই হবে আন্তর্জাতিক অপরাধের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ।
এই প্রশ্ন আমারও যে, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় আইন (Leahy Law) অনুযায়ী, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী কোন দেশকে সামরিক সহায়তা দেওয়া নিষিদ্ধ। সেখানে ইসরায়েল কি করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র কিনতে পারে? তবে সাম্প্রতিক সময়ে ডেমোক্র্যাট নেত্রী বেটি ম্যাককালামসহ আরও অনেকেই এই আইনের মাধ্যমে ইসরায়েলে সামরিক সহায়তা বন্ধের চেষ্টা চালাচ্ছেন।