কোনো না কোনো দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়ে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে যেতে হয়েছে। কাউকে না কাউকে বাঁচাতেও ছুটে যেতে হয়েছে হাসপাতালে। আজ এভাবে ছুটে আসতে হবে তা ভাবিনি।
ইতিকথার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। আজ সবশেষ কেমোথেরাপি দেওয়া হবে। শারীরিক বা মানসিক কোনোভাবেই সে আর বেঁচে নেই। বেঁচে থাকার ইচ্ছাটুকু মরে গেছে। ডাক্তার তার আদালতে রায় দিয়েছেন মৃত্যু।
ইতিকথা তার পরিবারের কাছে শেষ ইচ্ছে হিসেবে আমায় দাবি করে বসল। ইতিকথার বাবার কাছে মেয়ের সবশেষ আব্দার হলাম আমি। আব্দার মেটাতে ইতিকথার বাবা জনাব ফিরোজ সাহেব আমাকে ফোন দিলেন। বললেন—
—বাবা রাসেল আজ ইতিকথার শেষ থেরাপি। আমি জানি না কী হবে? কিন্তু ইতিকথা তোমাকে শেষবারের মতো দেখতে চাচ্ছে। তুমি কি আসতে পারবে?
—জ্বি। আমি আসছি।
আমি ছুটে এলাম ইতিকথার কাছে। পরিবারের সবাই অশ্রুজলে সিক্ত। কেবিনটা যেন শ্মশানে পরিণত হয়েছে। অথচ ইতিকথা হাসছে, আমায় দেখে ভালো-মন্দ নিয়ে কথা বলছে। আমার মাথা রীতিমতো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ইতিকথার মুখের দিকে আর তাকানো যাচ্ছে না। তার সবচেয়ে সুন্দর দুটি চোখের নিচে কালো দাগ বসেছে। চোখের উজ্জ্বলতা হ্রাস পেয়েছে। থেরাপির কারণে মাথার ঘন চুলগুলোও কমে গেছে। তার হাসিতে মৃত্যুর ছাপ ভেসেছে। আর কিছুক্ষণ পর ইতিকথাকে কেমোথেরাপি দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হবে। ইতিকথা হাসিমুখে বলছে—
—রাসেল কেমন আছো? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে, তুমি এসেছো। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, তুমি আসবে। মানুষের শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়। আর তা ছাড়া আমি চলে যাবো। তুমি আমায় শেষ দেখা দেখতে আসবে না! তা কখনো হতে পারে না।
—কি বলছ কী ‘কথা’? শেষ দেখা মানে? তুমি আবার সুস্থ হয়ে ফিরবে। আমরা আবার একসাথে হবো। ঠিক আগের মতো। বসন্তে হলুদ শাড়ি, কপালে লাল টিপ, খোঁপায় গাঁদা ফুলের মালায় আমি আবার দেখতে চাই তোমাকে। আবার একসাথে হাঁটতে চাই।
(ইতিকথার চোখের কিনারা বেয়ে জল পড়ছে)
—হ্যাঁ রাসেল আমিও চাই। তোমার সাথে বসন্তের ভিড়ে হাঁটতে। কিন্তু তা আর সম্ভব নয়।
আমি ইতিকথার হাত ধরে বললাম—
—কেন? কেন সম্ভব নয় কথা?
—আমার জন্য মৃত্যু মঞ্চ তৈরি হচ্ছে রাসেল। কিছুক্ষণ পর দেখবে নার্স এসে বলছে আমরা সবাই রেডি, এবার পেশেন্টকে নিতে হবে।
এরপর ঠিক তাই হলো। কেবিনে নার্স এসে বলল—
—আমরা সবাই রেডি, এবার পেশেন্টকে নিতে হবে।
ইতিকথা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি কাঁদছি। ইতিকথা বলল—
—বলেছিলাম না রাসেল, একদিন ছুটি হবে আর অনেক দূরে যাবো। তোমার হাতটা ধরে থাকতে ইচ্ছে করছে রাসেল।
আমি আরো আকড়ে ধরলাম। সবাই ওকে নিয়ে গেল। আমার চোখ বেয়ে জল পড়ছে। নিজেকে সামলানোর মতো শক্তি আমার দেহে আর নেই।
বেশ খানিকক্ষণ পর ইতিকথা বের হলো। তার সত্যি সত্যি ছুটি হয়েছে, সে এখন অনেক দূরে। ইতিকথার জীবনে ইতি ঘটেছে।
তার শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়েছে।