৪৩ বছরেও বিচার হয়নি সেই ১৩ জন হত্যার মামলার

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০১৯, ১০:৫৯ এএম ৪৩ বছরেও বিচার হয়নি সেই ১৩ জন হত্যার মামলার

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার দিন ১৯৭১ সালের ১৫ই আগস্ট খুনিদের এলোপাতাড়ি ছোঁড়া কামানের গোলায় ১৩ জন নিহত হন। রাজধানীর মোহাম্মাদপুরের শেরশাহ সুরী রোড এলাকার ওই ঘটনায় করা মামলার বিচার সম্পন্ন হয়নি ৪৩ বছরেও। সাক্ষী না আসায় থমকে আছে মামলার বিচারকাজ। 

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি এই মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে প্রায় ১৩ বছর আগে চার্জগঠন করে বিচার শুরু করে আদালত। তবে এতদিনেও মামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি। ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটি এখন সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে আছে।

সর্বশেষ গত ১ জুলাই তারিখে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য ছিল। কিন্তু ওই দিন সাক্ষী না আসায় আগামী ১৯ আগস্ট সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী তারিখ ঠিক করেন সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক মাকছুদা পারভীন।

এদিকে, এখন পর্যন্ত কোনো প্রকার সহায়তা পাননি নিহত হতদরিদ্র পরিবারগুলো। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকায় সরকারের কাছে তারা (হতাহত পরিবার) ওই হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচারের পাশাপাশি পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন।

মামলার বাদী মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী গণমাধ্যমকে  বলেন, আমি তখন ২৪ বছরের যুবক। মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডের ৮ নম্বর বাড়িটি ছিল আমার। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যার দিন ভোর সাড়ে ৫টায় বাসার ওপর কামানের গোলা এসে পড়ে। সেখানে বাসার ভাড়াটিয়া ও আমার গ্রামের লোকজন অবস্থান করছিল। কামানের গোলায় আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয় রিজিয়া বেগমসহ ১৩ জন সেখানে মারা যান। প্রায় ৪০ জন আহত হন। ওই ঘটনায় মামলা করতে গেলে পুলিশ দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির অযুহাতে মামলা না নিয়ে আমাকে ফিরিয়ে দেন। আর কামানের গোলায় নিহত লাশগুলোকে কবর দিয়ে দিতে বলেন।’

বাদী বলেন, একপর্যায়ে ১৫ আগস্ট যা কিছু হয়েছে এ ব্যাপারে কোনো মামলা করা যাবে না- এ সংক্রান্ত আইন পাস হয়। ফলে চেষ্টা করেও ওই সময় আর মামলা করা সম্ভব হয়নি। পরে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় এলে ওই আইন বাতিল হয়। এরপর ১৯৯৬ সালে স্বশরীরে মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে কামানের গোলায় ১৩ জনকে হত্যার মামলা দায়ের করি।

তিনি বলেন, স্পর্শকাতর এ মামলা দীর্ঘ দিনেও শেষ না হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে এনে তাদেরও শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি। ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত কেউ হতদরিদ্র ওই পরিবারগুলোর খবর নিতে আসেনি। কোনো প্রকার আর্থিক সহায়তাও করেনি। বর্তমানে হতদরিদ্র ওই পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণও করেন তিনি।

মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সালে ১৯ মার্চ এ মামলার বাদীর প্রথম সাক্ষ্য গ্রহণ হয়। এরপর দীর্ঘদিন বাদীর পূর্ণাঙ্গ সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষের ১৫তম সাক্ষী মো. রমিজ উদ্দিন ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল আদালতে সাক্ষ্য দেন। এছাড়া ২০১৫ সালের ৭ মে আদালতে এ মামলায় বাদী অবশিষ্ট সাক্ষ্য দেন। আর বাদীর ওই পূর্ণাঙ্গ সাক্ষ্যর পর থেকে দীর্ঘ তিন বছর কোনো সাক্ষগ্রহণ হয়নি। দীর্ঘদিন পর ২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানার তৎকালীন এসআই ডিস্ট্রিক ইন্টিলিজেন্স অফিসার তোফাজ্জল হোসেন এবং একই দিন পুলিশের এডিসি নুরুল ইসলাম আদালতে সাক্ষ্য দেন। এরপর চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি পুলিশের এএসপি মুন্সী আতিকুল রহমান এ মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দেন। সর্বশেষ ১ জুলাই এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু এদিনও সাক্ষী উপস্থিত হয়নি। এজন্য রাষ্ট্রপক্ষের সময় আবেদন মঞ্জুর করেন পরবতী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ১৯ আগস্ট দিন ধার্য করেন আদালত।

ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলী সাইফুল ইসলাম হেলাল বলেন, মূলত দীর্ঘদিন এ মামলার বিচার কার্যক্রম বন্ধ ছিল। বিএনপি সরকার ও বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মামলার বিচারিক কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। এরপর ২০০৯ সালের পর এ মামলার বিচারে গতি পায়। এরপর থেকে অদ্যাবধি দ্রুত বিচার কার্যক্রম শেষ করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে। মামলায় সাক্ষী হাজিরের ক্ষেত্রে সব সময়ই যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছেন আদালত। সাক্ষীদের বিরুদ্ধে সমনের পর অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়নাও জারি করা হয়েছে। সাক্ষীদের হাজিরের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকল স্থানে দফায় দফায় চিঠি দেয়া হয়েছে। বার বার সমন পাঠানোর পরও মামলার গুরুত্বপূর্ণ কিছু সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসেননি। তবে অনেক সাক্ষীই তাদের ঠিকানা পরিবর্তন করায় তাদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া সাক্ষী হাজিরা সেলের মাধ্যমে মামলার সকল পুলিশ সাক্ষীদের হাজির নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই তিনজন পুলিশ কর্মকর্তা আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। চাঞ্চল্যকর এ মামলাটির বিচার দ্রুত সম্পন্ন করতে পারবেন বলে তিনি আশা করছেন।

সংশ্লিষ্ট আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মোহাম্মাদ মাহফুজুর রহমান চৌধুরী পুলিশ বিভাগকে দায়ী করে বলেন, ‘‘সাক্ষী হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের। আমরা আদালত থেকে যথাযথভাবে সাক্ষী হাজির করতে পুলিশের কাছে সমন/ ওয়ারেন্ট পাঠানোর পরও পুলিশ সাক্ষী হাজির করছে না। গত এক বছরে তারা তিন জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পেরেছেন।’’

৪৩ বছর আগের ওই হত্যার ঘটনায় মামলা হয় ১৯৯৬ সালে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের সময় সেনা সদস্যরা কামানের গোলা ছুঁড়লে তা গিয়ে মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডর ৮ ও ৯ এবং ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়ির (টিনশেড বস্তি) ওপর পড়ে। লে. কর্নেল মুহিউদ্দিন আহমেদের (আর্টিলারি) ছোড়া কামানের গোলার বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। মুহূর্তে ধুলায় মিশে যায় ওই বস্তি। ওই ঘটনায় নারী ও শিশুসহ ১৩ জন মারা যায়। প্রায় ৪০ জন আহতের মধ্যে কয়েকজন পুরুষ সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়।

নিহতরা হলেন- রিজিয়া বেগম ও তার ছয় মাসের মেয়ে নাসিমা, কাশেদা বেগম, ছাবেরা বেগম, সাফিয়া খাতুন, আনোয়ারা বেগম (প্রথম), ময়ফুল বিবি, আনোয়ারা বেগম (দ্বিতীয়), হাবিবুর রহমান, আবদুল্লাহ, রফিজল, সাহাব উদ্দিন আহম্মেদ ও আমিন উদ্দিন আহম্মেদ।

ওই ঘটনায় ৮ নম্বর বাড়ির মালিক মোহাম্মদ আলী বাদী হয়ে ১৯৯৬ সালের ২৯ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় মামলা দায়ের করেন। ২০০১ সালের এপ্রিলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এরপর ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর এ মামলায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।

১৭ আসামির মধ্যে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তারা হলেন- লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহিউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ। ওই পাঁচজন ছাড়া এ মামলায় প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে (প্রয়াত) গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল। এ ছাড়া মামলার অপর ১১ আসামি পলাতক রয়েছে।

পলাতকরা হলেন- লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) শরিফুল হক ডালিম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী ইবি, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) আহমদ শরিফুল হোসেন ওরফে শরিফুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) মো. কিসমত হাসেম, ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার, রিসালদার (অবসরপ্রাপ্ত) মোসলেম উদ্দিন ওরফে মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী ও এলভি মো. আলী হোসেন মৃধা।

এমএ/টিএফ

আরও সংবাদ