ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি (দশ)

সমর সেনকে হাইজ্যাক পরিকল্পনা করল কারা?

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৯, ০৩:২৯ পিএম সমর সেনকে হাইজ্যাক পরিকল্পনা করল কারা?

পনেরোই আগস্ট ট্র্যাজেডির পর সেই অস্থির সময়ে দেশের রাজনীতিতে একের পর এক ঘটতে থাকে অনেক নাটকীয়, বেদনাদায়ক ও চাঞ্চল্যকর ঘট্না। এসবের একটি ছিল ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শ্রী সমর সেনকে অপহরণের প্রচেষ্টা। পঁচাত্তরের ২৬ নভেম্বর জাসদের একটি সুইসাইড স্কোয়াড শ্রী সেনকে অপহরণের চেষ্টা করে। এ ঘটনার প্রায় ১০ দিন আগে ১৫ নভেম্বর সমর সেনের বাড়ির আঙিনায় একটি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড পাওয়া যায়।

সমর সেন ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রদূত। একাত্তরে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সময় কূটনৈতিক যুদ্ধে এই খ্যাতিমান কূটনীতিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। শ্রী সেন সেই সময় ছিলেন জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি। জাতিসংঘে তিনি বাংলাদেশবিরোধী মার্কিন কূটনৈতিক চাপ বেশ দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে সামাল দিয়েছিলেন। সমর সেন বাংলাদেশে নিয়োজিত ছিলেন চুয়াত্তরের জুন থেকে ছিয়াত্তরের নভেম্বর পর্যন্ত।

ব্যতিক্রমী ছিল শ্রী সেনের আগমন
সমর সেনের ঢাকায় আগমনের বিষয়টি ছিল বেশ ব্যতিক্রমী একটি ঘটনা। বাংলাদেশে তখন ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন স্বনামধন্য কূটনীতিক সুবিমল দত্ত। তিনি ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের প্রথম রাষ্ট্রদূতও বটে। জওহর লাল নেহরুর আমলে এই সুবিমল দত্ত ভারতের পররাষ্ট্রসচিব পদে নিয়োজিত ছিলেন। এমন একজন ঝানু কূটনীতিককে সদ্য স্বাধীন একটি দেশে নিযুক্তি প্রমাণ করে যে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি বেশ গুরুত্ব দিচ্ছিল। সুবিমল দত্ত এবং সমর সেন উভয়েই ছিলেন আমাদের এই মাটিরই মানুষ। সমর সেনের জন্ম ঢাকায় আর সুবিমল দত্ত বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর কানুনগো পাড়ায়।

১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কিছুটা কূটনৈতিক টানাপড়েন শুরু হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সুবিমল দত্ত পদত্যাগ করেন। এই পদত্যাগের কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পাশে থেকে তিনি ভুট্টোকে ঢাকা বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত নন এবং ভুট্টোর সঙ্গে করমর্দন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে আসেন শ্রী সেন।

সমর সেন

সুইসাইড স্কোয়াড গঠন
সমর সেন অপহরণ প্রচেষ্টার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন কর্নেল তাহেরের ভাই, ঢাকা নগর গণবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেন। এই অপারেশন সম্পন্ন করতে আনোয়ার হোসেন ছয় সদস্যের একটি সুইসাইড স্কোয়াড গঠন করেন। এই স্কোয়াডের নেতা ছিল সাখাওয়াত হোসেন বাহার। অন্য পাঁচজনের মধ্যে ছিল ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, মীর নজরুল ইসলাম বাচ্চু, মাসুদুর রহমান, হারুন অর রশীদ এবং সৈয়দ বাহারুল হাসান সবুজ। এদের মধ্যে বাহার ও বেলাল ছিল কর্নেল তাহের এবং আনোয়ার হোসেনের ভাই।

যেভাবে শুরু হয় অপারেশন
পঁচাত্তরের ২৬ নভেম্বর। সকাল প্রায় ৯টা। ধানমণ্ডি দুই নাম্বার রোড। গাছপালায় ঢাকা, সুনসান আবাসিক এলাকা। এখন যেখানে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার, ঠিক সেখানেই একসময় ছিল ভারতীয় দূতাবাস। সুইসাইড স্কোয়াডের তিনজন অবস্থান নেয় রাস্তার দক্ষিণ পাশে জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কাছে, আর অন্য তিনজন ‍অপেক্ষা করতে থাকে ভারতীয় ভিসা অফিসের সামনে। মগবাজারের নয়াটোলার আস্তানা থেকে তারা ভোরবেলা বের হয় অপারেশনের উদ্দেশ্যে। তারা খোঁজ নিয়ে জেনেছিল প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সমর সেন অফিসে আসেন। সেদিন সকাল ৯টা বেজে ৪০ মিনিটে সমর সেনের গাড়ি এসে দাঁড়ায় দূতাবাসের চৌকাঠে। তিনি গাড়ি থেকে নামতেই গণবাহিনীর সেই ছয় তরুণের সুইসাইড স্কোয়াড তাঁকে জিম্মি করে। তারা তাঁকে বলে, ‘আপনি এখন আমাদের হাতে জিম্মি। আপনার ঘরে চলুন, আপনার সাথে আমাদের কথা আছে।’ স্বাভাবিকভাবেই সমর সেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। নিজের দূতাবাসের দরজার সামনে এভাবে তাকে অপহরণ করা হবে, এটা হয়তো তিনি ভাবতেও পারেননি। অপহরণ প্রচেষ্টার আগে যারা রেকি করেছিল, তারা খেয়াল করেনি ভবনের দোতলায় নিরাপত্তারক্ষীদের একটি দল সর্বদা পাহারায় থাকে। ফলে যখন তারা সমর সেনকে সিঁড়ি দিয়ে একতলা থেকে দোতলায় নিতে উদ্যত হয়, তখন উপর থেকে শুরু হয় ব্রাশফায়ার। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সবাই। অপহরণকারীদের মধ্যে বাহার, বাচ্চু, মাসুদ ও হারুন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। বেলাল ও সবুজ আহত অবস্থায় কাতরাতে থাকে। সমর সেনের কাঁধে গুলি লাগে, তবে তার আঘাত ততটা মারাত্মক ছিল না। খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে আসেন সেনাবাহিনীর নবনিযুক্ত চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার আবুল মঞ্জুর। তিনি আহত বেলাল ও সবুজকে তার গাড়িতে উঠিয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যান। বাহার, বাচ্চু, মাসুদ ও হারুনের মৃতদেহ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ভারতীয় দূতাবাসের পেছনে ৩ নম্বর সড়কে থানার পোর্টিকোর নিচে একটি ভ্যানে মৃতদেহগুলো রাখা হয়।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে সমর সেন

পাঁচ পুলিশ সদস্য পুরস্কৃত
চার অপহরণকারীকে হত্যা ও দুজনকে জীবিত অবস্থায় গ্রেফতারের জন্য পুলিশের পাঁচজন সদস্যকে পুরস্কৃত করা হয়। আইজিপি তাদের প্রত্যেককে দুই হাজার টাকার পুরস্কার তুলে দেন। অন্যদিকে পুলিশ এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদেরও খুঁজতে শুরু করে। গ্রেফতার এড়াতে জাসদের অনেকেই গা ঢাকা দেন। তবু একে একে গ্রেফতার হন আ ফ ম মাহবুবুল হক, মাহমুদুর রহমান মান্না এবং বিপ্লবী সৈনিক সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতা। এই আ ফ ম মাহবুবুল হক কয়েক বছর আগে কানাডায় মৃত্যুবরণ করেছেন। আর মাহমুদুর রহমান মান্না জাসদ, বাসদ এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতি শেষে এখন খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। সে এখন নাগরিক আন্দোলনের আহ্বায়ক এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা।

অপহরণের জন্য পিস্তল ছিনতাই
ভারতীয় হাইকমিশনে অভিযান চালানোর কয়েক দিন আগে অপহরণকারী দলের সদস্যরা রায়েরবাজারের জনৈক জয়নুল হক শিকদারের কাছ থেকে দুটি পিস্তল ছিনিয়ে নেয়। ওই সময় তারা সেনাবাহিনীর একটি জিপ নিয়ে গিয়েছিল। পিস্তল দুটি লাইসেন্স করা ছিল। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে অন্য অস্ত্রের সঙ্গে এই দুটি পিস্তলও উদ্ধার করে। উদ্ধারকৃত পিস্তলের সূত্র ধরে পুলিশ এর মালিকের নাম-ঠিকানা জোগাড় করে এবং শিকদারকে গ্রেফতার করে। অস্ত্র হারানোর তথ্য পুলিশকে না জানানোর অভিযোগে সিকদারের জেল হয়। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে জয়নুল হক শিকদার ১৯৮২ সালে আমেরিকায় পাড়ি জমান। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। এখন তিনি ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান। সিকদার নিজের নামে একটি মেডিকেল কলেজও প্রতিষ্ঠা করেছেন।

রাজনৈতিক মহলের প্রতিক্রিয়া
সমর সেনকে অপহরণ প্রচেষ্টায় বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়। প্রায় সব দলের নেতারা এক সুরে এ ঘটনার সমালোচনা করেন। ডান, বাম সকলে মিলে একটি যৌথ বিবৃতিও দেন। বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন আতাউর রহমান, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, শাহ আজিজুর রহমান, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেননসহ আরো অনেকে। বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘আমরা একদল লোকের এহেন কাপুরুষোচিত ও জঘন্য অপচেষ্টার তীব্র নিন্দা করিতেছি। ঘটনাটি দৃশ্যতই রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই ইহা করা হইয়াছে। ভারতীয় কমিশনারের উপর পরিচালিত আক্রমণ প্রতিহত করিবার ক্ষেত্রে কর্তব্যরত বাংলাদেশ পুলিশ ও রক্ষীদের উপযুক্ত এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আমরা প্রশংসা করি।’

ইন্দিরা গান্ধীকে সায়েমের ফোন
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক যেকোনো সময়ের চেয়ে নাজুক ছিল। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এতটাই অবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন যে তিনি সমর সেনকে উদ্ধার করে কলকাতায় চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে বিমানবাহিনীর একটি দলকে পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সমর সেন তাতে রাজি হননি। অবশেষে ইন্দিরা গান্ধী শ্রী সেনের শারীরিক অবস্থা তদারকির জন্য কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে ঢাকায় পাঠান। ভারত সরকার এ ধরনের কোনো ঘটনার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিল না। এ ঘটনায় বাংলাদেশ সরকারও চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে। ঘটনার প্রতিক্রিয়া সামাল দিতে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে ফোন করেন প্রেসিডেন্ট সায়েম। এতেও যখন সম্পর্কের শীতলতা কাটছিল না, তখন পুরো পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ভারতে পাঠানো হয়।

বন্ধ ছিল টেলিযোগাযোগ
উইকিলিকসের ফাঁস করা মার্কিন দূতাবাসের তারবার্তা থেকে জানা যায়, সমর সেনকে অপহরণ প্রচেষ্টার দিন সকাল ১০টা থেকে কিছু সময়ের জন্য ভারত ও বাংলাদেশের মাঝে টেলিযোগাযোগ-ব্যবস্থা বন্ধ ছিল। কেন বন্ধ ছিল? এই প্রশ্নের জবাব কোথাও পাওয়া যায়নি। ১৯৭৬ সালের ১৬ জানুয়ারির তারবার্তায় আরো দেখা যায়, মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টারের সঙ্গে আলোচনায় সমর সেন তার অপহরণ প্রচেষ্টার পেছনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। সমর সেনের মতে, কেউ তাকে অপহরণ করতে চাইলে অবশ্যই ভারতীয় দূতাবাসের সামনে থেকে অপহরণের চেষ্টা করত না। সমর সেন এই ঘটনাকে হত্যাপ্রচেষ্টা বলেও মনে করেননি, কারণ তার মতে, আক্রমণকারীরা সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও তাকে হত্যা করেনি ।

অন্ধকারে ছিলেন জাসদ নেতারা!
পঁচাত্তরে সিরাজুল আলম খান ছিলেন জাসদ পার্টি ফোরামের সমন্বয়কারী। তার সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ করা সম্ভব হতো বলে ফোরামের কার্যকরী সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করতেন শরীফ নুরুল আম্বিয়া। ২৬ নভেম্বর দুপুরে আনোয়ার হোসেনের কাছ থেকে শরীফ নুরুল আম্বিয়া জানতে পারেন ধানমণ্ডিতে একটি ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কী ঘটনা ঘটেছে আনোয়ার হোসেন তা স্পষ্টভাবে জানাননি। তবে জাসদের শীর্ষস্থানীয় নেতা শ্রী বিধান কৃষ্ণ সেন টেলিফোনে শরীফ নুরুল আম্বিয়াকে ঘটনাটির বিবরণ দিয়ে জানতে চান, ‘হটকারী করে সবাইকে ফাঁসানোর মতলব করছে কারা।’ এর উত্তরে আম্বিয়া বলেন, তিনি এসবের কিছুই জানেন না। ঘটনার আকস্মিকতায় আম্বিয়া নিজেও নাকি স্তম্ভিত।

এ থেকে বোঝা ‍যায়, জাসদের অনেক নেতাই এত বড় ঘটনা সম্পর্কে একদমই অন্ধকারে ছিলেন। তবে এ নিয়ে দলের ভেতরেই প্রতিবাদ উঠতে থাকে, ফলস্বরূপ এর পরিকল্পনাকারী আনোয়ার হোসেনকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। জাসদের পার্টি ফোরাম ঘোষণা দেয়, ‘এই ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তারা বিপ্লবীও নয়, প্রতিবিপ্লবীও নয়। তারা অবিপ্লবী।’ কিন্তু জাসদের সবাই যে এমন মনোভাব পোষণ করত, তা নয়। আশির দশকেও জাসদ ছাত্রলীগের স্লোগান ছিল, ‘বাহার-বাচ্চু-মাসুদ-হারুন! দিকে দিকে জ্বালাও আগুন!’

ফিলিস্তিনের বীর রমণী লায়লা খালেদ

আজব বৈকি!
কর্নেল তাহেরের আরেক ভাই আবু ইউসুফ, যিনি নিজেও জাসদের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন, তার ভাষ্যমতে, ‘আসলে মার্কিন দূতাবাসের পরিবর্তে ভারতীয় দূতাবাসে আক্রমণ হয়ে যায়। এই সময় ফিলিস্তিনের বীর রমণী লায়লা খালেদ তরুণদের বিরাট অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন। আমাদের পার্টিতে বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন রকম চিন্তাভাবনা ছিল। যদি বিপ্লব হয়, তাহলে ডানপন্থীরা তো সহজে মানবে না, একটা প্রতিক্রিয়া হবেই। সেক্ষেত্রে করণীয় কী হবে? একটা ভাবনা ছিল, মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জিম্মি করে অবস্থা অনুকূলে নিয়ে আসতে হবে। সেই লক্ষ্যে গণবাহিনীর ছেলেরা মতিঝিলের আদমজী কোর্টে মার্কিন দূতাবাসের ওপর বহুদিন নজরদারি করে। যখন আমরা সবাই অ্যারেস্ট হয়ে গেলাম, তখন যারা এ কাজে জড়িত ছিল তাদের ভাবনা থেকে এ কাজটি (সমর সেনকে অপহরণ) হয়ে যায় ।’

নির্মলেন্দু গুণের স্মৃতি
২৬ নভেম্বর সকালে অপহরণ প্রচেষ্টায় আহত সমর সেনকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন খ্যাতিমান কবি নির্মলেন্দু গুণ। এদিন ভোরবেলা গুণের প্রিয় বন্ধু কবি আবুল হাসান তৎকালীন পিজি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। হাসানের মৃত্যুর সংবাদ শুনে তিনি যখন হাসপাতালের গেটে পৌঁছান, তখন একদল পুলিশ এসে পিজি হাসপাতাল ঘিরে ফেলে। পুলিশ কর্ডন করা অবস্থায় একটি কালো মার্সিডিস গাড়ি একইসঙ্গে খুব দ্রুত পিজি হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করে।

নির্মলেন্দু গুণের ভাষ্যমতে, ‘আমি হাসপাতালে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখতে পাই, পুলিশ একজন রাষ্ট্রদূতকে ধরাধরি করে হাসপাতালের রিসেপশনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একজন পুলিশকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি, উনি হচ্ছেন ভারতীয় হাইকমিশনার শ্রী সমর সেন। তখন তার দেহ ছিল রক্তাক্ত। তাঁর গায়ে শার্ট ছিল না। শুধু গেঞ্জি ছিল। তিনি বাম হাতে ডান কাঁধের দিকে একটি ক্ষতস্থানকে চেপে ধরে খুবই ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে চারপাশে তাকাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্ট্রেচার নিয়ে নার্স ও ডাক্তাররা সমর সেনকে বাঁচানোর জন্য ছুটে আসে। আমি দ্রুত ওই ঘটনাকে পাশ কাটিয়ে ওপরে ‍উঠে যাই। সমর সেনের কী হয়েছে, তা আর তখন জানা হয়নি।’

পরে অবশ্য নির্মলেন্দু গুণ জানতে পারেন, ৬ জন আত্মঘাতী তরুণের একটি দল সকালের দিকে ভারতীয় হাইকমিশনার শ্রী সমর সেনকে অপহরণ করার জন্য ধানমণ্ডির দুই নম্বর সড়কে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসে হামলা চালিয়েছিল। অল্পের জন্য ওই হামলা ব্যর্থ হয়। শ্রী সেনের দেহরক্ষী এবং দূতাবাস প্রহরারত পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই অপহরণপ্রয়াসীদের মধ্যে চারজন নিহত হয়। দুজন আহত অবস্থায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।

যে কথা বলতে হয়
‘খালেদ মোশাররফের ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আছে’ - এই অভিযোগ প্রচার করার ব্যাপারে কর্নেল তাহের ও তার দলের খুবই তৎপর ভূমিকা ছিল। এরই পরিণতিতে খালেদ মোশাররফসহ তিনজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে জীবন দিতে হয়। আর ৭ই নভেম্বর ক্ষমতা দখল করে জেনারেল জিয়া। নিয়তির কী পরিহাস, ক্ষমতা দখলের পর জিয়া প্রথমেই জাসদের ওপর আঘাত হানার জন্য তৈরি হয়। ২৩ নভেম্বর এক বেতার ভাষণে জেনারেল জিয়া জাসদের উদ্দেশে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে। ওই রাতে জিয়া যখন ভাষণ দিচ্ছিল, তখন পুলিশ রীতিমতো রাস্তায় নেমে পড়েছে। জাসদ নেতাদের মধ্যে প্রথমেই গ্রেফতার হন মেজর জলিল, আ স ম আব্দুর রব, হাসানুল হক ইনু এবং আবু তাহেরের বড় ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খান। পরদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় কর্নেল তাহের গ্রেফতার হন। রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতায় লিপ্ত থাকার অভিযোগে মোট ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের শিরোনামে শুধুই রব ও মেজর জলিলের কথা থাকলেও সংবাদের ভেতরে ১৭ নম্বর আসামি হিসেবে যে নামটি ছিল, তিনিই ছিলেন ওই কথিত রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার আসল টার্গেট। তার নাম কর্নেল তাহের। এই মৃত্যুদণ্ডযোগ্য রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাটি যে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়ার জন্যই করা হয়েছে, এটা বুঝতে পেরেই ওই ৬ সদস্যের আত্মঘাতী স্কোয়াড গঠন করে ভারতীয় হাইকমিশনার শ্রী সমর সেনকে জিম্মি করার চেষ্টা করছিল। এভাবেই তারা ওই মামলাটি প্রত্যাহারে জিয়া সরকারকে ভারতের চাপের মুখ ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাসদের এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। তবে শ্রী সমর সেনকে জিম্মি করার প্রচেষ্টাটি ব্যর্থ হওয়ার ফলে শেষ পর্যন্ত জেনারেল জিয়াই লাভবান হয়েছে। এই ঘটনা জনগণের মধ্যে এমন ধারণাকেই বদ্ধমূল করে যে জাসদ এবং কর্নেল তাহেরের দল দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। জেনারেল জিয়া জনগণের এই অনুভূতিকে তার হীন রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগায়। জাসদ দমনে জিয়া মরিয়া হয়ে ওঠে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই কয়েক হাজার জাসদ ও সিপাহি বিপ্লবের কর্মীদের আটক করে জেলে পাঠায়। আর সামরিক আদালতের নামে প্রহসনের বিচারে জেনারেল জিয়া তার প্রাণ রক্ষাকারী কর্নেল আবু তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। তবে ওই অপহরণ প্রচেষ্টা সফল হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিত, তা আজও কল্পনা ও গবেষণার বিষয় হিসেবেই থেকে গেছে...

পুনশ্চ:
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দুই দিন পর শ্রী সমর সেন খুনি মোশতাকের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের কূটনৈতিক অবস্থান জানিয়েছিলেন। এর প্রায় তিন মাস পর তিনি অপহরণ প্রচেষ্টার শিকার হন। এসব বিষয়ে শ্রী সেন তাঁর  জীবদ্দশায় খুব একটা মুখ খোলেননি। শ্রী সমর সেন ২০০৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এর আগে ১৯৯৮ সালের ২১ নভেম্বর ভারতের ফ্রন্টলাইন পত্রিকায় তিনি ১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনাবলি নিয়ে কথা বলেন। আর তাঁর মৃত্যুর পর ২০১১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর কোলকাতার ‘দ্য স্টেটসম্যান’-এর সম্পাদক মানস ঘোষ এক নিবন্ধে খন্দকার মোশতাক আহমদের সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে পঁচাত্তরের একটি নাটকীয় পরিস্থিতির বিবরণ দিয়েছেন। আগামী পর্বে আমরা এ বিষয় বিস্তারিত তুলে ধরব।

লেখক : সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ

[ বি.দ্র : পরবর্তী পর্ব প্রকাশ হবে আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর, বুধবার। ] 

আরও সংবাদ