পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট সকালে খন্দকার মোশতাক ক্ষমতা গ্রহণের কিছুক্ষণ পরেই সারা দেশে সামরিক আইন জারি করেন। পাশাপাশি তিনি অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করেন। এ ক্ষেত্রেও মোশতাক চালাকির আশ্রয় নেন এবং ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগান। শুক্রবার জুমার নামাজের জন্য তিনি ৩ ঘণ্টা সান্ধ্য আইন শিথিল করেন, যাতে মুসল্লিরা মসজিদে গিয়ে জুমার নামাজ আদায় করতে পারেন। এরপর তিনি একজন ভাইস প্রেসিডেন্টসহ একটি মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ওই মন্ত্রিসভার প্রায় সবাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য।
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজনেরা মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানালে কয়েকজনকে প্রাণনাশের ভয় দেখিয়ে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। আর যারা জীবনের মায়া উপেক্ষা করে মন্ত্রিসভায় যোগদানে বিরত থাকেন, তাদের সাজানো অভিযোগে সামরিক আইনের বিধিমালার আওতায় গ্রেফতার করা হয়। আবার আদর্শিক কারণেও কয়েকজন খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। এরা হলেন, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, কে এম ওবায়দুর রহমান প্রমুখ।
খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় প্রবীণ রাজনীতিক শ্রী ফণীভূষণ মজুমদারকেও যুক্ত করা হয়। ফণীভূষণ মজুমদার তখন অসুস্থ। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। খুনি সৈন্যরা তাঁকে হাসপাতাল থেকে ধরে মোশতাকের কাছ নিয়ে যায়। তখন তাঁর গায়ে শুধু একটি গেঞ্জি ছিল।
অর্থাৎ সৈন্যরা তাঁর গায়ে পাঞ্জাবি চাপানোর মতোও সময় দেয়নি। তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধেই তাঁকে ধরে নেয়া হয়। এ বিষয়ে ভারতের প্রয়াত সাংবাদিক পরেশ সাহার ভাষ্য এমন, ‘মোশতাকের কাছে উপস্থিত হয়ে তিনি তো মন্ত্রগুপ্তির শপথ নিতে অস্বীকার করতে পারতেন? তিনি যদি মোশতাকের কাছে গিয়ে বলতেন, না সাহেব, আমি আপনার সঙ্গে নেই। মন্ত্রিত্ব আমি নেব না। মোশতাক তাহলে কী করতেন? ফণীবাবুর গর্দান নিতেন? তিনি তো তাঁর জীবনে বহুবার এ ধরনের সংকটময় পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন। তিনি নাহয় আরও একবার সে ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা করতেন। তা করতে গিয়ে যদি তাঁর জীবনও যেত, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসে মনুষ্যত্বের দীপ্ত মহিমায় তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতেন।’ (মুজিব হত্যার তদন্ত, পৃষ্ঠা ৯৬-৯৭)
বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্যরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেও মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থ, বাণিজ্য ও পরিবহন মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ-পুনর্বাসন ও কৃষিমন্ত্রী আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান এতে রাজি হননি। উল্টো তারা দৃঢ়চিত্তে খন্দকার মোশতাকের কৃতকর্মের প্রতিবাদ করেন। আরো একজন খন্দকার মোশতাক আহমদকে বিরোধিতা করেছিলেন, তিনি হলেন বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের (শ্যানন) বাবা খ্যাতিমান রাজনীতিক ও আইনজীবী অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক। সিরাজুল হক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহপাঠী। একইসঙ্গে পড়েছেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কও ছিল মধুর, সিরাজুল হকের ডাকনাম বাচ্চু। বঙ্গবন্ধুর ডাকনাম খোকা। দুজনের মধ্য সম্বোধন ছিল ডাকনামেই। সিরাজুল হক হাজী মুহম্মদ মুহসীন বৃত্তি পেয়েছিলেন। তা দিয়েই তিনি লেখাপড়া করেছেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদ সদস্য ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনি মোশতাকের মুখের ওপর তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি খুনি, রাষ্ট্রপতি হওয়ার এবং সভা ডাকার কোনো এখতিয়ার আপনার নাই, আপনি অবৈধ রাষ্ট্রপতি, আপনার সংসদ মানি না।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ছয় ঘণ্টার মধ্যেও খুনি সৈন্যরা ওই চার নেতার বাড়িতে যায়নি। তাঁরা বাড়ি থেকে সরে পড়ার যথেষ্ট সময় পেয়েছিলেন। কিন্তু একমাত্র ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ছাড়া বাকি তিনজনের কেউই বাড়ির বাইরে পা দেননি। আবার মনসুর আলী সাহেবও আত্মগোপন করেননি, তিনি ঢাকা শহরেই ছিলেন। খন্দকার মোশতাক তাকে বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানান। এটা ছিল লোক দেখানো। কেননা সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাঁকে ধরে এনে মোশতাকের সামনে হাজির করে। মোশতাক তাকে সেখানে সাদরে অভ্যর্থনা জানান এবং দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রক্ত মাড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে রাজি হননি ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেইমানি করতে পারব না। কাজেই আপনার মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময় ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর সমর্থন আদায়ের জন্য খুনি সৈন্যরা তাঁকে টেলিভিশনের সামনে উপস্থিত করে। তখন তাঁর মুখ ম্লান। চোখ দুটি অশ্রুসজল। তাঁর মুখ থেকে একটা কথা বের করাও খুনি সৈন্যদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। রাতে যখন টিভিতে এই অভ্যর্থনা পর্ব দেখানো হচ্ছিল, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী তখন জেলে।
এ এইচ এম কামারুজ্জামানকেও মন্ত্রিত্বের লোভ দেখানো হয়। ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর মতো তাঁর জবাবও একই ধরনের। তিনি জানান, ‘কবি নেই। সুর আর বাজবে না। আমার কবি নেই। কাজেই আমিও নেই।’
এ এইচ এম কামারুজ্জামান বঙ্গবন্ধুকে কবি বলে সম্বোধন করতেন। তাঁকে বলা হয়, রাজনৈতিক প্রয়োজনেই বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে তিনি ভেতরের জ্বালা চেপে রাখতে পারেননি। এ এইচ এম কামারুজ্জামান রাগান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, ‘দেন হোয়াই রাসেল? তাহলে রাসেলকে খুন করা হলো কেন? মাত্র ১০ বছরের নিষ্পাপ শিশু তোমাদের কাছে কী অপরাধ করেছিল?’
তাজউদ্দিনের ৩ কৌশলী শর্ত
ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে রাজি না হওয়ায় খন্দকার মোশতাক তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণের প্রস্তাব করেন। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধু নিজে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন। পরবর্তী সময়ে সংবাদপত্রে দেয়া এক বিবৃতি নিয়ে দুজনের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি হলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি পদত্যাগ করেন।
সেই তাজউদ্দীন আহমদকে খন্দকার মোশতাক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি কৌশলী অবস্থান নেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে মোশতাকের কাছ থেকে তিনটি শর্ত দিয়েছিলেন এবং এসব শর্ত মানতে লিখিত প্রতিশ্রুতি চেয়েছিলেন। শর্ত তিনটি ছিল :
১. বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা বলে ঘোষণা করতে হবে।
২. মুজিব ঘাতকদের বিচার করতে হবে।
৩. রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবেন নিয়মতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট। প্রধানমন্ত্রীর কাজে তিনি হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না।
খুব স্বাভাবিকভাবেই মোশতাকের পক্ষে তাজউদ্দীন আহমদের এই তিনটি দাবি মেনে নেয়া সম্ভব নয়। এগুলো মানতে গেলে যে ষড়যন্ত্রকারীদের বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। কাজেই তাজউদ্দীন আহমদকে শূন্য হাতেই ফিরিয়ে দেয়া হয়।
এর কয়েকদিন পরই (২৩ আগস্ট) সাজানো অভিযোগে সামরিক আইনের বিধিমালার আওতায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানসহ ২৬ জন এমপি-মন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। একই বিধিমালার আওতায় ২৫ আগস্ট সোমবার রাতে আরো দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। এরা হলেন- ক্যাবিনেট ডিভিশনের সচিব জনাব এইচ টি ইমাম এবং বন, মৎস্য ও পশুপালন দপ্তরের সচিব নুরুদ্দীন আহমদ।
তাজউদ্দীন আহমদের গ্রেফতার হওয়ার বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেছিলেন সান টেলিগ্রাফের সাংবাদিক পিটার লিগ। তিনি বলেন, ‘আমি যখন তার বাসভবনে যাই তখন দেখি তাজউদ্দীন আহমদ একজন সামরিক অফিসারের সঙ্গে জিপে উঠছেন। পুরো বাসভবন প্রায় ৩০ জন সৈন্য ঘিরে রেখেছিল। আরো কয়েকজন সৈন্য সামরিক বাহিনীর ল্যান্ডরোভারে বসা ছিল। আমি জিপের কাছে গিয়ে তাজউদ্দীন আহমদের কাছে জানতে চাইলাম, তিনি সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত নতুন সরকারে যোগ দিতে যাচ্ছেন কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘বোধ হয় না। আমাকে সামরিক ক্যাম্পে ডিটেনশনে নেয়া হচ্ছে।’
এইচ টি ইমামের ভাষ্য
এইচ টি ইমামকে নিয়ে যারা সমালোচনা করেন তারা বলেন, তিনি খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথ পড়িয়েছিলেন। এ বিষয়ে জনাব এইচ টি ইমামের ভাষ্য, “১৫ আগস্ট আগস্ট সকালে আমি টেলিফোনে তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলি। তারা বলেন, দ্যাখো কি হয়। এরই মধ্যে এদিন আর্মার্ড কোরের কালো পোশাকধারী সেনা সদস্যরা আমার বাড়ি ঘেরাও করে। তখন আমার বাড়িতে একটা গাড়ি আসে। সেই গাড়িতে তৎকালীণ ফরেন সেক্রেটারি ফখরুদ্দীন, আই জি নুরুল ইসলাম এবং ঢাকার ডিআইজি আসেন। তারা আমার বাড়ির ভেতরে ঢুকেই বলেন, তারা আপনাকে নিতে এসেছেন।
এদিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমার বাড়ির দোতালার বেডরুমে পর্যন্ত অবস্থান নেয়। তারা আমাকে বন্দুকের নলের মুখে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। বেতার ভবনে এসে দেখি খন্দকার মোশতাকসহ সমস্ত খুনিরা বসে আছে, সবার চোখ রক্তলাল, দেখেই বোঝা যায় এরা সদ্য খুন করে এসেছে। এরইমধ্যে আর্মি চিফ অব স্টাফ জেনারেল শফিউল্লাহ, এয়ার ফোর্স চিফ এ কে খন্দকার, নেভি চিফ অ্যাডমিরাল খান, পুলিশ প্রধান আইজিপি নুরুল ইসলাম খন্দকার মোশতাকের অনুগত্য ঘোষণা করেছে। খন্দকার মোশতাক আগে থেকেই আমার উপর ক্ষিপ্ত। কেননা আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাজউদ্দিন আহমদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ফলে আমাকে যখন খন্দকার মোশতাকের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো তিনি আমাকে দেখেই খুব বিরক্তির সঙ্গে তাকালেন। মোশতাক আমাকে বললেন, তাকে শপথ করাতে হবে। আমি তখন পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কিসের শপথ? তিনি বললেন, কেন! আমি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিবো! আমি বললাম, কিভাবে হবে, এখন তো সংবিধান আছে। আর সংবিধান অনুযায়ী উপরাষ্ট্রপতি আছেন। তিনিই রাষ্ট্রপতি হবেন। উনি বললেন, না! সংবিধান বলে কিছু নেই, আমি সব বাতিল করে দিচ্ছি। তোমাকে যেভাবে বলা হচ্ছে সেভাবে তোমাকে কাজ করতে হবে। তখন যারা আমাকে বন্দুকের নলের মুখে বেতার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছিলো তারা আবার ক্যাবিনেট ডিভিশন হয়ে আমাকে বঙ্গভবনে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখি সবকিছুই রেডি। আমাকে শুধু বলা হলো তুমি অনুষ্ঠান পরিচালনা করো। শপথবাক্য পাঠ করান প্রধান বিচারপতি সায়েম। শপথ অনুষ্ঠান শেষে আমার আর বাড়িতে যেতে দেয়া হয়নি। শুধু একদিন পাঠানো হলো। খন্দকার মোশতাক এতই কুটিল ও খারাপ মানুষ ছিলো যে, আমার স্ত্রীকে ফোন করে বললো, ‘তৌফিককে বাড়িতে পাঠাচ্ছি, বৌমা তুমি কিছু মনে করো না, ওকে অন্য কাজে পাঠাবো’। ওই রাতেই আমাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। অন্যান্য কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের চাইতেও আমি বেশি দিন জেলে ছিলাম। আমি প্রায় এক বছর ৯ মাস জেলে ছিলাম এবং অতি সাধারণ বিষয়ে আমার বিরুদ্ধে সামরিক আইনের বিধিমালার আওতায় দুটি মামলা হয়।”
খন্দকার মোশতাক তার ক্ষমতার মসনদ পাকাপোক্ত করতে সামরিক আইনের নীতিমালার আওতায় কয়েকদিন গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রাখেন এবং মোট ৭৫ জন ‘বাকশাল’ নেতাকে গ্রেফতার করেন।
পঁচাত্তরের ২৩ আগস্ট (শনিবার) রাতে সরকারি মুখপাত্র জানান, সামরিক আইনের বিধিমালার আওতায় নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এরা হলেন (১) জনাব মনসুর আলী, সাবেক সরকারের প্রধানমন্ত্রী, (২) সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক সরকারের উপরাষ্ট্রপতি, (৩) জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, সাবেক অর্থমন্ত্রী, পিতা মরহুম ইয়াসীন খান, দরদরিয়া গ্রাম, কাপাসিয়া এবং ৭৫১ সাতমসজিদ রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা, (৪) জনাব এ এইচ এম কামারুজ্জামান, সাবেক সরকারের মন্ত্রী, (৫) জনাব আবদুস সামাদ আজাদ, সাবেক সরকারের মন্ত্রী, (৬) জনাব কোরবান আলী, সাবেক সরকারের মন্ত্রী, (৭) শেখ আবদুল আজীজ এমপি ও সাবেক মন্ত্রী, (৮) জনাব আবদুল কুদ্দুস মাখন এমপি, (৯) খোন্দকার আসাদুজ্জামান, সচিব, পাট মন্ত্রণালয়, (১০) জনাব হাশেমুদ্দিন হায়দার ওরফে পাহাড়ী, পিতা এস কে নজীর, ১২৯ মালিবাগ, ঢাকা, (১১) জনাব আবিদুর রহমান, পিতা জনাব আবুল বাশার, ৬৬ বি রোড নম্বর ৩২, ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকা, (১২) জনাব আব্দুল মান্নান এমপি, (১৩) জনাব আনওয়ার জং এমপি, (১৪) জনাব মোফাজ্জল হোসেন ওরফে মায়া, (১৫) জনাব মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী ওরফে বেঙ্গা, (১৬) ডা. আসহাবুল হক এমপি, (১৭) জনাব মোহাম্মদ আফজাল ওরফে নান্টু, (১৮) জনাব জিনাত আলী, (১৯) ডা. হায়দার আলী, (২০) গাজী মোস্তফা কামাল (গামা), (২১) মি আলেকজান্ডার রোডারিস্ক, (২২) জনাব আব্দুল হাই, (২৩) মি. মানিক চৌধুরী, (২৪) জনাব এটিএম সৈয়দ হোসেন, (২৫) জনাব দেওয়ার হোসেন ও (২৬) জনাব মোসাদ্দেক আলী খান (বাবলা)।
(দৈনিক ইত্তেফাক: ২৪ আগস্ট, রবিবার, ১৯৭৫)
মোশতাকের মন্ত্রিসভায় ছিলেন যারা
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে মোশতাক আহমেদ মন্ত্রিসভা কার্যকর ছিল।
মন্ত্রিসভায় যারা ছিলেন তারা হলেন:
খন্দকার মোশতাক আহমেদ - রাষ্ট্রপতি
মোহাম্মদ উল্লাহ - উপরাষ্ট্রপতি
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী - পররাষ্ট্রমন্ত্রী
এম ইউসুফ আলী - পরিকল্পনামন্ত্রী
ফণীভূষণ মজুমদার - স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী
সোহরাব হোসেন - পূর্ত ও গৃহনির্মাণ মন্ত্রী
আব্দুল মান্নান - স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী
শ্রী মনোরঞ্জন ধর - আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী
আব্দুল মোমিন - কৃষি ও খাদ্যমন্ত্রী
আসাদুজ্জামান খান - বন্দর, জাহাজ চলাচল মন্ত্রী
ড. আজিজুর রহমান মল্লিক - অর্থমন্ত্রী
ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী - শিক্ষামন্ত্রী
প্রতিমন্ত্রী
শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন - বিমান ও পর্যটন
দেওয়ান ফরিদ গাজী - বাণিজ্য ও খনিজ সম্পদ
তাহেরউদ্দিন ঠাকুর - তথ্য, বেতার ও শ্রম
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী - শিল্প মন্ত্রণালয়
নুরুল ইসলাম মঞ্জুর - রেল ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়
কে এম ওবায়দুর রহমান - ডাক ও তার
মসলেম উদ্দিন খান হাবু মিয়া - পাট মন্ত্রণালয়
ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল - ত্রাণ ও পুনর্বাসন দফতর
রিয়াজউদ্দিন আহমেদ - বন, মৎস্য ও পশুপালন
সৈয়দ আলতাফ হোসেন - সড়ক যোগাযোগ
মোমেন উদ্দিন আহমেদ - বন্যা পানি বিদ্যুৎ
(দৈনিক ইত্তেফাক: ২১ আগস্ট, বৃহস্পতিবার)
প্রথম দিনের চাঞ্চল্যকর বেতার ভাষণের পর মোশতাক তার প্রথম ১০ দিনে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এর মধ্যে একটি ছিল জাতীয় পোশাক, যাতে ছিল কালো নেহরু টুপি, যা তিনি সব সময় পরতেন। এটি তখন লোকজন খুব একটা ব্যবহার করত না। খন্দকার মোশতাক কর্নেল তাহেরকে কথা দিয়েছিলেন তিনি তাহেরের দেয়া ৫টি প্রস্তাব অচিরেই কার্যকর করবেন। এই ৫টি প্রস্তাব ছিল এ রকম :
১. পুরোনো সংবিধান বাতিল
২. সারা দেশে সামরিক আইন জারি
৩. দলমত-নির্বিশেষে সমস্ত রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি
৪. আওয়ামী লীগ ছাড়া সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন।
৫. গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য অবিলম্বে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন।
খন্দকার মোশতাক সারা দেশে সামরিক আইন জারি করা ছাড়া কর্নেল তাহেরের কোনো প্রস্তাব আমলে নেননি। বরং ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শ্রী সমর সেনের সঙ্গে সাক্ষাতের পর খন্দকার মোশতাক জানান, আগের সরকার যেসব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মেনে চলত, তার সরকারও সেসব আইনকানুন অক্ষুণ্ন রেখে চলবে। অর্থাৎ তিনি বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করবেন না এবং পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো প্রকার কনফেডারেশন হবে না। মোশতাকের একই কথাটিও পুরোপুরি সত্যি ছিলো না। তিনি ভারতের ভয়ে বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ইসলামী প্রজতন্ত্র ঘোষণা না করলেও ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই তিনি বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ধারায় পরিচালিত করেন। একইসঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নিকট বার্তা পাঠান। পঁচাত্তরের ২৬ আগস্ট বার্তাসংস্থা রয়টার্স এ খবর প্রকাশ করে। পরদিন দেশের বিভিন্ন দৈনিক এ খবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে। দৈনিক ইত্তেফাকে এ সংক্রান্ত প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ছিল নিম্নরূপ-
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে
সম্পর্কের নয়া অধ্যায় সূচনার
অপেক্ষায় রহিয়াছি : প্রেসিডেন্ট মোশতাক
ইসলামাবাদ, ২৬ শে আগস্ট (রয়টার) : পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর নিকট প্রেরিত এক বার্তায় বাংলাদেশের নয়া রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ব্যাপারে স্বীয় ইচ্ছা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করিয়াছেন। গত রাতে বার্তাটি এখানে প্রকাশ করা হয়।
বার্তায় রাষ্ট্রপতি মোশতাক বলেন যে, বাংলাদেশের সরকার জনস্বার্থে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায়ের সূচনাএবং উপ-মহাদেশের দেশসমূহের মধ্যকার সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রত্যাশা লইয়া অপেক্ষা করিতেছে। (দৈনিক ইত্তেফাক : ২৭ আগস্ট, বুধবার)
কোনো কোনো লেখক-গবেষক বঙ্গবন্ধু হত্যাকে একটি বিবাহবার্ষিকীর ঘটনার ফল বলে উল্লেখ করেছেন। ওই বিবাহবার্ষিকী ছিল মেজর ফারুকের। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও বাংলাদেশ রেডক্রসের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফার পুত্র নাকি মেজর ডালিমের পত্মীকে অপমান করেছিল। তারই প্রতিক্রিয়ায় একদল সৈনিক গাজী গোলাম মোস্তফার বাড়ি আক্রমণ করে। পরিণামে দুজন মেজরসহ সেনাবাহিনীর একদল সৈন্যকে ছাঁটাই করা হয়। একশ্রেণির লেখক বলতে চান, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য ওই ঘটনাই দায়ী।
কিন্তু এই হত্যার ঘটনাকে একটু গভীরভাবে খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, সমীকরণটি অত সরল নয়। যে ষড়যন্ত্রের সঙ্গে দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীর দল জড়িত সেই ষড়যন্ত্র ওই বিবাহবার্ষিকীর ছোট্ট ঘটনার ফলে গড়ে উঠতে পারে না। এ ষড়যন্ত্র যদি কয়েক মেজর আর সৈনিকের হতো, তবে পঁচাত্তরের সেই বীভৎস কালো রাতে গাজী গোলাম মোস্তফার বাড়ি আক্রান্ত হতো। কিন্তু তা হয়নি।
কাজেই এটা সহজেই বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধু ও তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের হত্যার সঙ্গে ওই বিবাহবার্ষিকীর ঘটনার কোনো যোগাযোগ নেই। এ হত্যাকাণ্ডের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উৎখাত করা। বঙ্গবন্ধু সকল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গরিব ও দুঃখী মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, শ্রমজীবী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে যেসব কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন, সেসব প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করা। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনাকে বিতাড়িত করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ধারায় পরিচালিত করা। অর্থাৎ আমাদের এই রাষ্ট্র ও সমাজকে সম্পূর্ণভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উল্টো দিকে ধাবিত করা।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর কয়েকজন আত্মীয়কে হত্যা করে এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে যে, লাখ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু নাকি ‘নতুন বাদশাহি’ পেতে বসেছিলেন এবং এ কাজে তাঁর ভাগনে ও ভগ্নিপতি ছিলেন সহযোগী। তাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাদেরকেও উৎখাত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল উদ্দেশ্যকে আড়াল করতেই এই হত্যার কারণ হিসেবে কট্টর বাম, কট্টর ডান, স্বাধীনতাবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এ রকম বিভিন্ন গল্প ফাঁদেন। তারা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু তা দিয়ে প্রকৃত সত্যকে কোনো দিনই চাপা দেয়া যায় না...
পুনশ্চ :
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরই স্বাধীনতাবিরোধী পাক-মার্কিন চক্র নানা কৌশলে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন উদ্যোগ ও পদক্ষেপের সমালোচনা শুরু। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ গণমাধ্যম চক্রান্তকারীদের সুরে সুর মেলায়। ওই সময় সাপ্তাহিক বিচিত্রার ছিল একটি বিচিত্র ভূমিকা। এ বিষয়ে কোনো এক পর্বে বিস্তারিত তুলে ধরার আশা রাখছি।
লেখক : সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ
[ বি.দ্র : পরবর্তী পর্ব প্রকাশ হবে আগামী ৯ অক্টোবর, বুধবার। ]