বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা বইয়ের সংখ্যা কম নয়। জন্মশতবর্ষেও তাঁকে নিয়ে বের হয়েছে অসংখ্য বই। তবে জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ঠিক কতগুলো বই স্বাধীনতার এই রূপকারকে নিয়ে বের হয়েছে বা হচ্ছে, সেই হিসাব দিতে পারেননি কেউ। আবার খুব কম সময়ের মধ্যে প্রচুর বই প্রকাশিত হওয়ায় সেগুলোর মান নিয়েও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো বই না পড়ে সেটার মান বিচার করা সম্ভব নয়। তবে একটি মানসম্মত বই লেখা এবং প্রকাশ করার ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। যখন কেউ স্বল্প সময়ে প্রচুর বই বের করবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই মান খারাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে যেহেতু অনেক বই বের হয়েছে বা হচ্ছে, তাই সেগুলো কতটা মানসম্মত, তা ভেবে দেখা দরকার।
অন্যদিকে কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে বই কেনার বরাদ্দ থাকায় অনেকে শুধু বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে জাতির জনককে নিয়ে যেনতেনভাবে বই বের করছেন। অল্প সময়ের মধ্যে লেখা এবং সম্পাদনা করায় এসব বইয়ের না আছে মান, না আছে নতুনত্ব। অনেকে আবার বিভিন্ন বই থেকে কপি-পেস্ট করেই প্রকাশ করছেন নতুন বই।
এতে একদিকে যেমন পাঠক ঠকছেন, তেমনি নষ্ট হচ্ছে টাকা। ইতিহাস বিকৃতির শঙ্কাও থাকছে বলে মনে করেন বিভিন্ন লেখক, গবেষক ও প্রকাশকরা। তাদের মতে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রকাশিত বইগুলোর যথাযথ পর্যালোচনা করে সেগুলোর ভালো-মন্দ প্রচার করে, তাহলে পাঠকরা উপকৃত হতেন।
মানসম্মত বই কোনটি?
লেখক, গবেষক ও প্রকাশকদের মতে, মানসম্মত বই হলো লেখায় কোনো চৌর্যবৃত্তি না থাকা, নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে তথ্য নেওয়া ও সেটা উল্লেখ করা, গবেষণার যথাযথ পদ্ধতি মেনে চলা, উদ্ধৃতি সঠিকভাবে উপস্থাপন করা, যথাযথভাবে সম্পাদনা করা এবং নকলের বিষয়টি এড়িয়ে চলা। এভাবেই একটি মানসম্মত বই প্রস্তুত হয়।
প্রকাশকদের কথা
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে মোট ২০টি বই প্রকাশ করছে শ্রাবণ প্রকাশনী। যার মধ্যে ১৮টি বই এরই মধ্যে ছাপা হয়ে গেছে। এই প্রকাশনীর প্রকাশক রবিন আহসান জানান, তারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রকাশিত প্রতিটি বইকে মানসম্মত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। তাদের প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে ১০টি আগেই বিভিন্ন সময় প্রকাশিত হয়েছে, যা এখন আবার পুনঃপ্রকাশ করা হয়েছে। নতুন প্রকাশিত বইগুলোতেও কোনো তাড়াহুড়া করা হয়নি।
তবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে কয়েক হাজার বই বের হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এসব বইয়ের মান নিয়ে সবার মতো আমরাও শঙ্কিত। কারণ বেশির ভাগ বই-ই পাতাকাটা বই। শুধু বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়েই হয়তো ১০০টি বই ছাপানো হয়েছে। এটা যে যেভাবে পারছে, সেভাবে ছাপিয়ে ফেলেছে। বঙ্গবন্ধুর বই ছাপানোর একটি বাণিজ্যিক দিক হলো, যারা ক্ষমতাশালী এবং যাদের লোকজন আছে তারা এসব বই দিয়ে নানাভাবে টাকা উপার্জন করছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে তার নাম করে যত বই বের হয়েছে, সেগুলো দিয়ে একটি চরম বাণিজ্য হয়েছে এবং হচ্ছে।”
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে খারাপ বইয়ের সংখ্যাই বেশি মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্রেফ বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে এটা করা হয়েছে। এখানে বঙ্গবন্ধু বা রাষ্ট্রের জন্য ভালোবাসা নেই। যে কারণে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভালো মানের বইয়ের সংখ্যা খুবই কম হয়েছে। এটা আমাদের ব্যর্থতা।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ের প্রকাশক ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল) এবার বঙ্গবন্ধুবিষয়ক ৫টি নতুন বই প্রকাশ করার পরিকল্পনা করেছে। ইউপিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দীন বলেন, “আমরা অনেক বাছাই এবং যথাযথ সম্পাদনা শেষ করেই বই প্রকাশ করি। তাই সংখ্যার দিক দিয়ে অনেক বই এবার করছি না। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আমাদের ৫টি বই করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে করোনার কারণে কাজের আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় এ বছরজুড়ে আমরা পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করব।”
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রকাশিত বই কতটা মানসম্মত, এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “কোনো বই না দেখে সেটার মান নিয়ে কথা বলা খুবই মুশকিল। তবে বই নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা হলো— যখনই অনেক দ্রুত সময়ের মধ্যে আপনি কিছু তৈরি করবেন বা সংখ্যার দিকে বেশি ঝোঁক দেবেন, তখন হয়তো মানের দিকে আপস করতে হয়। বইয়ের মান ঠিক রাখতে হলে পাণ্ডুলিপি বাছাই ও সম্পাদনার ওপর যে গুরুত্ব দিতে হয়, তাতে বহুসংখ্যক বই প্রকাশ করাটা কঠিন। এ ছাড়া পুনরাবৃত্তিমূলক কিংবা জোড়াতালি দেওয়া বই প্রকাশের সংস্কৃতিকে আমরা একেবারেই সমর্থন করি না।”
মাহরুখ মহিউদ্দীন আরও বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে ইউপিএলের আগেও অনেকগুলো গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশ করেছে, এগুলো আকর গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে। নিছকই নতুন বই প্রকাশ করার জন্য বই বের করার চাইতে অল্প কিছু বাছাই করা ভালো বই প্রকাশ এবং এই পুরোনো মানসম্পন্ন বইগুলোর যথাযথ প্রচারটিকেও আমরা গুরুত্বের সাথে নিয়েছি যেন নতুন প্রজন্মের পাঠকরা এই বইগুলো সম্পর্কে জানতে পারেন।”
লেখক ও গবেষকরা যা বলেন
এ বিষয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক নির্বাহী পরিচালক, গবেষক ও লেখক মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রকাশিত হওয়া বই মানসম্মত কি না, তা বিচার করা খুব মুশকিল। তবে কিছু কিছু বই পড়ে আমার কাছে মানসম্মত মনে হয়নি। অনেক সময় দেখা যায়, বইগুলো কপি-পেস্ট করে লেখা হচ্ছে, একই বক্তব্যের হয়তো পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। যেটি আমাদের জন্য খুব প্রয়োজন ছিল, তা হলো একটু গবেষণামূলক ও বিশ্লেষণধর্মী বই। তাহলে আমাদের জন্য ভালো হতো।”
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “এ ক্ষেত্রে যারা বই লিখবেন, তাদের যেমন প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে, তেমনি তৎকালীন রাজনীতি সম্পর্কে সম্মুখ ও পরিপূর্ণ ধারণা থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক বই ও উপন্যাস বাজারে বের হয়েছে। যার দু-একটা আমি পড়েছি। সেখানে দেখা যায় যে ওই জায়গাগুলোতে ঘাটতি আছে। যারা লিখেছে তাদের অনেকের এই উপমহাদেশের রাজনীতি, তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনীতি, স্নায়ু যুগের পর্যায়ে বিশ্বের যে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ছিল, সে বিষয়গুলো সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা নেই। যার কারণে বইগুলোতে প্রত্যাশিত মানের লেখা পরিবেষ্ট হয়নি।”
এই লেখক আরও বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বইগুলো মনিটর করার ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হয়নি। এ ক্ষেত্রে একটা বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে বইগুলোকে যাচাই-বাছাই করে কিছু বইকে পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলে পাঠকরা ভালো বইগুলো পড়তে পারত। এখন যেটা হচ্ছে মানুষ শুধু নাম দেখে বা প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে বই কিনছে।” অনেক বই লেখা হচ্ছে, অনেক তথ্য দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু প্রত্যেক বইয়ে তথ্যসূত্র পাওয়া যায় না। ফলে তথ্যগুলো সম্পর্কে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় বা এগুলো আদৌ সত্য কি না, তা নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগে। সব মিলিয়ে এ ক্ষেত্রে আরও একটু নজর দেওয়া দরকার বলে মনে করেন এই লেখক।
বেসরকারি টেলিভিশন ৭১ টিভির বার্তা সম্পাদক ও লেখক শেখ সাদী বলেন, “ভালো-মন্দ তো সবকিছুতে থাকে। কোনো বইয়ের মান নির্ধারণ করাটাও খুব মুশকিল। অনেক ভালো বই যেমন হচ্ছে, তেমনি বাণিজ্যিক সুবিধার জন্যও কিছু বই করা হচ্ছে। অনেকে কোনো না কোনো সুবিধার জন্য বা নিজেকে আওয়ামী লীগ প্রমাণ করার জন্য বই বের করছে। এগুলোর বেশির ভাগই হচ্ছে সম্পাদিত বই।”
শেখ সাদী আরও বলেন, “যিনি বই সম্পাদনা করছেন, তিনি আসলে ওই বইটা সম্পাদনা করার মতো কতটা যোগ্যতা রাখেন, সেটা একটা প্রশ্নের বিষয়। একজন সম্পাদকের বই সম্পাদনার ক্ষেত্রে অনেক দায়িত্ব থাকে। সেটা খুব একটা হচ্ছে বলে মনে হয় না। আমাদের দেশে এমনিতেই পাঠকের সংখ্যা খুবই কম। মানুষ বই কিনতে চায় না, পড়তে চায় না। তার ওপর যদি মানহীন, ভুল তথ্য ও ভুল সম্পাদনার বই পাঠকের হাতে যায়, তাহলে বই পড়ার ক্ষেত্রে আরও অনাগ্রাহ সৃষ্টি হবে। আমরা আরও পাঠক হারাব।”
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বের হওয়া বইগুলোর কোনো পর্যালোচনা হচ্ছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এই কাজটা বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর করতে পারত। তারা লেখকদের কাছ থেকে বই নিয়ে সেগুলো পর্যালোচনা করে ভালো বইগুলো প্রচার করতে পারত। তাহলে পাঠকরা বুঝতে পারত এই বইগুলো মানসম্মত। এ ছাড়া আমাদের বই নিয়ে বলার মতো কোনো পত্রিকা নেই, বই পর্যালোচনা করার কোনো জায়গা নেই। ফলে অনেক ভালো বই পর্যালোচনা হয় না।”
বইয়ের সংখ্যা কত জানে না কেউ
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ঠিক কতগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে বা হচ্ছে, তা জানে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ বলেন, “এই পরিসংখ্যানটা যেকোনো একজন দিতে পারবে না। তবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি একবার প্রকাশকদের কাছ থেকে তালিকা চেয়েছিল। প্রকাশকরা সেই তালিকা জমা দিয়েছেন। সুতরাং ওই কমিটি কোনো একটা তালিকা প্রণয়ন করে থাকলেও থাকতে পারে বা তাদের কাছে সংখ্যাটা থাকতে পারে। আমরা সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির পক্ষ থেকে ২০১৯ সালে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই নিয়ে তালিকা করেছিলাম। সেই তালিকায় চার হাজারের বেশি বই ছিল। তবে সেখানে মুজিব বর্ষে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছিল না।”
প্রকাশকদের কাছ থেকে তালিকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। তবে তিনি জানান, তারা এখনো কোনো তালিকা প্রকাশ করেননি। এটা প্রক্রিয়াধীন আছে। বাংলা একাডেমির কাছে কোনো পরিসংখ্যান থাকলেও থাকতে পারে।
এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগের পরিচালক মোবারক হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ব্যস্ততার কারণে তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।