মাছে-ভাতে বাঙালি জাতি। বাঙালিয়ানা খাবারই প্রিয় সবার। এর ব্যতিক্রম ছিলেন না জাতির জনক, বাঙালির মুক্তির রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
উচ্চতায় ৬ ফুট, সুঠাম দেহের গড়ন। দেশ-বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন শতবার। তবু বাঙালি খাবার দেখলেই আত্মতৃপ্তি নিয়ে খেতে বসতেন। বাংলাকে যিনি ভালোবেসেছেন, বাংলার স্বাধীনতায় যিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন, তাঁর পছন্দের তালিকায় বাঙালি খাবার ছাড়া আর কী হতে পারে। ভালোবাসতেন কই মাছ ভেজে খেতে। দেশীয় মাছের তরকারি দিয়ে সাদা ভাত সবই খেতেন আত্মতৃপ্তি নিয়ে।
ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধুর প্রিয় ছিল মাছ। তা-ও দেশীয় প্রজাতির মাছ খেতে ভালোবাসতেন। টেংরা, পুঁটি, পাবদা, মলা, কইসহ নানা দেশীয় মাছ ছিল তাঁর পছন্দের তালিকায়। আর এই সবই খেতেন সাদা ভাত দিয়ে। সঙ্গে ডাল আর করলাভাজি দিয়ে বেশ জমে উঠত তাঁর ভোজন।
শুধু তা-ই নয়, দুধ-কলা দিয়ে গরম ভাত মাখিয়ে খেতেও ভীষণ ভালোবাসতেন। সঙ্গে গুড় মিশিয়ে নিতেন। ছোটবেলায় এই খাবার না খেলে নাকি তার খাওয়াই পূর্ণতা পেত না।
বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তাঁর একান্ত সচিব অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণা করে তিনি লিখেছিলেন, “টেংরা, পুঁটি, পাবদা, সাদা ভাত, ডাল, করলা, মলা আর সবজি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রিয় খাবার। দুধ-কলা-গুড় দিয়েও ভাত খেতেন সব সময়।”
বঙ্গবন্ধুর পছন্দের খাবার নিয়ে বেশ লেখা আছে ‘কারাগারের রোজনামচা’য়। ‘কারাগারের রোজনামচা’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত গ্রন্থ সংকলন। এর নামকরণ করেছেন মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা। ২০১৭ সালে মুজিবুর রহমানের ৯৮তম জন্মবার্ষিকীতে গ্রন্থটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়।
কারাবন্দি অবস্থায় খাবারকে কীভাবে উপভোগ করেছেন বঙ্গবন্ধু, তারও বিশদ আলোচনা রয়েছে এই গ্রন্থে। ‘কারাগারের রোজনামচা’য় তিনি লিখেছেন, “রেণু কিছু খাবার দিয়ে গেছে। কই মাছ খেতে ভালোবাসতাম, তাই ভেজে দিয়ে গেছে।”
শুধু তা-ই নয়, কারাবন্দি জীবনকে উপভোগ করতে রান্নাও করতেন বঙ্গবন্ধু। পটোলভাজি, ইলিশ মাছসহ নানা রান্নাই শিখেছেন ওই সময়। খুব বেশি জ্ঞান ছিল না রান্নায়, তবু শখের বশেই রান্না করে খাওয়াতে ভালোবাসতেন। সঙ্গীদের নিয়ে, কখনোবা কারাগারে অতিথি কাউকে বসিয়ে নিতেন নিজের সঙ্গে। যেমন খেতে ভালোবাসতেন, তেমনি ভালোবাসতেন খাওয়াতে।
কারাগারের রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু রান্না নিয়ে কৌতুককর বর্ণনাও দিয়েছেন। জানিয়েছেন কলিজা, ফলি মাছ, খিচুড়ি রাঁধতে গিয়ে কী ধকলই না পোহাতে হয়েছে তাঁকে। তবে হাল না ছেড়ে, ভালোবাসা থেকেই রেঁধেছেন। সব খাবারই বেশ উপভোগ করেছেন কারাগারে থাকা তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে।
বঙ্গবন্ধুর প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল ‘মুড়িমাখা’। সাধারণ এই খাবারটি অনেক তৃপ্তি নিয়ে খেতেন এবং ভীষণ পছন্দ করতেন। ‘কারাগারের রোজনামচা’য় মুড়িমাখা নিয়ে বঙ্গবন্ধু বিবরণও দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “আমার বাড়িতে মুড়ি খাবার অভ্যাস। কাঁচা মরিচ, পিঁয়াজ, আদা আর সরিষার তৈল দিয়ে একবার মাখলে যে কী মজা তাহা আমি প্রকাশ করিতে পারি না। আমার না খেলে চলে না।”
কারাবন্দি অবস্থায়ও সঙ্গীদের নিয়ে উপভোগ করেছেন মুড়িমাখা। গ্রন্থটিতে তিনি লিখেছেন, ‘আমার মুড়ি জেলখানায় খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সিপাহি, জমাদার ও কয়েদিদের মধ্যে অনেকে পালিয়ে মুড়ি খেতে আসে।”
বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুরের প্রিয় খাবারগুলো নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতেন বেগম মুজিব। ছিল না কোনো সরকারি বাবুর্চি। যখন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু, তখনো নিজ হাতে বেগম মুজিব রান্না করে খাইয়েছেন। টিফিন ক্যারিয়ার করে খাবারও দিয়ে দিতেন। যাতে দেওয়া থাকত কই মাছ, সবজি, লতি, ডাল আর সাদা ভাত। চার-পাঁচজন ভরপেট খেতে পারতেন সেই খাবার। খাবারের পর মিষ্টি খেতে ভালোবাসতেন। তাই ডেজার্ট হিসেবে থাকত ডিমের পুডিং। জানা গেছে, এক আঙুল দিয়েই পুডিং খেয়ে নিতেন বঙ্গবন্ধু।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু গাইবান্ধার রসমঞ্জুরী অনেক পছন্দ করতেন। ঐতিহ্যবাহী ও সুস্বাদু মিষ্টিজাতীয় খাবার এটি। এছাড়া নাটোরে এলেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাতের সঙ্গে খেতেন ছাঁটা ডাল। মুগ ডাল ঘিয়ে ভেজে তৈরি হতো এই ছাঁটা ডাল। বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক কারণে নাটোর ভ্রমণকালে এই খাবারই ছিল তাঁর পছন্দের।
এমন নানা স্মৃতির কথা শোনা যায় বঙ্গবন্ধুর প্রিয় খাবার নিয়ে। দেশ-বিদেশ ঘুরেছেন, নানা দেশের নানা খাবারও খেয়েছেন। তবে চাকচিক্য জীবনের আড়ালে ব্যক্তিগত বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাধারণ একজন। তাই সাধারণ বাঙালি খাবারগুলো ছিল তাঁর কাছে অসাধারণ। সারা দিনের ক্লান্তি শেষে এই খাবারগুলোতেই খুঁজে পেতেন আত্মতৃপ্তি।