নয়ন আলমের মন আজ একদম ভালো নেই। ভালো থাকবে কীভাবে! স্ত্রী শেফালির সঙ্গে যে খটমটে লেগেই আছে সবসময়; চলছে কথা-কাটাকাটি।
কোনোভাবে নয়নকে সহ্য করতে পারছেন না শেফালি; এমনকি ঝগড়ার অজুহাতে তিলকে বানাচ্ছেন তাল। নয়ন সব বুঝতে পারলেও পরিস্থিতি কিছুতেই সামাল দিতে পারছেন না।
সকাল থেকে নয়ন একটুও স্বস্তি পাননি। বারবার মনে পড়েছে রাতের কথা। একবারের জন্য কালরাতে দুচোখের পাতা জোড়া লাগেনি।
শেফালির সঙ্গে রাতে ভীষণ ঝগড়া হয়েছে নয়নের। বিষয় অতি সামান্য। অথচ সামান্য বিষয়টাকে নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড বাধালেন শেফালি। হয়তো সুযোগ বুঝে মনের মধ্যে লুকায়িত এতদিনের ক্ষোভ শেফালি উগরে দিয়েছেন; কিংবা নিজের অন্য কোনো উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য বেছে নিয়েছেন এমন এক কৌশল।
নয়ন ভেবে পান না, মেয়ে মানুষের মাথায় এত কম বুদ্ধি থাকে! নিজে যা ভালো মনে করে সেটাই যেন তাদের কাছে জগতের শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত। তখন কারও পরামর্শ গ্রহণ করতে তারা রাজি নয়। এমনকি যুক্তির মর্ম হয়ে ওঠে অর্থহীন।
প্রাতরাশ না করেই নয়ন নীরবে চলে যান অফিসে। তিনি যখন বের হন, তখন ঘুমে ছিলেন শেফালি। তিনি স্ত্রীকে ডাকেননি ইচ্ছে করে।
অফিসের কোনো কাজে নয়ন সামান্যতম মন বসাতে পারেননি। বারবার তাকিয়েছেন ঘড়ির দিকে। আর সময়ের হিসাব করেছেন। এক সহকর্মী এগিয়ে এসেছিলেন তার এমন অস্থিরতার কারণ জিজ্ঞেস করতে, তিনি মুখের ওপর এমন কথা বলেছেন যে সহকর্মীটি আঘাত পেয়ে সরে গেছেন।
সকালে তো নয়ই, দুপুরেও নয়ন কিছু মুখে দিতে পারেননি। আর এখন বিকেল। কিছুক্ষণের মধ্যে বের হতে হবে। কিন্তু অস্বস্তি ভাবটা কিছুতে কাটছে না। বুকের ওপর যেন চেপে বসে আছে একটা পাথর।
হঠাৎ নয়নের মনে পড়ে এক বন্ধুর কথা। কিছুদিন আগে বন্ধুটি স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়ার কারণে অফিসের চেয়ারে বসা অবস্থায় হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। এ কথা মনে হতেই চিনচিনে একটা ব্যথা শুরু হয় বুকের ভেতর। নিজেকে স্থির রাখতে পারছেন না তিনি। তারও যদি ওইরকম কিছু হয়ে যায়!
নয়ন ইচ্ছে করে শেফালিকে সারাদিন ফোন করেননি। ফোন দেওয়ার ইচ্ছে জাগলেও সংযত রেখেছেন নিজেকে। মনে ক্ষীণ আশা ছিল শেফালি ফোন দিয়ে হয়তো সরি বলবেন, যেমন আগে বলতেন। এরকম ঝগড়া তো অনেকবার করেছেন তারা।
একবার ঝগড়া করে নয়ন দুইদিন বাসায় ফেরেননি। খুদেবার্তা বিনিময় করেছিলেন শুধু। পরে শেফালি ক্ষমা চাওয়ায় তিনি ফিরে আসেন বাসায়। অথচ আজ তিনি তেমন কিছুই দেখতে পারছেন না। না, শেফালি একবারও ফোন দেননি। এমনকি খুদেবার্তা পর্যন্ত নয়।
কিছুটা সংকোচ আর কিছুটা ভয় নিয়ে নয়ন বাসায় ফিরেন সন্ধ্যার একটু আগে। এ কী দেখছেন তিনি! দরজায় তালা। খেয়াল করেন, একটা চিরকুট ঝুলছে তালার সঙ্গে। পাশের বাসায় চাবি রেখে শেফালি চলে গেছেন। তিনি লিখেছেন যে, আর কখনো এই বাসায় ফিরবেন না।
মাথায় হাত দিয়ে নয়ন সিঁড়িতে বসে পড়েন। তার মাথা যেন কাজ করছে না। বিশ বছরের সংসারজীবনে এমন কাজ শেফালি কখনো করেননি। ঝগড়া যে হতো না, তা নয়। সে যে বাঙালি-জীবনে দাম্পত্যের অনুষঙ্গ। এমনও দিন গেছে একটানা একমাস তাদের মধ্যে বাক্যালাপ বন্ধ ছিল; তবু শেফালি ঘর ছাড়েননি। সেই দিনগুলোতে তিনি কষ্ট পেতেন। কিন্তু অন্যদের সঙ্গে এসব সমস্যা নিয়ে কথা বলতেন না।
এদিকে ছেলে অর্ণব তার অবাধ্য। তাদের দাম্পত্য সংকটকে বাড়িয়ে দিয়েছে আদরের ছেলেটি। নয়ন যদি পূর্বে যেতে বলেন অর্ণব যায় পশ্চিমে। অর্ণব তার কাছে টাকা চায় কেবল। টাকার বাইরে যেন বাপ-ছেলের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।
নয়ন ভালো করে জানেন, ছেলেটা নষ্ট হয়েছে শেফালির কারণে। এক সন্তান বলে অর্ণবের সব ধরনের আবদারকে শেফালি বরাবরই প্রশ্রয় দিয়েছেন।
ছেলেকে নয়ন কোনোদিন শাসন করতে পারেননি। শেফালি করতে দেননি; বলতেন, আমার ছেলেকে তুমি কখনো কিছু বলবে না। আর একটি কাজ শেফালি অতিমাত্রায় করতেন, তা হলো ছেলের সঙ্গে জোঁকের মতো লেগে থাকা।
কলেজে ওঠার পর থেকে অর্ণব তাদের কোনো কথাই শোনে না। কিছু বললেই শুরু করে জিনিসপত্র ভাঙা। মাঝে মাঝে কয়েক দিনের জন্য উধাও হয়ে যায় সে। কোথায় যাচ্ছে তা মা-বাবাকে জানানোর প্রয়োজনীয়তা পর্যন্ত বোধ করে না।
দিন দিন অর্ণবের আচরণ রহস্যময় হয়ে ওঠে। কথা বলে না মা-বাবার সঙ্গে। তাকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করা যায় না। কোনো প্রশ্ন করলে প্যাঁচানো উত্তর দেয়। প্রায়ই বন্ধু নিয়ে ঘরে এসে বন্ধ করে দেয় দরজা। কখনো সে বাসায় নিয়ে আসে অসমবয়সী বন্ধু।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় অর্ণব দরজা খোলে না। খাওয়া-দাওয়ারও ঠিক নেই। রাতে জেগে থাকে; সারাদিন ধরে ঘুমায়। কলেজেও যায় না ঠিকভাবে। অর্ণবের রুম থেকে তারা টের পান একটা অচেনা দুর্গন্ধ। বের হওয়ার সময় সে রুমে তালা দিয়ে যায়। রুমটা পর্যন্ত পরিষ্কার করতে দেয় না।
ছেলের দুশ্চিন্তায় আর স্ত্রীর যন্ত্রণায় নয়ন এখন ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগী। এই জীবন নিয়ে তিনি কী করবেন! এই জীবনের কোনো মানে আছে! বয়স তো খুব বেশি হয়নি। অথচ এই বয়সে রোগে-শোকে যন্ত্রণায়-কষ্টে তিনি হয়ে গেছেন অশীতিপর বৃদ্ধের মতো।
কষ্টের মুহূর্তগুলোতে মনে ভাসে তার যমজ ভাই সুমনের কথা। জীবন নিয়ে সুমন ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন বলে নয়ন বিশ্বাস করেন। সত্যি বলতে কি, তিনি ঈর্ষা করেন সুমনকে।
সুমন চিরকুমার। ঝাড়া হাত-পা। থাকেন ছোট বোনের বাসায়। সাবলেটে। থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে মাস শেষে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা গুনে দেন বোনের হাতে। প্রেমে ব্যর্থতার কারণে বিয়ে করেননি সুমন। তবে কেউ কেউ অন্য কথাও বলত তার সম্পর্কে। তবু তো নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। অন্তত নয়নের কাছে। তার মনে হয়, বিয়ে না করাটাই সুমনের জীবনের উত্তম সিদ্ধান্ত।
নয়ন মাঝে মধ্যে ভাবেন, বিয়ে করে তিনি কী এমন পেয়েছেন? তার কি বাড়তি দুটি হাত গজিয়েছে? বরং পদে পদে মনে হচ্ছে, তার সব শক্তি শেষ হয়েছে তিলে তিলে। বিয়ের আগ পর্যন্ত যে নয়ন প্রাণবন্ত ছিলেন, বন্ধুরা যাকে ঈর্ষা করত, সেই নয়ন আজ পরিণত হয়েছেন আস্ত একটা অথর্বে।
নয়ন জানেন, তার পাশে এখন কেউ নেই। শেফালির কারণে তিনি একে একে হারিয়েছেন সবাইকে; যাপন করছেন নিঃসঙ্গ জীবন। কারও সঙ্গে যে দুদণ্ড মনের কথা বলবেন এমন কেউ নেই তার।
দুই.
দরজা খুলে নয়ন সোজা বিছানায় চলে যান। লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েন বাইরের পোশাক পরিবর্তন না করে। তার খুব কান্না পাচ্ছে। কষ্টে ফেটে যাচ্ছে বুক। রাগ-অভিমান ভুলে শেফালির নম্বরে ফোন দেন। যতবার ফোন দেন ততবার এক কথাই শুনতে পান—সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
কিছুক্ষণ পর নয়ন উঠে বসেন। হাত-মুখ ধুয়ে কফি বানান। কফি মুখে দিতেই অরুচি লাগছে। কোনো স্বাদ পাচ্ছেন না। টিভি অন করতে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে আগুন লাগার একটি খবর দেখে মনে পড়ে তার পুরোনো কথা। সময় যে কীভাবে চলে যায়!
নয়নের জন্ম চট্টগ্রামে। শৈশব-কৈশোর এমনকি শিক্ষাজীবনও কেটেছে চট্টগ্রাম শহরে। পড়েছেন চট্টগ্রাম কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। কত সুন্দর ছিল সেসব দিন! তারা দুই ভাই ও এক বোন। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে সেখানকার বহুতলা কলোনির সরকারি কোয়ার্টারে থেকেছেন তারা। কোনো অভাববোধ কিংবা সমস্যা ছিল না তখনকার জীবনে। কত নির্মল ছিল প্রতিটি মুহূর্ত।
শেফালির সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর থেকে নয়নের জীবনের ছন্দপতন ঘটে। বিয়ে তিনি নিজের পছন্দে করেননি। করেছিলেন মা-বাবার ইচ্ছাতে। যাকে ভালোবাসতেন সে যখন তাকে ছেড়ে চলে যায়, তিনি জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন; তার ভেতরে দেখা দেয় বৈরাগ্য। তখন বাবা জোর করে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মেয়ে শেফালির সঙ্গে নয়নকে বিয়ে দেন। শেফালির রূপের প্রশংসা করত না, এমন কেউ ছিল না। নয়ন রীতিমতো পরিণত হয়েছিলেন বন্ধুদের ঈর্ষার পাত্রে।
প্রথমদিকে তিনি স্ত্রীকে বুঝতে পারেননি। শান্তশিষ্ট মনে হয়েছিল শেফালিকে। বিয়ের বছর খানেক পর প্রকাশ পায় শেফালির প্রকৃত চেহারা; বেরিয়ে পড়ে তার আসল রূপ যা নয়ন ভাবতেও পারেননি। ধীরে ধীরে তার নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন শেফালি। একপর্যায়ে তিনি বদলি হয়ে ঢাকায় আসতে বাধ্য হন। ফেলে আসেন তার আজন্মলালিত শহর।
শেফালি পুরোপুরি পাল্টে যান অর্ণবের জন্মের পর। তখন শেফালিকে তার মানসিক রোগী বলে মনে হতো। কাউকে বাসায় আসতে দিতেন না। নয়ন একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তখন থেকে। ভাই-বোনের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রাখতেন গোপনে। কখনো তার মনে হতো, তিনি পাগল হয়ে যাবেন। তবু তো চলে যাচ্ছিল একরকম। আজ যেন হয়ে গেছে তার চূড়ান্ত মীমাংসা।
উদ্ভূত সংকট নিয়ে বিপর্যস্ত নয়ন কার সঙ্গে কথা বলবেন—এমন ভাবতেই মনে পড়ে বোনের কথা। ভাইবোন ছাড়া তার কে আছে! মা-বাবাকে তো সেই কবে হারিয়েছেন। ঢাকায় আসার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তারা। ইস্, তিনি যদি তখন ওই গাড়িতে থাকতেন। এখন একসঙ্গে থাকতে পারতেন ওই দুনিয়ায়। এই নরক যন্ত্রণা তাহলে ভোগ করতে হতো না।
পারুল তার একমাত্র বোন। বয়সে দুই ভাইয়ের চেয়ে পারুল পাঁচ বছরের ছোট। থাকেন ওয়ারির র্যাংকিন স্ট্রিটে।
পারুলকে ফোন করবেন কি করবেন না এ রকম দোদুল্যমানতার একপর্যায়ে পারুলের কল দেখে চমকে ওঠেন তিনি। এই সময়ে বোনের ফোন পেয়ে অমঙ্গল আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে বুক। কিছুটা দ্বিধা নিয়ে ফোন ধরতেই বোনের কান্নাজড়িত গলা—সুমন ভাই আর নেই।
নেই মানে? কোথায় গেছে? নয়নের কণ্ঠে আর্তনাদ।
ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। সারাদিন ঘুম থেকে ওঠেনি। ডাকতে গিয়ে টের পাই। তার টেবিলের ওপর একটি চিঠি পেয়েছি। তুই তাড়াতাড়ি আয়। ফোঁপাতে ফোঁপাতে পারুল কথাগুলো বলেন।
দুই কানকে নয়ন বিশ্বাস করতে পারছেন না। শুরু করেন হাউমাউ। কিছুক্ষণ পর শান্ত হয়ে বেরিয়ে পড়েন। রিকশা নিয়ে সোজা পারুলের বাসায়।
এটা কী করল সুমন! তিনি তো সুমনকে তাঁর চেয়ে সুখী ভাবতেন। তাহলে সুমন কেন আত্মহননের পথ বেছে নিল।
পারুলের এগিয়ে দেওয়া চিঠিটা পড়া শুরু করেন তিনি।
‘এই জীবনের কোনো মানে নেই। প্রতি রাতে যখন নিঃসঙ্গতা ঘিরে ধরে, আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। এভাবে কি মানুষ বেঁচে থাকতে পারে! একটা সময় ছিল, তখন মনে হতো জীবনে প্রয়োজন অবাধ স্বাধীনতা। চিরকুমার থাকার শপথ নিয়েছিলাম। পঞ্চাশ পেরোনোর পর মনে হচ্ছে, বিয়ে না করা ছিল জীবনের চরম ভুল। মা-বাবা চলে যাওয়ার পর পাশে কেউ নেই। বন্ধুরা ব্যস্ত নিজের সংসার নিয়ে। প্রয়োজনে কাউকে পাশে পাই না।
অথচ আমার সমবয়সী ভাই নয়ন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কত সুখে দিনযাপন করছে। আর আমি? এভাবে কতদিন? আর পারছি না সহ্য করতে। তাই জীবনটা শেষ করে দিলাম। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।’
তিন.
সুমনের আত্মহত্যা নয়নের ভেতর নতুন কোনো উপলব্ধির জন্ম দেয় না। বরং জীবনের প্রতি আরও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি।
শেফালিকে বারকয়েক ফোন দেন। ফোন বন্ধ। অপারেটর সেই একই কথা বলছে। ফোন দেন অর্ণবকে। অর্ণব জানায়, সে ব্যস্ত। কথা বলার সময় নেই। পরে ফ্রি হয়ে কল দেবে।
পারুলকে কিছু না বলে নয়ন বেরিয়ে পড়েন; একটা রিকশা নিয়ে পৌঁছে যান বাবুবাজার ব্রিজের নিচে। তারপর সিঁড়ি ভেঙে উঠে যান বুড়িগঙ্গা সেতুতে।