আত্মমর্যাদার নীতি

জাপান-রুশ যুদ্ধ: প্রযুক্তির আপন ও পর

ফিরোজ আহমেদ প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২১, ০৫:২২ পিএম জাপান-রুশ যুদ্ধ: প্রযুক্তির আপন ও পর

সামুরাই আর শোগানদের যুগ পেছনে ফেলে জাপান কত দ্রুত আধুনিক প্রযুক্তিতে এগিয়ে গিয়েছিল, তার একটা নজির দুনিয়ার সামনে তারা রেখেছিল ১৯০৫ সালে সুশিমার নৌযুদ্ধে রাশিয়ার নৌবহরের মূল অংশটিকে বিধ্বস্ত করে, অবশিষ্ট রুশ জাহাজগুলো আত্মসমপর্ণে বাধ্য হয়। একইসময়ের স্থলযুদ্ধেও রুশরা পরাজিত হয়েছিল। সেই নৌযুদ্ধে নতুন একটা প্রযুক্তি বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল, এবং এই প্রযুক্তির উদ্ভাবনেও  বিশেষভাবে নাম জড়িয়ে আছে বাঙালি এক বিজ্ঞানী ও তাঁর যুগান্তরকারী আবিষ্কারের: জগদীশ চন্দ্র বসু এবং তার সমকালীনদের উদ্ভাবিত বেতার যন্ত্র।

কিন্তু শুধু সর্বাধুনিক প্রযুক্তি থাকলেই যে চলে না, বরং একটা নতুন প্রযুক্তি সমাজে কতভাবে আত্মস্থ হতে পারে, এবং ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তিকে সমাজে আত্মীকৃত করবার ফলাফলও যে ভিন্ন হয়, একটা বিপর্যয়কর যুদ্ধের প্রস্তুতির বিবরণের মধ্য দিয়েই সেই গল্পটা বলা যাক। এই যুদ্ধে রুশ ও জাপানী সমাজের ক্ষমতাবানদের ভাবনা ও কর্মে প্রকাশিত হয়েছিল প্রযুক্তিকে সমাজ ও রাষ্ট্রের আত্মীকৃত করবার পৃথক দুটো পদ্ধতির দুটো নমুনা, দুটোর ফলাফলও ছিল দুই রকম। কিন্তু শুধু প্রযুক্তিকে নিজেদের সমাজে আত্মীকৃত করা ও তা থেকে যন্ত্রপাতি নির্মাণ নয়, আমাদের আজকের এই গল্পটা বিশেষভাবে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানকে আত্মীকৃত করবার বিষয়েও।

প্রায় কাছাকাছি সময়েই জাপান ও রাশিয়া উভয়েই তখনকার সর্বাধুনিক তারহীন যোগাযোগ প্রযুক্তি বেতার-টেলিগ্রাফের সাথে পরিচিত হয়। জাপানীরা প্রযুক্তিটার ব্যবহার প্রথম দেখে যুক্তরাষ্ট্রে, ১৮৯৭ সালে। সাথে সাথেই তারা উপলদ্ধি করে, এই প্রযুক্তি শুধু যোগাযোগের ব্যবস্থার নয়, যুদ্ধের হিসাব-নিকাশও বদলে দেবে। কিন্তু প্রযুক্তিটির প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করলেও গরিব জাপানের কাছে যন্ত্রটাকে কেনা ব্যয়বহুল মনে হওয়াতে তারা নিজেরাই বেতারযন্ত্র তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়, অধ্যাপক সানকিচি কিমুরার নেতৃত্বে তারা একটা বেতার গবেষণা পরিষদ গঠন করে। নিবিষ্ট গবেষণা ও পরীক্ষানীরিক্ষার মধ্য দিয়ে ১৯০১ সালের মধ্যে তারা মোটামুটি ৭০ মাইল দূরত্ব পর্যন্ত যোগাযোগে সক্ষম বেতার প্রযুক্তির অধিকারী হয়ে ওঠে। এবার জাপানী নৌবাহিনী বেতারপ্রযুক্তিটি নিজেদের যোগাযোগের জন্য গ্রহণ করে। ১৯০৩ সলে প্রযুক্তিটির অধিকতর উন্নয়ন ও পণ্য আকারে উৎপাদনের জন্য জাপানেই গবেষণাগার ও কারখানা নির্মাণ করা হয়। কষ্টের টাকার যথাসাধ্য বিবেচক ব্যবহার কাকে বলা যায়, সেটাই তারা দেখিয়েছিল বেতার প্রযুক্তি সমাজে আত্মীকৃত করবার বেলায়।

রুশ প্রজারাও গরিব ছিল বটে, তবে জাপানী প্রজারাই ছিল তুলনামূলকভাবে বহুগুন বেশি গরিব। কিন্তু ওদিকে রুশ অভিজাত জমিদাররা ছিল দুনিয়ার মাঝে অন্যতম ধনী আর ফূর্তিবাজ, তাদের সাথে জাপানী কিংবা আর কারও তুলনা চলতো না, শুধুমাত্র ভারতীয় রাজরাজরা আর জমিদাররা কাছাকাছি যেতে পারতো। আর এই রুশ জমিদাররা সংখ্যাতেও ছিল অগণ্য, রাশিয়া তখন পৃথিবীর সব চাইতে বড় স্থলসাম্রাজ্য, আজকের রাশিয়ার সাথে তখন যুক্ত ছিল মধ্য এশিয়া, ককেশাস ও পূর্ব ইউরোপের অনেকগুলো দেশ। তখন তো চলছে রুশ জারদের একক শাসন। যোগ্য মানুষ দেশে অনেক ছিলেন, তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গাগুলো ছিল সব মোসাহেব স্বভাবের লেখক-সাংবাদিক-বণিক-অধ্যাপক ইত্যাদির দখলে। কে কার চেয়ে বড় মোসাহেব তাই ছিল প্রতিযোগিতার বিষয়, জারকে খুশী করাতেই তাদের সকলের আগ্রহ। টাকা তো কোন বিষয়ই ছিল না—চাষারা যোগাতো বিপুল খাজনা, এদেশেও এখন যেমন পোষাক খাতের কিংবা প্রবাসী শ্রমিকরা জোগান।

জাপানীদের বেশ আগেই বিখ্যাত রুশ বিজ্ঞানী আলেক্সান্ডার স্তেপানোভিচ পোপোভ নিজ দেশেই বেতার প্রযুক্তিকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন; ১৮৯৫-৯৬ সালে তিনি তার প্রযুক্তির কার্যকারিতা হাতে কলমে প্রদর্শনও করেন। কিন্তু প্রজাপীড়ক এবং পরান্মুখ শাসকগোষ্ঠীর বেলাতে যা ঘটে, রুশদের বেলাতেও তাই ঘটলো। নিজেদের সংস্কৃতির চাইতে, নিজেদের সম্ভাবনার বিকাশের চাইতে রুশ অভিজাতরা যেমন অন্যদের সংস্কৃতিকে বেশি গৌরবের মনে করতো, অনুকরণ করতো, তেমনি ভাবেই নিজেদের বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের সম্ভাবনাকেও এই অভিজাতগোষ্ঠী ততটা উচ্চচোখে দেখতো না। ফলে নিজেদের বিজ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষকতা না দিয়ে রুশরা কিনলো দেখেশুনে সবচে দামী, সবচে অগ্রসর, সবচে চোখ ধাঁধানো—হ্যাঁ, অত্যাধুনিক জার্মান বেতার যন্ত্র। ধরেই নেয়া হয়েছিল যে রুশদের প্রযুক্তিগত সামর্থ্য নাই,  তারচেয়ে জার্মান যন্ত্র ভালো।

তাই নিয়ে কিন্তু দেশজুড়ে হৈচৈ পড়ে গেলো, রুশরাও কত ‘এগিয়ে গেছে', তারা আর পিছিয়ে নেই, জার্মান বেতার যন্ত্র তারা নিজেদের নৌবহরে যুক্ত করেছে—সরাসরি সম্প্রচারের যুগ না হওয়াতে এমন প্রচার ঠিক আজকের যুগের মত না হলেও, খুব কম হয়নি। এই জার্মান বেতার কেনার বাণিজ্যে কে কত ভাগ পেয়েছিল, তার খুঁটিনাটি বিবরণ ইতিহাস বইতে বিস্তারিত না পাওয়া গেলেও রুশ কর্মকর্তারা যে ভয়াবহ দুর্নীতি পরায়ন ছিলেন, সেটা জানা যায়। তবে মূল বিষয় ছিল ওইটাই, খাজনা যখন আসছে এত অঢেল, চাষারা যেহেতু টু শব্দটি করতে পারে না প্রবল নিপীড়নের ভয়ে, তখন কে আর কষ্ট করে দেশে কারখানা বানায়! বরং এসব গবেষণা ও উদ্ভাবনের বিপদ বহু। সেটার জন্য দরকার নানান উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান, দরকার সত্যিকারের শিক্ষা। দরকার শিশুদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আগ্রহী করা। কিন্তু যত বেশি লোককে সত্যিকারের শিক্ষা দেবে, তত বেশি তারা বেয়াদব হতে থাকবে, অবাধ্য হবে, প্রশ্ন করবে। নিজেদের সমরশক্তি বৃদ্ধির প্রয়োজনে দেশের প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে একদিকে তাই রুশ জারদের কিছুটা আগ্রহ যেমন ছিল, তেমনি এটার রাজনৈতিক ফলাফলটাকে তারা অনেক বেশি ভয়ের চোখেও দেখতো। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রসর দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে রাজনীতিরও কেন্দ্র ছিল, স্বাধীনতার কেন্দ্র ছিল, মুক্ত চিন্তার কেন্দ্র ছিল, সেটা জাররা খুব ভালোই জানতো। ফলে শিক্ষার জন্য যতটুকু জানালা তারা উন্মুক্ত করেছিল, তার চাইতে বেড়া দেয়ার চেষ্টাই থাকতো তাদের বেশি।

 

২.

এশিয়াতে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের কাড়াকাড়িতে অবেশেষে জাপান-রুশ যুদ্ধটা যখন লাগলো, এই প্রযুক্তির আত্মীকরণের বিষয়টা ভীষণ বড় হয়ে দেখা দিলো। রুশদের জার্মান প্রযুক্তির বেতার অনেক বেশি কার্যকর, সেটা সত্যি ছিল। কিন্তু তবু, জাপানিরা নিজেদের তৈরি করা প্রযুক্তির যন্ত্রে নিজেরা নিজেদের ভাষায় যোগাযোগ করলো, নষ্ট হলে নিজেদের কারিগরই সব ঠিকঠাক করার কাজ করলো। নিজেরাই প্রয়োজনীয় উন্নয়নটা করে নিলো। বুঝতেই পারছেন, ওদিকে রুশদের কী দশা ঘটলো অত দামী জার্মান বেতার যন্ত্র দিয়ে, যার খুচরা যন্ত্রাংশ বিদেশী, প্রযুক্তি বিদেশী, কারিগর বিদেশী। প্রচুর ভুল বোঝাবুঝি যেমন হলো, তেমনি যন্ত্র অচল হলে বসেও থাকতে হলো কারিগরি জ্ঞানের অভাবে। কপাল ভালো বলতে হবে রুশদের, স্বয়ং জার্মানদের সাথেই যুদ্ধটা হয়নি। ইতিহাস ঘেঁটে যে কেউ সুশিমার নৌযুদ্ধের ইতিহাসের ফলাফলটা দেখে নিতে পারেন, সংক্ষেপে এখানে এইটুকু বলা যায় যে, এই প্রথম একটা এশীয় শক্তি নৌযুদ্ধে কোন ইউরোপীয় শক্তিকে পরাস্ত করলো, এই পরাজয়ের পরিণতিতে রাশিয়ার চীনে আগ্রাসনের পরিকল্পনা স্থগিত হলো, দীর্ঘমেয়াদে এই যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় ১৯০৫ সালে জারবিরোধী ব্যর্থ বিপ্লবটি সংঘটিত হলো এবং রাশিয়া জুড়ে অভিজাতদের রাষ্ট্রবিরোধী এবং পরান্মুখ নীতির বিরুদ্ধে একটা আত্মসচেতনতাবোধের জোয়ার তৈরি হলো।

যুদ্ধটুদ্ধ বাদ দিলেও, ইতিহাসের এই অধ্যায় থেকে আরও শেখার কিছু আছে।  প্রযুক্তি কখন একটা সমাজে প্রধানত শৌখিন, বিলাসি দ্রব্য বা দুর্নীতির হাতিয়ার কিংবা চোখধাঁধানো চমক হয়, কখন প্রযুক্তি সমাজের ভেতর থেকে বদল আনে জ্ঞানটাকে আত্মস্থ করে, খোলনলচে পালটে দেয়ায় ভূমিকা রাখে, সেটাই আসলে সব চাইতে বড় কথা। ভাড়া করা প্রযুক্তিবিদ, পরিকল্পনাবিদ আর আর প্রকৌশলীদের এনে নির্মাণযজ্ঞটি যে উন্নয়ন নয়, উন্নয়ন মানে হলো নিজের ভাষায়, নিজের সংস্কৃতিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে আত্মীকৃত করে নিজেদের সক্ষম করে তোলা, ১৯০৫ সালের সুশিমা কাণ্ডে সেটা আরেকবার প্রমাণিত হয়েছিল।