বাংলায় বিশ্বজ্ঞান প্রচারে নাকি সব চাইতে বড় বাধা হলো পরিভাষার অভাব! এই প্রশ্নটাকে দুইভাবে দেখা উচিত। একটা তো ভাষার সাথে পরিভাষার সম্পর্ক বিষয়ক ভাষাতাত্ত্বিক প্রশ্ন, আরেকটা হলো ইতিহাস এ বিষয়ে কী সাক্ষ্য দেয়, সেই প্রসঙ্গটি। প্রথমটার উত্তর নানান সময়ে ভাষাতাত্ত্বিকরা দিয়েছেন, আমাদের এই লেখাগুলোতে আমরা চেষ্টা করেছি ইতিহাস খুড়ে খুড়ে দ্বিতীয় দিকটার উদাহরণগুলো দেখাতে। আসলেই পরিভাষা বিষয়ক এই প্রশ্নটা কোন নতুন কিছু নয়, কয়েক হাজার বছর ধরেই এমন প্রশ্ন থেকে থেকে উঠেছে: দরিদ্র একটা ভাষা কিভাবে সমৃদ্ধ একটা ভাষার ভাব প্রকাশ করবে!
কল্পনাতীত, কিন্তু সত্যিকারের একটা বাস্তবতা হলো এই যে, ভাষার এই কথিত দারিদ্র বিষয়ে আমাদের জানা সবচাইতে পুরাতন খেদোক্তিটা এমন একটা ভাষাকে নিয়ে, যে ভাষাটা আসলে পৃথিবীর ইতিহাস এবং পৃথিবীর ভূগোলের দীর্ঘতম পরিসর জুড়ে একটা বিরাট অঞ্চলে জ্ঞান বিজ্ঞানের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভাষা ছিল; সেটা ল্যাতিন ভাষা। কিন্তু সেই ল্যাতিন ভাষাটি শুরুতে অত্যন্ত নগণ্য ভাষাই ছিল, আর তার সাক্ষ্য দিয়েছেন এই ভাষার একজন গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ।
রোম নগরী একটা পরাশক্তি হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় খ্রিস্ট জন্মের দেড়শত বছর আগেই রোমানরা গ্রিস উপদ্বীপ দখল করে নেয়, কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার দিক দিয়ে তখনও রোমানদের ভাষাটির দশা ছিল বেশ নাজুক। নগরের অধিকাংশ উপনিবেশের বাসিন্দাই রোমানদের চাইতে জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন-ভূগোলে বহুদূর এগিয়ে ছিলেন। বহুক্ষেত্রেই দেখা যাবে, যুদ্ধবন্দী হিসেবে রোমের বাজারে কেনাবেচা হওয়া গ্রিক ও ইহুদি বা মিশরীয় নাগরিকেরা তাদের অশিক্ষিত রোমান মালিকদের চাইতে বহুগুন জ্ঞানী ছিল।
শিক্ষার গুরুত্ব উপলদ্ধি করে রোমানরাও তাদের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য গ্রিস ও মিশরের শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে পাঠাতেন, বিশেষ করে গ্রিক দর্শন, বিজ্ঞান, গণিত ও বাগ্মীতা শিক্ষার জন্য। খ্রিস্ট জন্মের ৯৯ বছর আগে জন্ম নেয়া রোমান কবি ও দার্শনিক লুক্রিশাস ছিলেন গ্রিক জ্ঞানবিজ্ঞানের একজন মুগ্ধ অনুরাগী। বিশেষ করে গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরাসের (৩৪১-২৭০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) দার্শনিক চিন্তা লুক্রিশাসকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল, এবং তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন রোমান ভাষায় নিজের সমভাষীদের সামনে সেগুলোকে তুলে ধরার জন্য। (প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো যে, বহু পরেকার আরেকজন দার্শনিক কার্ল মার্কসকেও এপিকিউরাসের দর্শন টেনেছিল, তার পিএইচডির বিষয় ছিল এপিকিউরাসের দর্শন।)
লুক্রিশাসের মনে হয়েছিল গ্রিকদের এই দার্শনিক আবিষ্কারগুলো আমাদের জানাশোনা বহু সত্যকে বাতিল করে দিয়ে গভীর, নিগূঢ়, অন্ধকার সত্যকে উন্মোচিত করেছে। রোমান ভাষাতে এপিকিউরাসের আলো ছড়িয়ে দিতে চাইলেও লুক্রিশাসের সামনে একটা বাস্তব সমস্যা ছিল, সেটা হলো ল্যাতিন ছিল অত্যন্ত দরিদ্র একটা ভাষা। লুক্রিশাসের নিজের কথায়:
“এটাও আমার নজর এড়িয়ে যায়নি যে, গ্রিকদের অন্ধকার আবিষ্কারগুলোকে ল্যাতিন ভাষাতে স্পষ্ট আলোয় উপস্থাপন করার কাজটা কঠিন, আমাদের ভাষার দুর্বলতা এবং বিষয়বস্তুর নতুনত্বের কারণে যখন অনেক জিনিসকে আবশ্যিকভাবেই একেবারে নতুন শব্দ দিয়ে প্রকাশ করতে হয়।”
ল্যাতিন ভাষার এই হতদরিদ্র দশা কি লুক্রিশাসকে থামিয়ে দিয়েছিলো? না, কারণ তার মাঝে কাজ করেছিল অন্য একটি প্রেরণা। রাতের পর রাত লুক্রিশাস জেগে থেকেছেন এই হতদরিদ্র ভাষাতেই গ্রিক দর্শনের গভীর, বিস্তৃত, বিকল্পহীন চিন্তার দ্যুতিকে মাতৃভাষায় প্রকাশ করবার মত শব্দের সন্ধানে। তার নিজের ভাষাতেই তিনি বর্ণনা করছেন নিজের ভাষার মানুষের কাছে এপিকিউরাসের চিন্তাকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তিনি যে তাড়না অনুভব করেছেন তার কথা, যে তাড়না:
“আমাকে যে কোন ক্লেশের ভার বহন করার প্রেরণা যোগায়, নিস্তব্ধ রাতগুলোতে জাগিয়ে রাখে, হাতড়ে বেড়াতে থাকি কোন শব্দ, হ্যাঁ, আর তার কোন মাত্রার প্রয়োগ আমি করতে পারি তোমার হৃদয়ের সামনে একটি উজ্জ্বল আলো বিস্তারের জন্য, যার মাধ্যমে তুমি নিগূঢ় বিষয়গুলোর গভীর অন্তস্থল পর্যন্ত দেখতে পাবে।”
অনুবাদক হিসেবে লুক্রিশাসের নিজের এই বর্ণনাকে বলা যায়, একজন কবি ভাবপ্রকাশের উপযোগী যথার্থ শব্দের সন্ধানে যে যন্ত্রণা ভোগ করেন, তার সাথে তুলনীয়। জীবনানন্দ দাশ যেমন কবির শিল্পসন্ধানের তুলনীয় বর্ণনাই দিয়েছিলেন:
“মাঝরাতে মোম যারা জ্বালে,
রোগা পায়ে করে পায়চারি,
দেয়ালে যাদের ছায়া পড়ে সারি সারি
সৃষ্টির দেয়ালে ,”
২.
পরবর্তী দেড় হাজার বছর ধরে যে লাতিন রাজত্ব করেছে দর্শন আর বিজ্ঞানে, ভাষা হিসেবে তার উপযুক্ত হয়ে উঠবার প্রক্রিয়ার অন্তত অর্ধেকটা বোঝা যাবে লুক্রিশাসের মাতৃভাষা নিয়ে এই অনুযোগে। বাকি আধখানা বোঝা যাবে মাতৃভাষাকে যোগ্য করে তুলতে লুক্রিশাসের (এবং তার মত আরও অনেকের) সংগ্রামে।
লুক্রিশাসরা দরিদ্র বলে মাতৃভাষাকে পরিত্যাগ করেননি, গ্রিক ভাষা শ্রেষ্ঠতর বলে তাকে কেবল পূজার আসনে বসিয়ে রাখেননি। সাধ্যমত গ্রিক জ্ঞানকে লাতিন ভাষায় তর্জমা করেছেন, ছড়িয়ে দিয়েছেন। প্রসঙ্গক্রমে, লুক্রিশাসের কল্যাণেই এপিকিউরাসের দর্শনচ্ছটা আধুনিক কাল পর্যন্ত পৌঁছুতে পেরেছে, মূল গ্রিক ভাষায় তার কয়েকটি পত্রই কেবল টিকে ছিল।
এর অর্ধ সহস্রাব্দ কিছু পর আরবরা তখনকার পৃথিবীর ইতিহাসে সবচে বড় অনুবাদের প্রকল্প সমাধা করলো বলেই রুশদ, বেরুণী, ইদ্রিসী, খলদুন আর সীনাদের মত জ্ঞানীদের জন্ম হলো। আরও হাজার দেড়েক বছর পরে কালে কালে জার্মান, ইংরেজি, রুশ এই্ সব ভাষাও চিন্তার বাহন হয়ে উঠলো একই সড়ক ধরে। আজকের চীনা, জাপানী কোরিয় ভাষার ইতিহাস এর থেকে আলাদা কিছু নয়। বাংলাভাষাকে এই দুস্তর পরীক্ষার সাগরে যারা ভাঙা নাওয়ে ততোধিক ভাঙা বৈঠা নিয়ে এখনও ভাসিয়ে রেখেছেন, সেই অনুবাদকদের পরিশ্রমের পরিমাপ আসলে সম্ভব না। ভাষার শক্তিমত্তা বৃদ্ধিতে যোগ্য অনুবাদকের ভূমিকা তুলনীয় হতে পারে কেবল কবির সাথে।
সন্দেহাতীতভাবেই, শিল্পসৃষ্টির দিক দিয়ে ভাষাকে সমৃদ্ধ করার গৌরবে সকলের চাইতে এগিয়ে থাকবে কবির সৃজনশক্তি। তবুও নিজের জায়গাতে অনুবাদকরা অনন্য, একেকটা ভাবকে আরেকটি ভিন্ন জবানে প্রকাশের যে ভার তারা বয়ে চলেন, তার যোগ্য বিনিময় বাংলাদেশ এখনো বলবার মত কিছুই দিচ্ছে না, বাংলা ভাষার ইতিহাসে অনুবাদকরা এমনই শহীদ।