ভারতের তুর্কি সুলতানরা রাজভাষা হিসেবে দাপ্তরিক সকল কাজকর্মে সুসমৃদ্ধ ফার্সি ভাষাটিকেই ব্যবহার করতেন। এই কারণে সুলতানী আমলেই ভারতজুড়ে একটা বিশাল ফার্সি সাহিত্যের ঐতিহ্য গড়ে ওঠে, এছাড়া ছিল হিসাবনিকাশ ও নানান নথিপত্রের সূত্রে ফার্সি গদ্যের ভাণ্ডার। ওদিকে শাসনতন্ত্রের প্রধান কেন্দ্রগুলোতেও কিন্তু অধিকাংশ মানুষ ফার্সিভাষী হয়ে ওঠেনি। বরং স্থানীয় ভাষা আর বহিরাগত তুর্কি-ফার্সি-আরবী ভাষী জনগোষ্ঠীর ভাষার মিলমিশে নতুন একটা নাগরিক ভাষা গড়ে ওঠে, হাটবাজারের সেই হিন্দাভি ভাষাই পরবর্তীকালের হিন্দি ও উর্দু ভাষার পূর্বসূরী। ভারতের প্রেক্ষিতে তুর্কি শাসন কেবল প্রজার কাছ থেকে খাজনা আদায়ের ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তারা বহু প্রযুক্তি, বাণিজ্যপথ, শাসন ও সংগঠন ব্যবস্থাও ভারতে প্রবর্তন বা পুনঃপ্রবর্তন করেছিল। ফলে আইন-প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের সাথে সম্পর্কিত বহু শব্দই নতুন এই ভাষাগুলো থেকে ধার করা হয়েছিল, একই কারণে, একই কথা বাংলা ভাষার জন্যও প্রযোজ্য।
তুর্কি সুলতানদের পর এলো মোগল শাসন, তারাও তাদের পারিবারিক চাগতাই তুর্কি ভাষা ত্যাগ করে ফার্সি ভাষা গ্রহণ করে। মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দীন মোহাম্মদ বাবরের আত্মজীবনী তুজুক-ই-বাবর লেখা হয়েছিল মাতৃভাষা চাগতাই তুর্কি ভাষাতেই, যদিও বিশেষজ্ঞরা দেখিয়েছেন সেটা ছিল বিপুল পরিমানে ফার্সি প্রভাবিত। সম্রাট আকবরের আমলে সকল মোগল দলিলপত্রাটি ফার্সিতে অনূদিত হয়, বাবরের আত্মজীবনীও। ওদিকে মোগল আমলেই জনগণের মাঝে হিন্দাভির প্রচলন আরও গভীর হয়। দরবারী কবিরা লিখতেন ব্যাকরণমার্জিত ফার্সিতে; কিন্তু বাজারের লুটোপুটি খাওয়া হৈহুল্লোর, রুটি-মদ-আগুনে ঝলসানো কিংবা বিরহকাতর লোককবিরা চর্চা করতেন আটপৌরে কিন্তু জীবন্ত ভাষা হিন্দাভিতে। সম্রাট আওরঙ্গজেব আরবী, ফার্সি, তুর্কি সমেত অনেকগুলো ভাষা জানতেন, সংস্কৃতভাষাতে তিনি আমের নামকরণ করেছেন এমন দৃষ্টান্তও দেখি তার চিঠিপত্রে। ফার্সিতে কথা বলতে পছন্দ করতেন উপযুক্ত লোকের সাথে, দেশোয়ালীদের সাথে বাধ্য হয়ে বলতেন হিন্দাভি। কিন্তু দেশীয় ভাষায় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়াটা সাধারণভাবে মোগল রীতি ছিল না, কোন সাম্রাজ্যই সেই চেষ্টা সাধারণত করেও না, কেননা ভাষার সাথে বিকেন্দ্রিত প্রাদেশিকতা ও প্রাদেশিক স্বার্থ তৈরি হয়।
সম্রাট আকবর তাই গুজরাট দখল করা মাত্র সেখানকার স্থানীয় কবিরা বিজাপুরসহ অন্যান্য দাক্ষিণ্যাত্যের দরবারগুলোতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি, আকবরের আমলে এবং এর পরেও ফার্সি ভাষাকে স্থানীয় শব্দগুলোর দূষণ থেকে মুক্ত রাখতে একাধিকবার বিশুদ্ধ ফার্সি শব্দের অভিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। ওদিকে বিজাপুরের সুলতান ইব্রাহিম আদিল শাহ (রাজত্বকাল ১৫৩৫-৫৮) হিন্দাভিকে রাজভাষা ঘোষণা করেছিলেন, বাংলার সুলতানরাও মোগলদের হাতে পড়ার আগ পর্যন্ত বাংলাকে উৎসাহিত করতেন, এই পৃথকতার অনুভূতিকে শক্তিশালী রাখবার জন্যই। হিন্দাভীর খুব বড় পৃষ্ঠপোষকতার উৎস ছিল এই প্রাদেশিক সুলতান ও নবাবদের দরবারগুলো।
কিন্তু আওরঙ্গবেজের পরই মোগল সাম্রাজ্য বিকেন্দ্রীত ও দুর্বল হতে থাকে। ফার্সি পণ্ডিতদের দিল্লীতে আগমন হ্রাস পায়। সম্রাট ফররুখশিয়রের আমলে দিল্লীর দরবারে কোন ফার্সি রাজকবি ছিলেন না। আওরঙ্গজেবের নাতি মোঘল শাহজাদা মির্জা মোহাম্মদ রাফি সহ অন্যান্য রাজপুত্রদেরও আমরা পাই হিন্দাভীতে কবিতা চর্চা করছেন এবং পুরনো সামরিক-বেসামরিক আমলাদের পাশাপাশি নতুন বণিকশ্রেণির হাতে বিপুল অর্থ আসে। এরা হিন্দাভীভাষীই ছিলেন।
নগরগুলোতে শৈশব-কৈশোর কাটানো বহু যোগ্য কবি দ্বিধায় পড়তেন, কবিতার ভাষা নিয়ে। ফার্সিতে লিখবেন না কেন? বনেদী ভূমিকেন্দ্রিক আমীর-ওমরাওদের নজরে পড়তে হলে ফার্সি ভাষায় লেখা চাই, সেটা ছাড়া ইজ্জত কিংবা আর্থিক নিরাপত্তা অর্জন করা কঠিন। আমজনতার হিন্দাভী অধিকাংশ মির্জা ততটা পাত্তা দেন না। কিন্তু মানুষের জয়ধ্বনি শুনতে হলে কিংবা প্রেমকাতর একাকী গানটি দিয়ে কারও চোখে জল আনতে হলে চাই জীবন্ত মানুষের ভাষাতেই গান রচনা; তাছাড়া আভিজাত্য না থাকলেও নগরবাসী নতুন বণিকরাও এদেরই প্রধান পৃষ্ঠপোষক। পুরনো অভিজাতরা কেউ কেউ অবশ্য এদের বলছেন ‘সিংহের বিদায়ে শেয়ালের রাজত্ব’। উর্দু কবিতা এভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ায় ফার্সি কবিতার। এই দ্বিধাতুর সময়টা নিয়ে অজস্র গল্প আছে। একটা গল্প এমন:
আশিকি আমিমাবাদী শব্দের অনুশীলন এবং ভাষার ভাবগাম্ভীর্য ধরে রাখতে ফার্সি কবিতার চর্চা করতেন। তার ওস্তাদ সিরাজউদ্দীন খান আরজুর কাছে তিনি যেতেন সেগুলো দেখিয়ে নেয়ার জন্য, সংশোধন আর পরামর্শ দরকার তরুণ শিষ্যের। একদিন খান-ই আরজু তাকে বললেন, “ফার্সি কবিতার স্থান অতি উচ্চে, কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু আমাদের ভাষা তো হিন্দি। হিন্দের মানুষ যদি ফার্সির মর্যাদা বহুগুণ বৃদ্ধি করেও থাকে, তবুও তো যাদের সেটা মাতৃভাষা, সেই ইরানের মানুষ আর অতীতের সেইসব ফার্সি কবিদের সামনে আমাদের প্রয়াসগুলো যেন সূর্যের সামনে বাতি জ্বালানো। বরং এখনও রেখতা [হিন্দাভীর আরেকটি নাম] ভাষায় কোন বড় ওস্তাদ নাই। তো আমরা যদি এই প্রাদেশিক ভাষায় চেষ্টা করি, আমরাও সঙ্গতভাবেই দুনিয়ার এই অংশের ওস্তাদ হয়ে উঠবো।”
এই পরামর্শটি আশিকি আজিমাবাদীর মনে ধরেছিল, এবং তিনি সেই অনুযায়ী সাধনা করে রেখতা ভাষার একজন বড় কবিতে পরিণত হন।
উর্দু কবিতার আরেক দিকপাল মির্জা মুহাম্মদ রাফি সওদা (মৃত্যু ১৭৮১) এক কবিতায় দেখিয়েছিলেন অভিজাত ফার্সির সাথে অশিক্ষিত আর অজ্ঞদের ভাষা হিসেবে পরিচিত হিন্দাভীর একটা তুলনামূলক আলোচনা। তার কবিতার একটা পঙ্ক্তি মোটা অনুবাদে দাঁড়াবে এমন:
“ভাষা সে যাই হোক, আসল বিবেচ্য তো শ্রেষ্ঠত্ব ভাবনায়
কবিতায় সীমা নেই, সীমায়িত নয় সে ফারসের ভাষার আওতায়।”
এইভাবে ফার্সির প্রভাবে, কিন্তু শেষপর্যন্ত সেটার ছায়ামুক্ত হয়েই ভবিষ্যতের জনগণের ভাষা হিন্দী ও উর্দুর বিকাশ। ঊনিশ শতকের বৃটিশ শাসনামলে উর্দু আরেকধাপ এগিয়ে যায়, প্রধানত দেওবন্দ শিক্ষা আন্দোলনের মাধ্যম হওয়ার কল্যাণে, ভারতবর্ষ জুড়ে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলমান জনগোষ্ঠীর ভাষাগত যোগসূত্র হয়ে। ঊনিশ শতকেই হিন্দিভাষাকেও উর্দু থেকে পৃথক করে সংস্কৃতায়িত ‘হিন্দু’ রূপ দেয়া হয়। এভাবে ধর্মসংশ্লেষহীন হিন্দাভির ধর্মীয় পরিচয়ও তৈরি করা হলো। ওদিকে ঊনিশ শতকেই ভিন্ন এক পথে বাংলা ভাষা বিপুল অগ্রগতি অর্জন করে। বিশ শতকে পাকিস্তানী শাসকরা চাপিয়ে দিতে চায় বাংলার ওপর উর্দু ভাষাকে, ঠিক যেভাবে আজকে ভারতবর্ষের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে হিন্দি ভাষাকে। এই বাংলা ভাষার বিকাশটাকেও বুঝতে হলে শুধু ঊনিশ শতকে তার বিস্তারকে দেখলে চলবে না, প্রাকমোগল যুগের এক দরবারী আড্ডায় সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ কেন ফার্সি ভাষায় ছন্দ মেলাতে ব্যর্থ হন ও পারস্যের কবিশ্রেষ্ঠ হাফিজকে আমন্ত্রণ করেন নিজ দরবারে রাজকবির আসনে বসতে, তার রাজনৈতিক ব্যাখ্যাও আমাদের জানতে হবে। সেটা আরেকদিন।